সে এক অপরূপ রঙিন পাখি, কমন স্টারলিং
আইরীন নিয়াজী মান্না, নিউইয়র্ক থেকে
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০২:২০ এএম, ২৩ ডিসেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার
ফাইল ছবি।
পাখিটিকে খুব দেখছি চারপাশে। নিউ ইয়র্কে এসেছি প্রায় চার মাস। গতবারও দেখেছি। এবারও বেশ ঘন ঘন আমার নজর কাড়ছে ও। কখনো আমাদের বাসার লনে, কখনো সামনের রাস্তায় তার দেখা পাই। রাজপথ ধরে যখন হেঁটে বেড়াই তখনও দেখি ফুটপাতে কিংবা দোকানের কার্ণিশে বসে খুঁটে খুঁটে সে খাবার খায়। সুন্দর দৃষ্টিনন্দন দেহ তার। সারা শরীর খয়েরি পালকে আবৃত। তার মাঝে যেন ছোট ছোট পুঁতি বসানো। আকারে চড়ুই পাখির চেয়ে সামান্য বড়।
সেদিন বাসা থেকে বেড়িয়ে একটু পথ যেয়ে ডান দিকে ট্রান নিয়েছি। দেখি শেষ বিকেলে একটি গাছের নিচে ২০/২৫টি পাখি কি যেন খাচ্ছে। ছবি তোলার জন্যে সময় আর পেলাম না। আমার পায়ের শব্দেই ওরা ঝাঁক বেধে উড়ে গেলো নীল আকাশের বুকে। আমি হা করে তাকিয়ে দেখলাম ওদের চলে যাওয়া।
কি নাম এই চমৎকার পাখিটার! নেটে সার্চ দিতেই অবাক হলাম আরও একবার। এটা শালিক পাখি! যাকে আমরা বলি চিত্রা শালিক বা পাতি কাঠশালিক। তবে দেশে কখনো এই পাখিটি আমি দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। ওর বৈজ্ঞানিক নাম: Sturnus vulgaris, ইংরেজি: Common Starling। স্টারনিডি পরিবারভূক্ত মাঝারি আকৃতির গায়ক পাখি। ২০ সেন্টিমিটার লম্বাটে এ পাখির গায়ে ছিটছিটে কালচে পালক রয়েছে। ওরা সাধারণত দুই থেকে তিন বছর বাঁচে।
বছরের কোনো কোনো সময়ে ও রঙ বদলায়। খানিকটা সাদা রঙের হয়। ওদের পা গোলাপী বর্ণের এবং শীতকালে চঞ্চু কাল ও গ্রীষ্মকালে হলদে বর্ণের হয়ে থাকে। পূর্ণবয়স্ক পাখির তুলনায় ছোট্ট শাবকের পালক কিছুটা বাদামী বর্ণের। গায়ক পাখি হিসেবে বিশ্বব্যাপী ওদের যথেষ্ট পরিচিতি রয়েছে। দলবদ্ধভাবে থাকতে পছন্দ করে ওরা। অতিমাত্রায় কিচির-মিচির করে ওরা অন্যের নজর কাড়ে।
বিভিন্ন ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী, শিকারী পাখির কবলে পড়ে ধীরে ধীরে এদের আবাসস্থলগুলো সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। উত্তর ও পশ্চিম ইউরোপে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তৃণভূমির স্বল্পতাজনিত কারণে ধীরে ধীরে এ পাখির সংখ্যা কমছে। তা স্বত্ত্বেও ব্যাপক সংখ্যায় চিত্রা শালিকের দেখা যাবার প্রেক্ষিতে আই.ইউ.সি.এন এ প্রজাতিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে উল্লেখ করেছে।বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনানুসারে রক্ষিত বন্যপ্রাণীর তালিকায় তফসিল-১ অনুযায়ী এ প্রজাতি সংরক্ষিত।
চিত্রা শালিকের প্রায় এক ডজন উপপ্রজাতি রয়েছে। ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোয় এ পাখির প্রধান বিচরণক্ষেত্র। এছাড়াও উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে এ পাখির দেখা মেলে। দক্ষিণ ও পশ্চিম ইউরোপ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোয় এ পাখির প্রাচীন উৎপত্তি স্থল হিসেবে বিবেচিত। পরিযায়ী পাখি হিসেবে চিত্রা শালিক শীত মৌসুমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এসে থাকে।
প্রজনন : আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে চিত্রা শালিক সচরাচর প্রতিবৎসর মে-জুন মাসে এক থেকে দুইবার ডিম দেয়। সাদাসিধে বাসা বাধে। ঘরের চালের ফাঁক, সিলিং, কাঠঠোকরার কোটরে অগোছালোভাবে পাতা, খড়, শুকনো ঘাস দিয়ে বাসা তৈরি করে। প্রজনন মৌসুমে ওরা বদরাগী হয়ে যেতে পারে। চার থেকে পাঁচটি নীলচে রঙের ডিম পাড়ে। প্রায় দুই সপ্তাহ ডিমে তা দেয়। বাচ্চাগুলো পরে আরো তিন সপ্তাহ বাসায় অবস্থান করে।
খাদ্য তালিকা : চিত্রা শালিক পোকামাকড় খেতেই বেশি অভ্যস্ত।
প্রচুর মাকড়শা, মথ, ঘাসফড়িং, মৌমাছি, পিঁপড়া প্রভৃতি কীট-পতঙ্গ খেয়ে কৃষকের উপকার করে থাকে ওরা। এছাড়াও কেঁচো, শামুকসহ ব্যাঙ, টিকটিকিজাতীয় ছোট্ট আকৃতির মেরুদণ্ডী প্রাণীও শিকার করে খায়। সর্বভূক প্রাণী হিসেবে ফলমূল, অঙ্কুরিত বীজ, নোংরা-আবর্জনা থেকেও ওরা খাদ্য সংগ্রহ করে। আঙ্গুর, চেরিজাতীয় ফলও সুযোগ পেলে গিলে ফেলে।
লেখক : আহ্বায়ক, বাংলাদেশ বার্ড ওয়াচার সোসাইটি।
জামাইকা, নিউ ইয়র্ক।
২২.১১.২০২১