পুনরাবৃত্তি
আসমা আক্তার
উইমেননিউজ২৪.কম
প্রকাশিত : ০২:৪৩ পিএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭ শনিবার | আপডেট: ১২:২৭ পিএম, ২৮ মার্চ ২০১৮ বুধবার
হিসেবটা মিলাতে পারি না কতটুকু সময় কাছে থাকে আদরের সোনামনিরা। আদরের সময় এত কম কেন? যে কারণে আপনজন ছাড়ি তা হয়ত কিছুটা পূরণ হয়, কিন্তু ভালবাসা-আদর যে অপূর্ণই থেকে যায়! সময়ত থাকে না। শুধু আফশোসটা নিয়েই বাঁচতে হয়! তবে আনন্দ এতটুকই "ওরা দূরে থাকলেও হয়ত ভাল আছে"।
সামাজিক নিয়মে বিয়ে হয়ে যায়, বিয়ের পর খুব কম মেয়েই মনের মত সংসার পায়। স্বামী, স্বামীর আত্মীয়স্বজন সকলের মন জুগিয়ে সন্তানের দায়িত্ব নিয়ে চলতে গিয়ে বাবা মার কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ খুব কম হয়।
এমনই সময়টা পার করে এসে মনে হয় কতটুকু সময় দিয়েছি তোমাদের আমি!
সংসারের টানাপোড়েন কাটাতে চাকরিতে যোগ দেয়া। আর তারপর থেকেই ব্যস্ততা আর কাটেনি। মাস শেষ না হতেই টাকা শেষ, ধার নেওয়া, ধার শোধ করা এক চক্রবৃদ্ধির মধ্যেই কেটে যায় দিনগুলো। কারো জন্য সময় বের করার সময়ই হয় না।
বৃদ্ধ বাবা-মা পথপানে চেয়ে থাকেন কবে আসবে তার জঠরের ধন, পাশে বসবে মন খুলে বলবে দুটি কথা। একটা ছুটি পেয়ে সেই পুরানো পথে দেখতে দেখতে এগোচ্ছি, ভাংগা পুলটা তেমনিই আছে। রিকশায় বসে দুটি বাচ্চাকে সামাল দিতে পারছিলাম না। অবশেষে পৌঁছানো গেল বাড়ি। মা-বাবাকে দেখে সব কষ্ট ভুলে গেলাম। একসাথে রাতে খেলাম। গরমে বাচ্চারা ছটফট করছে। আম্মা একটা হাত নাড়াতে পারতেন, সে হাতে একটা তালপাখা দিয়ে বাতাস করলেন। তারপর কত গল্প।
দেখতে দেখতে চলে এলো বিদায়ের দিন। সকাল থেকেই আম্মার একটি কথা আরেকটা দিন থেকে যা। কিন্তু ছুটি শেষ জানি তা সম্ভব নয়। সব একত্র হলো পুকুর পাড়ে। বিদায় নেওয়া কত যে কষ্টকর! বাচ্চাগুলোর হাত ছুঁয়ে, কোলে নিয়ে আদর, আমার দিকে তাকিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে মা একসময় ক্লান্ত, বাবাকে একসময় বলতেই হল ট্রেন ছেড়ে দিবে।
পুকুরের দক্ষিন কোনে তালগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে তাকিয়েই ছিলেন বাবা আর মা। তাকিয়েই ছিলেন যতক্ষণ রিক্সাটা দেখা যায়। মা তুমি অনেক আগে চলে গেছো, তারপর বাবা। তবু সে দৃশ্য আমার মনে আটকে আছে যা ভোলা যায় না, যাবেও না। তোমরা চলে যাওয়ার পর কতবার গেলাম এমন তো আর লাগেনি। এত ভালবাসা নিয়ে এত করুণ চোখে কেউ তাকিয়ে থাকেনি।
আজ তার পুনরাবৃত্তি আমার জীবনে। এত আদরের সোনামানিরা আমার। দূরে চলে গেলো সেই জীবনের তাগিদেই। কষ্ট কমাতে গেলাম ওদের দেখতে। বেশ ভালো সময় কাটলো কিছুদিন একসাথে। কত জায়গা এত কম সময়ে ঘুরলাম, অথচ কোনো ক্লান্তি নেই। কারণ দুটি ছোট্ট পাখির কলকাকলি, ছেলে আর ছেলের বউয়ের যত্ন। তারপর সেই বিদায়ক্ষণ ঘনিয়ে এলো।
একদিন ভোর বেলা, আকাশ তখনো অন্ধকারে ঘুমিয়ে। সেই কাকভোরে জেগে উঠল সবাই। নিজে লাগেজ রেডি করে, নিজের গাড়িতে উঠিয়ে ৬ বছরের আর দুই মাসের কলিজার টুকরো দুটি আর তার স্ত্রীসহ আমাদের নিয়ে এলো এয়ারপোর্টে। তারপর একের পর এক এয়ারপোর্টে ফরমালিটিস। ধীরে ধীরে আমার সব জ্ঞান যেন লুপ্ত হতে চলছে তখন। পা যেন চলছে না। জড়িয়ে ধরে রাখলাম ওদের কিছুক্ষণ। মনে হচ্ছিল যুগ যুগ ধরে আদরের বন্ধনে এভাবেই থাকি। মনে হল সেই তুই আবার ছোট হয়ে গেছিস! যেমন করে আমার বুকে না চেপে ধরলে তোর ঘুম আসত না। হাতা বুলাতে থাকি তোর চুলগুলোয়, আদরে চুমুতে ভরে দেই তোকে সেই ছোটবেলার মত! তোর ছেলে মেয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে! তুই তো আমার সেই নাড়িছেঁড়া ধন!
তারপর একসময় বলতেই হলো প্লেন ছেড়ে দিবে। ওরা বললো তোমাদের যতক্ষণ দেখা যায় দাঁড়িয়ে থাকবো! বুকের কষ্ট-হাহাকার, আর চোখের জল যে বাধ মানছে না । বোর্ডইন, চেকইন তারপর আর দেখা যায় না। ভাবলাম হারিয়েই ফেলেছি, ইমিগ্রেশনের পর একটি কাঁচ ঘেরা রুম। কাঁচের জানালার কাছে এসে দেখি ঠিক আমাদের বরাবর দাঁড়িয়ে। কোলে তার বড় সন্তানটি।
আহারে সন্তানের মায়া!
তোদের কোলজুড়ে সন্তান দুটো যেন সব ভালোবাসার অভাব পূরণ করে দেয়! ভালোবাসায় ভালো থাকিস তোরা চিরদিন।