ঢাকা, সোমবার ২৫, নভেম্বর ২০২৪ ১৯:৩০:২৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

ছোট গল্প# জলের প্রতিমার প্রতিচ্ছবি

সোমা দেব

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৮:১২ এএম, ২৩ ডিসেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার

ছোট গল্প# জলের প্রতিমার প্রতিচ্ছবি: সোমা দেব

ছোট গল্প# জলের প্রতিমার প্রতিচ্ছবি: সোমা দেব

চৈত্রের দুপুরে শরীরটা যখন ক্লান্ত লাগে ভাত খেয়ে একটু গড়িয়ে নিতে ইচ্ছা হয় বিছানায়। চোখ একটু তন্দ্রা মতন হয়, ঠিক ঘুম নয়, আবার যেনো জেগে থাকাও নয়। চোখ বুজে হাজারটা ভাবনা থেকে দূরে গিয়ে কোন অতল সমুদ্রে ডুবে যেতে থাকার মত হয়। তখনি এরকম একটা ছবি ভেসে উঠে অরুনিমার সামনে৷ কানের কাছে মন্ত্রের মত ফিসফিস করে যেন কেউ বলে যেতে থাকে কথাগুলো,
'একখন্ড উঠোন, ভরদুপুরে
বসন্ত বাউরির ডাক, কুয়োতলায়-
জলের প্রতিমার প্রতিচ্ছবি, ঢেউয়ের
নৃত্যে উড়ে চলা সুনীল আকাশ।
সে তো আমারই অরুনিমা।'

কতকাল আগে! স্বরূপকাঠির সেই গ্রামের বাড়ি। নির্ঝঞ্ঝাট, নির্ভার, আনন্দপূর্ণ একটা সময়ের কথা মনে পড়ে। 

তখন সবে বিয়ে হয়ে এসেছিল ওই বাড়িতে। মনোময় কেবল বিএ পাস করে একটা স্কুলে চাকরি নিয়েছে। এসময় মনোময়ের বাবা মানে অরুনিমার শ্বশুর মশাই মনোময়ের বিয়ে দিয়ে পনেরো বছর বয়সের অরুনিমাকে ঘরে আনলেন। বললেন সবাইকে-'এ আমার বৌমা নয়, আমার মেয়ে। তোমরা সবাই মনে রেখো।'

তখন থেকে অরুনিমা সেই বাড়িটাতে মেয়ের মতই বড় হতে থাকল৷ শাশুড়িমাও যেনো মেয়ের মতই আগলে রাখলেন অরুনিমাকে। এর একটা কারণও আছে, তিনি কিছুদিন আগেই তার নিজের মেয়েকে হারিয়েছেন। তাই অরুনিমা আসায় আবার যেন সেই বাড়িতে নতুন করে প্রাণ ফিরে এলো। 

এ বাড়ির মাঝখানে একখন্ড সুন্দর উঠোন। সেই উঠোনের তিনদিকে তিনটা আলাদা বাসা। অরুনিমার শ্বশুর থাকেন একটি বাসায়, বাকী বাসা দুটোয় থাকেন দুই কাকা শ্বশুর। আর একদিকে বিশাল একটা কুয়োতলা। শান বাঁধানো বেদী। কুয়ো পেরিয়ে অনেক বড় একটা বাগান। নানা জাতের ফুল আর ফলের গাছে ভরা সে বাগান। 

অরুনিমার খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস। সে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসেই দেখতো, শাশুড়িমা একটা ফুলের সাজি নিয়ে বাগানে ঢুকে পড়েন। তারপর সাজি ভর্তি ফুল নিয়ে বের হন, ঠাকুরের পায়ে নিবেদনের জন্য আনেন সে ফুল। 

কয়েকদিন যেতে অরুনিমাও সঙ্গি হলো শাশুড়ির। ওরা দুজন ফুল তোলে আর নানা রকম গল্প করে। অরুনিমা যেনো সত্যি সত্যি তার শাশুড়ি মায়ের মেয়েই হয়ে উঠছিল। 

বাপের বাড়ি গেলে মামাতো পিসতুতো বোনরা তো রীতিমতো ঈর্ষা করতো অরুনিমাকে। বলতো, অরুনিমা, তুই কপাল করে এমন শ্বশুর বাড়ি, শ্বশুর, শাশুড়ি পেয়েছিস। ওদের কথা শুনে মনে মনে খুব খুশি হতো অরুনিমা। 

আর বরভাগ্য? বর বেচারা মনোময়। শ্বশুর-শাশুড়ি অরুনিমাকে এতই ভালবেসে ফেলেন যে, মনোময় অরুনিমার সাথে গল্প করারই সুযোগই পেত না। 

তবে, অরুনিমার একটা নিজের সময় ছিল। ঠিক দুপুরের পর যখন শ্বশুর-শাশুড়িসহ বাড়ির অন্য সবাই ভাতঘুম দিতে ব্যস্ত, মনোময়ও স্কুল থেকে ফেরেনি, অরুনিমা তখন একখন্ড উঠোনের প্রান্তে কুয়োতলায় চলে যেত। বসত শান বাঁধানো বেদীর ওপর। কুয়োর জলে নিজের ছায়া দেখতো। পাশের বাগানেই একটানা ডেকে উঠতো বসন্ত বাউড়ি। যেনো এক টুকরো স্বর্গ পৃথিবীতে নেমে এসেছে, এই বাড়িতে। মনে হত, এত সুখ কি কপালে রেখেছিলেন ঈশ্বর! 

এমনি এক দুপুরে মনোময়ের স্কুল একটু তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গিয়েছিল। সে বাড়িতে ফিরে দেখে, লাজুক স্বভাবের অরুনিমা কুয়োর জলের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ নিজের ছায়া দেখছে। মাঝে মাঝে যেন, নিজের ছায়ার সাথে কথা বলছে আপন মনে৷ পা টিপে টিপে অরুনিমার কাছে এসে ওকে চমকে দেয় মনোময়। গল্প করতে করতে কুয়োতলায় বসেই বাংলার শিক্ষক মনোময় অরুনিমাকে নিয়ে তাৎক্ষনিক একটি কবিতা বানিয়ে ফেলে...
'একখন্ড উঠোন, ভরদুপুরে
বসন্ত বাউরির ডাক, কুয়োতলায়-
জলের প্রতিমার প্রতিচ্ছবি, ঢেউয়ের
নৃত্যে উড়ে চলা সুনীল আকাশ।
সে তো আমারই অরুনিমা।'

সেই থেকে মনোময় অরুনিমাকে জলের প্রতিমার প্রতিচ্ছবি বলেই ডাকতো, অবশ্য তা একান্তে। 

এরপর হাজারবার সেই কুয়োতলায় বসেছে ওরা দুজন। জ্যোৎস্না রাতে, মেঘলা দিনে, চৈত্রের দুপুরে। অ-নে-ক দিন, অ-নে-ক বার। সেই জায়গাটা খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল ওদের। যখন থেকে মনোময় জানতে পারে এই কুয়োতলাটা অরুনিমার এত্ত প্রিয় তখন থেকে তারও জায়গাটা অনেক প্রিয় হয়ে যায়।

সময় গত হয়েছে অনেক। ঠিক যেন গল্পের মত করেই সময় কেটে যাচ্ছিল অরুনিমার। শ্বশুর বাড়ি, বাপের বাড়ি আরও কত জায়গায় বেরিয়ে সময় যায় মহানন্দে। এরমধ্যে আবার হঠাৎ করে শ্বশুর মশাই অসুস্থ হলেন। তখন সবাই মিলে তার চিকিৎসার জন্য প্রথমে ঢাকা, এরপর কোলকাতাতেও যাওয়া হলো। 

সময় যেনো ছুটে চলা ফড়িং। কখনোই তাকে ধরা যায় না। শুধু পিছু নিয়ে ছুটে চলতে হয়। এত কিছুর মধ্যেও সেই যে কুয়োতলা, সেখানে ঝিম ধরা দুপুরগুলোতে অরুনিমা বসে বসে নিজের ছবি দেখে কুয়োর জলে। আর মনোময়ের কথা ভাবে। নিজেকে জলের প্রতিমার প্রতিচ্ছবি মনে করে মিটিমিটি হাসে। 

সময় গড়িয়ে যায় আরও কিছুটা। আস্তে আস্তে অরুনিমার কোলজুড়ে আসে সন্তান। বিয়ের নয় বছরের মধ্যে চার সন্তান জন্ম দেয় অরুনিমা। তিন ছেলে আর এক মেয়ে। সারাদিন শ্বশুরের সেবাযত্ন, সংসারের কাজ, সন্তানদের যত্ন, শাশুড়ি আর ও, দুজন মিলে করে সব কিছু। আর অবসরের জন্য সেই একখন্ড উঠোন আর কুয়োতলা যেন সমস্ত ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় অরুনিমাকে। মনোময় আর অরুনিমার সেই কুয়োতলার বেদীতে বসে মান-অভিমান, রাগ ভাঙানো, প্রেম, গল্প খুনসুটি আলাদা একটা পরশ দিয়ে যায় জীবনে। 

এভাবেই চলছিল অরুনিমার জীবন। ছেলেমেয়েরাও বড় হয়েছে। এর মধ্যে শ্বশুর শাশুড়ি গত হয়েছেন। এক কাকা শ্বশুর এদেশের পাট চুকিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেছেন। আর এক কাকা শ্বশুর এক ছেলেকে নিয়ে খুলনায় স্থায়ী হয়েছেন। পুরো বাড়িতে অরুনিমা আর তার স্বামী মনোময়৷ বড় ছেলেকে ডাক্তার বানাতে চেয়েছিল অরুনিমা। কিন্তু সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় পড়াশোনা শেষ করে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। বিয়ে করেছে ওখানকার এক মেয়েকে। অরুনিমার ভালই লেগেছে। অতসব জাতপাতের ছুতমার্গ নেই ওর। মেজ ছেলে ঢাকায় থাকে। একটা বড় কোম্পানীতে মোটা বেতনে চাকুরি করছে। এরপর মেয়ে। সেও ডাক্তার। ছোট ছেলেও স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেছে অস্ট্রেলিয়ায়, আর ফেরেনি। ওখানেই সংসার গুছিয়ে নিয়েছে৷ 

আগে বড় হৈচৈ ছিল বাড়িটায়। বিশেষ করে পূজায় যখন সবাই আসত, তখন আলাদা একটা আনন্দ হতো। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক আয়োজনে শ্বশুর মশাই যখন অরুনিমাকে গান গাইতে বলতেন তখন লজ্জা পেলেও তানপুরা নিয়ে বসতো ও। কয়েকটি রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইত অরুনিমা। বেশ ভালো লাগত ওর। তাছাড়া মাঝে মাঝে অরুনিমাদের বাড়িতে গানের আসর বসত, মনোময়ও খুব ভাল গান গায়। 

একবার মনোময়ের স্কুলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে অরুনিমা গান গেয়ে পুরস্কারও পেয়েছিল, বঙ্কিম রচনাসমগ্র। এখনো বইয়ের আলমারিতে রাখা আছে বইগুলো৷ সে সব বহুকাল আগের কথা। 

এখন সেরকম করে আর কেউ নেই এই বাড়িতে। কালেভদ্রে মেজ ছেলে আর মেয়ে আসে দুই একদিনের জন্য৷ তবে এই বাড়ি, কুয়োতলা ছেড়ে অরুনিমা কোথাও একটা যায় না। বাবা-মাও বেঁচে নেই। তাই বাপের বাড়িতেও আর যাওয়া হয় না। স্বরূপকাঠির আদি এই বাড়িটা আগলে রেখেছে সে একান্তে আপন করে। 

সময়ের পরিক্রমায় একদিন মনোময়ও ছেড়ে চলে যায় অরুনিমাকে। অজানার উদ্দেশ্যে। আজকাল সময়গুলোও যেন অরুনিমাকে উপহাস করে। ওর সঙ্গে পুরনো একজন কাজের সহকারী থাকে এই বাড়িতে। তার নাম কমলা। এ বাড়িতে আর কেউ নেই। অথচ ভাবা যায় না, এই বাড়িটি একদিন লোকে ভরপুর ছিল, বাড়ির সদস্য আর কাজের লোকে ভরা বাড়ি। সেই লোকে ভরা বাড়িতে পনেরো বছরের কিশোরী অরুনিমা বিয়ে হয়ে এসেছিল। শ্বশুর শাশুড়ির চোখের মনি হয়ে নূপুর পায়ে রুমঝুম রুমঝুম শব্দ করে ঘুরে বেড়াতো এই বাড়িতে। আজ তারা নাকি কেউ নেই! 

কিন্তু সেই যে অভ্যাস, কুয়োতলায় বসে নিজের ছায়া দেখা পুরোনো কুয়োর জলে, সেটা একদমই ভোলেনি অরুনিমা। জলের প্রতিমার প্রতিচ্ছবি, যে নামে মনোময় তাকে ডাকতো, সেই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে না সে। কিন্তু এভাবেই বা কতদিন! বয়স হয়েছে! নানা রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে। 

একবার তো স্নান করতে গিয়ে বাথরুমে পড়ে গিয়েছিল৷ কমলা গিয়ে তুলেছিল। কমলাও বা কত কী পারবে? ওরও তো বয়স হয়েছে। খবর পেয়ে এক রকম জোর করেই মেজ ছেলে তাকে ঢাকায় নিয়ে গেল, এ বাড়ির পাট চুকিয়ে। ডাক্তার দেখিয়ে সেখানেই রেখে দিল। কিন্তু অরুনিমার মন পড়ে থাকে স্বরূপকাঠিতে। সেই ঘর, বাড়ি, একখন্ড উঠোন, কুয়োতলা, শান বাঁধানো বেদী, বাগান, বসন্ত বাউড়ির ডাক, ঝিম ধরা দুপুর, তানপুরা! কত কিছু যেন ডেকে নিয়ে যায় তাকে স্বরূপকাঠিতে। 

এখানে শহুরে জীবন। ছেলে আর বৌমা ব্যস্ত থাকে অফিস নিয়ে। ওদের এখনো ছেলেপুলে হয়নি। প্রায় সারাদিন একা একাই বাসায় কাটায় অরুনিমা৷ গান শোনে, বই পড়ে। আর পুরনো দিনের কথা ভাবে। সময় কাটেনা অরুনিমার। বৌমা ঠিক মত কথা বলে না শাশুড়ির সঙ্গে। 

অরুনিমা মাঝে মাঝেই লক্ষ্য করে বৌমা যেন ঠিক পছন্দ করছে না শাশুড়িকে। ও টিভি দেখে বলে অফিসে যাওয়ার আগে ডিস লাইন ডিসকানেক্ট করে দিয়ে যায়। একদিন বৌমা রাগে গজগজ করছিল, বইয়ের আলমারি থেকে একটা বই নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অরুনিমার রান্নার শখ। বউ মার অভিযোগ, এ কারণে তেল-পেঁয়াজ বেশি খরচ হচ্ছে! 

এসব শুনেও চুপ থাকে অরুনিমা। ছেলেকে সুখি দেখতে চায় সে। তাই ছেলের সংসারে বোঝা হয়ে থাকতে চায় না। আবারও স্বরূপকাঠিতে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। কিন্তু কার কাছে যাবে! ওখানে তো কেউ নেই! মাঝে মাঝে মেয়ে এসে নিয়ে যায় বটে। কিন্তু সেও তো থাকে শ্বশুর শাশুড়ি নিয়ে। সেখানেই বা কতদিন থাকা যায়! শুধু চেকআপের কথা বলে মেয়েকে দেখাতে যায়, দেখতেও যায়। 

এরই মাঝে অরুনিমা মেজ ছেলের বাসার আশেপাশের পথঘাট একটু আধটু চেনা শুরু করেছে। সকালে মর্নিং ওয়াক করতে গিয়ে দুই একজনের সাথে আলাপ হয়েছে। পাশের বিল্ডিংয়ের এক ভদ্রমহিলার সাথে আলাপ হয় অরুনিমার। উনি কলেজে পড়াতেন, রিটায়ার্ড করেছেন। এখন নানা রকম সমাজসেবার সাথে জড়িত আছেন। তার সাথে সময়টা অরুনিমার খুব ভাল কাটে। দুজন হাঁটতে হাঁটতে নানা গল্প করেন। 

একদিন অরুনিমাই সেই ভদ্রমহিলাকে চা খাওয়াতে নিয়ে আসেন বাসায়। কিন্তু সেদিন হয়ত বৌমা কোন কারণে আগে থেকেই রেগে ছিল। অতিথির সামনেই অপমান করে বসলো অরুনিমাকে। লজ্জায় চোখ ভিজে উঠল অরুনিমার। মনে মনে ভাবে, এ বাসায় কাউকে তাহলে কি এক কাপ চা খাওয়ানোরও অধিকার নেই অরুনিমার? 

ভীষণ অপমানে অরুনিমা ঠিক করে এখানে আর নয়। মেয়ের সাথে পরামর্শ করে ছেলের বাড়ি ছাড়ার চিন্তা করে সে। সেই ভদ্রমহিলা বেশ সাহায্য করেন এ ব্যাপারে। মেয়ে অবশ্য ভীষণ আপত্তি করেছিল প্রথমে। বলেছিল মেজদার সাথে কথা বলবে। কিন্তু সে ঠান্ডা মাথায় মেয়েকে শান্ত করে, বোঝায়। 

নানা রকম অফিসিয়াল কাজ শেষে অরুনিমা সত্যি একদিন রওনা দেয় 'শান্তিনিবাস' বৃদ্ধাশ্রমের দিকে। অরুনিমা ঠিক জানে না আদৌ শান্তি আছে কিনা শান্তিনিবাসে। প্রথম দিকে খুব খারাপ লাগতো ওর। মনোময়ের মুখটা ভেসে উঠতো খুব। মনে পড়তো সবার কথা। শ্বশুর-শাশুড়ি, বাবা-মা সবাই যেনো কোথায় হারিয়ে গেলো! 

আজ একাশি বছর বয়স অরুনিমার। মেয়ে সপ্তাহে একদিন হলেও দেখতে আসে। ডাক্তার মেয়ে মাকে চেকআপ করে দিয়ে যায়। এখানকার অন্য যারা রয়েছে তারাও বেশ ভালো। সুন্দর সখ্যতা গড়ে উঠেছে সবার সাথে। খুব ভাল সময় কাটে সকলে মিলেমিশে।

তবে, এখন অনেক কিছুই আর আগের মত মনে থাকে না অরুনিমার। একটা গান গুনগুন করে গাইতে থাকলেও মাঝপথে ভুলে যায়। কিন্তু সেই যে স্বরূপকাঠির কুয়োতলা, বেদী আর একখন্ড উঠোন, সেটা মনের কোথায় বাসা বেঁধে আছে, তার সন্ধান আজও পায়নি অরুনিমা।  

ঝিম ধরা দুপুর, চৈত্রের এই দুপুরে যখন ওল্ড হোমের নিম গাছটাতে বসে একটা ঘুঘু আপন মনে ডেকে যায়, চোখ আধবোজা হয়ে থাকে, জগতের সব সুখ-দুঃখ, রাগ, অভিমান- সব কিছুর ঊর্ধ্বে চলে যায় মন। যখন সমুদ্রের অতলে তলিয়ে যাওয়ার মত অনুভূতি হয় তখনি যেন কানের কাছে মনোময় ফিসফিস করে বলে যায়, 
'একখন্ড উঠোন, ভরদুপুরে
বসন্ত বাউরির ডাক, কূয়োতলায়-
জলের প্রতিমার প্রতিচ্ছবি, ঢেউয়ের
নৃত্যে উড়ে চলা সুনীল আকাশ।
সে যে আমার অরুনিমা!' #