ঢাকা, রবিবার ২২, ডিসেম্বর ২০২৪ ৭:৩৬:০৪ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

ছোটগল্প# বকের বাসা বাঁশবনে: সোমা দেব

সোমা দেব

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৩:৫৩ এএম, ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ বুধবার

ছোটগল্প# বকের বাসা বাঁশবনে: সোমা দেব

ছোটগল্প# বকের বাসা বাঁশবনে: সোমা দেব

আজ বিকেলে অফিস থেকে ফিরেই মা জানাল, তাকে বদলি করা হয়েছে দূরের এক গ্রামে। গ্রামটি আমাদের শহর থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরের পথ। আমার মা পুলিশে চাকরি করেন। মার এখন যে থানায় পোস্টিং সেটা আমাদের ছোট্ট শহর থেকে খুব কাছে। অটোরিকশায় চেপে যেতে লাগে বিশ মিনিট। মা শহরের বাসা থেকেই প্রতিদিন অফিস করে। 
কিন্তু মাকে এখন যেখানে বদলি করা হয়েছে সেটা একদম অজপাড়া গাঁ। ইলেকট্রিসিটি, টিভি, ইন্টারনেট কিছুই নেই। আমি এতদিন এই শহরের স্কুলে পড়েছি। এখন হয়ত আমাকেও মায়ের সাথে যেতে হবে। ভর্তি হতে হবে গাঁয়ের স্কুলে। 
প্রিয় বন্ধুদের ছেড়ে যাব ভেবে খুব কষ্ট হচ্ছে। শিলা, মিথুন, অর্পা, নেলী, ফারিয়া সবাইকে কত মিস করব। ওরা আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ওরাও কত কষ্ট পাবে আমার জন্য। কিন্তু উপায় কী!
গ্রামে গিয়ে থাকব ভেবে অবশ্য খুব ভালো লাগছে। দিদার কাছে গ্রামের গল্প শুনে আমার গ্রামে থাকতে খুব ইচ্ছে করে। মনে হলো, গিয়ে দেখিই না কেমন লাগে! 
মায়ের ডিউটি দিনের একেক সময় থাকে। তাই আমার দিদাও আমাদের সাথে থাকে। 
একদিন ছুটির দিনে লাগেজ গুছিয়ে আমরা রওনা দিলাম সেই দূরের গাঁয়ে। গাঁয়ের নাম ফুলপুর। পথে যেতে যেতে কত কী যে চোখে পড়ল! রাস্তার চারদিক জুড়ে বিস্তীর্ণ সবুজ ফসলের খেত, সারি সারি সুপারি গাছ। দূরে তালগাছে বাবুই পাখির বাসা। বাতাসে দোল খাচ্ছে বাসাগুলো। একদল ছোটো ছেলেমেয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে সবুজ জড়ানো খেলার মাঠে। আরো দূরে নদীতে জেলেরা জাল বিছিয়ে মাছ ধরছে। বিলের জলে ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। আরো যে কত কী চোখে পড়ল! 
সবুজ প্রকৃতি আর খোলা আকাশ দেখতে দেখতে আমরা একসময় ফুলপুরে চলে এলাম। চারদিক কেমন অচেনা লাগছিল। পথঘাট, মানুষ, বাড়িঘর সবই অচেনা আমার চোখে। তবে সবকিছুতে আছে প্রাণের ছোঁয়া।
আমরা থাকার জন্য সরকারি কোয়ার্টার পেয়েছি। কোয়ার্টার মানে পুরনো কাঠের দোতলা একটা বাড়ি। পুরনো আমলের লোহার সিঁড়ি আছে সে বাড়িতে। বাড়ির চারদিক জুড়ে বিশাল সবুজ লন। আমাদের দেখভাল করার জন্য একজন বয়স্ক আর্দালিও আছে। তার নাম শান্তারাম। সে আমাদের এগিয়ে নিতে এসেছিল। পথে যেতে যেতে শান্তারাম কাকা গল্প করছিল, এই বাড়িতে যারা থাকত তারা বহু আগে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। দেশভাগের সময়। এখন এটা সরকারি কোয়ার্টার। 
বৃষ্টি পড়ে পথঘাট একটু ভেজা ভেজা হয়েছিল। আমরা যখন রাস্তায় তখনই বৃষ্টির ফোঁটা পড়া শুরু হয়। মাটিতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে সোদা একটা ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছিল। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। আমরা বাড়িতে ঢুকে কাপড় বদলে খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিলাম। 
বৃষ্টি শেষ হলে বিকেলে গ্রামের পথে ঘুরতে বের হলাম সবাই মিলে। শান্তারাম কাকা বলছিল, এখানে একটা সুন্দর দিঘি আছে। সেই দিঘির জলে ফুটে থাকে লাল আর সাদা শাপলা। দিঘির কালো জলে নৌকা চড়ে বেড়ায় অনেকে। মা অফিসিয়াল কাজের জন্য চারদিকে ঘুরবে। জুনিয়র এক অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে মা-বাবা চলে গেলো অন্য পথে।
আমি আর দিদা মিলে চলে গেলাম সেই বিলের দিকে। সঙ্গে নিলাম শান্তারাম কাকাকে। বিশাল বিলটা ভীষণ সুন্দর! সাদা সুতার মত এঁকেবেঁকে চলে গেছে দূরের পথে। বিলের স্বচ্ছ কালো জলে শাপলা ফুটে আছে। কেউ কেউ মাছ ধরছে। জলের বুক চিড়ে এক ঝাঁক হাঁস সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। আমরা নৌকায় করে অনেকক্ষণ ধরে ভেসে বেড়ালাম। শান্তারাম কাকা আমাকে শাপলা ফুল তুলে দিতে চাইলো। 
দিদা বলল, ফুলগুলো তো বিলেই ভালো লাগছে। 
তার কথায় আমিও সায় দিলাম। তবে একটা ফুল নিলাম ঠিকই। ফেরার পথে দেখি ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বক বিলের ধারে বসে আছে। দূর থেকে দেখে মনে হলো বিলের পাড়ে সাদা বেলি ফুল ছড়িয়ে রয়েছে। আমি তো এত এত বক দেখে মুগ্ধ আর ঘরে ফিরে যেতে চাইছি না। 
এদিকে সন্ধে হয়ে গেছে। আকাশ জুড়ে অন্ধকার নেমে আসছে। আমাদের ফিরতে হবে। 
শান্তারাম কাকা বলল, এখন চলো মা, কাল তোমাকে এর চেয়েও বেশি বক দেখাতে নিয়ে যাব। 
কাকার আশ্বাসে ফিরে এলাম বাসায়। এ গ্রামে ইলেকট্রিসিটি নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। তবে বিশেষ ব্যবস্থায় আমাদের কোয়ার্টারে কয়েকটি বাল্ব জ্বালানো হয়। আর পুরো বাড়িতে সন্ধ্যের পর হারিকেন জ্বলে। হারিকেনের আলোতে নানা ধরনের পোকা আসে ঘরে। সেই পোকা খাওয়ার জন্য আসে ব্যাঙ। আমি এবং দিদা বসে বসে পোকা আর ব্যাঙের খেলা দেখি। 
পরের দিন বাবা গিয়ে আমাকে একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলো। তবে এখন স্কুল বন্ধ। কদিন পরেই খুলবে। ক্লাস শুরু হলে নতুন কিছু বন্ধু পাব। তাই স্কুলে ভর্তি হয়ে খুব ভালো লাগছিল। 
মা অফিসে জয়েন করেছে। নিয়মিত অফিস করছে। শান্তারাম কাকা বক দেখাতে নিয়ে যাবে বলেছিল। তা কিন্তু আমি ভুলিনি। একদিন বিকেলে কাকাকে তা মনে করিয়ে দিলাম। কাকারও মনে আছে। এক বিকেলে আমি আর দিদা শান্তারাম কাকার সাথে গেলাম বক দেখতে। অনেকটা পথ হেঁটে যাওয়ার পর কাকা একটা বাড়ির সামনে নিয়ে গেলো আমাদের। দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম বাড়িটা। 
কাকাকে বললাম, এই বাড়িতে বক থাকে? এটা কি বকের বাড়ি?
কাকা হেসে বলল, চলোই না আগে ভেতরে যাই! তারপর দেখবে।
ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল বিশাল বিশাল মাটির ঘরগুলো দিকে। বাড়ির মাঝখানে বিরাট অংশ জুড়ে বড়ো উঠোন। বাড়ির লোকজন আমাদের পরিচয় জানতে পেয়ে বসতে বলল। আমার আর তর সইছে না। 
একটু পরই পাখির কিচির মিচির আর পাখা ঝাপটানোর শব্দ কানে ভেসে এলো। ঝাঁকে ঝাঁকে বকপাখি এসে বাড়ির পেছন দিকের বিশাল বাঁশবনে বসছে। আমার তো সাথে সাথেই ক্লাস ওয়ানে পড়া খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিনের লেখাÑ ‘ঐ দেখা যায় তাল গাছ ঐ আমাদের গাঁ/ঐখানেতে বাস করে কানা বগীর ছা’ ছড়াটি মনে পড়ে গেল। এত্ত এত্ত বক বাসাবেঁধে আছে গাছে গাছে! আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। এ কি সত্যি! এত বক একসাথে!
এ বাড়ির মালিকের নাম আনোয়ার উদ্দিন। ভদ্রলোক জানালো, এই বাঁশবনে প্রায় চল্লিশ বছর আগে প্রথম বক বাসা বাঁধে। তারা কোনো দিনও বকগুলো তাড়ায়নি। পাশেই জলাভূমি আছে। তাই প্রচুর মাছ আর নানারকম খাবার রয়েছে ওদের। আস্তে আস্তে বাচ্চা ফুটে এত এত বক হয়েছে। মাঝে মাঝে এ বাড়ি থেকেও খাবার দেয়া হয় বকগুলোকে। 
ফেরার পথে শান্তারাম কাকা বলল, কেমন সুন্দর একটা জিনিস দেখালাম। তাই না মামণি?
আমি বললাম, কাকা, এই বাড়িতে আমাকে প্রতিদিন নিয়ে আসবে?
আমার কথা শুনে দিদা আর শান্তারাম কাকা হেসে ফেলল। 
বাড়ি ফিরে শুধু বকগুলোর কথাই মনে পড়তে লাগল আমার। কত কত বক ওই বাড়িতে থাকে। তবে আনোয়ার কাকার একটি কথা বারবার মনে হলো, আজকাল বকগুলো নাকি নিরাপদ নয় ওখানে! পাখি শিকারিরা খুব জ্বালাতন করে পাখিদের। দুষ্টু লোকগুলো এতই প্রভাবশালী যে, কারো কথাই শোনে না। 
পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বসে বকগুলো নিয়ে মায়ের কাছে অনেক গল্প করলাম। মাও শুনে খুব আগ্রহ দেখাল। বলল, এক দিন দেখতে যাবে বাঁশবনে বাঁধা সেই বাসা। আর হাজারো বকপাখি। 
মাঝে মাঝে ভাবি, ওসব বকপাখির বাসাটা যদি আমাদের হতো! তাহলে কত মজা হতো! আমার তো এখন প্রতিদিনই আনোয়ার কাকার বাসায় যেতে ইচ্ছে করে! মন পড়ে থাকে সে বাড়িতে। মনে হয়, অনেকক্ষণ ধরে বসে বসে শুধু পাখিগুলো দেখি। কিন্তু পড়াশুনার চাপে প্রতিদিন আর যাওয়া হয় না। 
তবে সময় পেলে শান্তারাম কাকার সাথে মাঝে মাঝেই যাই বকেদের বাড়ি। আমি বক দেখতে দেখতে আনোয়ার কাকার সাথে নানা গল্প জুড়ে দেই। দিদাও কত যে গল্প করে। 
একদিন কথায় কথায় আনোয়ার কাকা জানাল, বকদের শিকারিরা খুব উত্যক্ত করে। বিশেষ করে শীতের সময় শিকারিরা এসে বকসহ অন্যান্য পাখি ধরে নিয়ে যেতে চায়। প্রতিবছর শীতের আগে আগে এই বাঁশবনে বকগুলোর সাথে সাথে অন্যকিছু পরিযায়ী পাখিও এসে বাসা বাঁধে। শীত শেষ হলে চলে যায়। কিছু পরিযায়ী পাখি আবার দীর্ঘ দিন এখানে থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। শীত শেষ হলেও ওরা আর চলে যায় না। শিকারিরা এসব পাখি ধরে নিয়ে চওড়া দামে বিক্রি করে দেয়। এই অবৈধ শিকারিদের ভয়ে কেউ কিছু বলে না। তাই এরা এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। কথাগুলো শুনে আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। 
বেশকিছু দিন কেটে গেছে। আমি অনেক দিন বক পাখিদের দেখতে যেতে পারিনি। স্কুলে পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া আমার কয়েকজন নতুন বন্ধু হয়েছে। ওদের সাথে আমার বেশ ভাব জমে গেছে। 
এর মধ্যে কয়েক দিনের ছুটিতে আমরা মামার বাড়িতেও ঘুরে এলাম। এভাবে কেটে গেল বেশকিছু দিন। তবে আমি বকগুলোর কথা একদম ভুলিনি। বাঁশবনে বকের বাসার কথা আমি মামাতো ভাইবোনদের বলেছি। ওরা বলেছে এই শীতের ছুটিতে বক দেখতে আসবে। 
আস্তে আস্তে অল্প করে শীত পড়ে গেল। সবুজ গ্রামের চারদিক কুয়াশায় ঢাকা থাকে সকাল-সন্ধ্যা। দূর থেকে দেখে মনে হয় কুয়াশার চাদরে জড়িয়ে আছে পুরো গাঁ। ভোরে দূর্বাঘাসে বিন্দু বিন্দু শিশির জমে থাকে। শিউলি ফুল ছড়িয়ে থাকে ঘাসের বুক জুড়ে। আমার কী যে ভালো লাগে ঝরাশিউলি কুড়াতে। সাঝি ভরে আমি ফুল কুড়াই প্রতিদিন ভোরে।
আমি আর দিদা মাঝে মাঝে সকালে হাঁটতে বের হই। কখনো বাবাও থাকে আমাদের সাথে। আমি শিউলি ফুল কুড়াই, মালা গাঁথি। মাঝে মাঝে আনোয়ার কাকার বাসায় গিয়ে বকপাখিদের দেখে আসি। আনোয়ার কাকা কত পাখির গল্প বলে! বকের সাথে সারস, পানকৌড়ি, রাতচোরা, শামুকখোল এসব পাখি দেখায় আমাকে। সকালবেলা যখন বাঁশবনের মাথায় সাদা ধবধবে বকগুলো রোদ পোহায় বসে বসে, খুব ভালো লাগে দেখতে। সূর্যের আলো পড়ে বকের পাখাগুলো চকচক করে। সাদা কাশফুলের মতো দেখতে বকের পালকগুলো। বকেরা যখন সূর্যের আলোতে ডানা ঝাপ্টায়, কিংবা ছোট্ট ছানাদের মুখে খাবার তুলে দেয় দেখতে বড্ড ভালো লাগে। এসব দেখে দেখে আমার সকালগুলো খুব সুন্দর হয়ে ওঠে। 
মা মাঝে মাঝে গ্রামের মানুষদের সাথে নানা বিষয়ে মিটিং করে। ওদের সুবিধা-অসুবিধার কথা জানতে চায়। একদিন খাবার টেবিলে বসে বাবাকে মা বলছিল, পাখি শিকারিরা নাকি বকসহ অন্য পাখিদের খুব উত্যক্ত করছে। গ্রামের মানুষেরা মাকে জানিয়েছে। ওরা পাখিদের খুব ভালোবাসে, পাখিদের হত্যা করে না। বরং পাখির জন্য নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করে দেয়, খাবার দেয়। ওরা মাকে পাখিদের নিরাপত্তার জন্য সাহায্য করতে অনুরোধ করেছে। আমি শুনছিলাম এসব কথা। রাতে ঘুমানোর আগে আমিও মাকে অনুরোধ করলাম পাখিগুলোর জন্য কিছু করতে। কেউ যেন পাখিদের আর উত্যক্ত করতে না পারে। 
একদিন ছুটির দিন। গ্রামের কয়েকজন এসে মাকে জানালো, শীতের সময়ই নাকি পাখি শিকারিরা আসে। এ সময় সতর্ক থাকতে হয়। মা মন দিয়ে সবকিছু শুনল। তাদের আশ্বস্ত করল। 
কয়েক দিন পরের কথা। রাতে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম দিদার সাথে। তখন ভোর রাত। তখনো ভালো করে আলো ফোটেনি। আকাশ সামান্য পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। হঠাৎ গুলির আওয়াজ শোনা গেল। পরপর তিনটা। আর সাথে সাথেই শোরগোল। আমরা ধরমড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। দিদাও ভয় পেয়ে গেল। আমি ভয়ে মা-বাবাকে ডাকতে শুরু করলাম। শান্তারাম কাকা ছুটে এলো। এসেই বলল, মামণি, ভয় পাবে না। আজ একটা ফয়সালা হবে। তোমার মা গেছে পুলিশের টিম নিয়ে।
তার কথা শুনে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। সকাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। ভোরে মা-বাবা ফিরে এলো বাড়িতে। তাদের সাথে গ্রামের লোকজন। সবার আগে দেখতে পেলাম আনোয়ার কাকাকে। 
মা বলল, আজ সবাই এত সহযোগিতা করল বলেই পাখি শিকারিদের ধরা সম্ভব হয়েছে। সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ। 
আমি তো সব কথা শুনে অবাক। শান্তারাম কাকা জানাল, পাখি শিকারিরা বক, পানকৌড়ি শিকারের জন্য রেডি হচ্ছিল। এ খবর গ্রামের কয়েক জন আগে থেকে জানতে পেরে মাকে জানায়। মাও পুলিশের টিম নিয়ে আগে থেকেই তৈরি হয়ে থাকে। গ্রামবাসীরাও পাখিদের রক্ষার জন্য যার হাতে যা ছিল তা নিয়ে তৈরি ছিল। ওরা শিকারের জন্য একটা গুলি ছুড়তেই মায়ের টিম পরপর দুটো ফাঁকা গুলি ছোড়ে। তারপর গ্রামের লোকজন মোট সাতজন শিকারিকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে। অবস্থা বেগতিক দেখে শিকারিরা আত্মসমর্পণ করে। মায়ের টিম ওদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। 
এসব শুনে তো আমার আনন্দ আর ধরে না। আমি মাকে বললাম, মা আমাকে কেন নিয়ে গেলে না! 
আমার কথা শুনে আনোয়ার কাকা বলল, মামণি ছোটদের তো এ ধরনের অপারেশনে যেতে নেই। 
আমি ওদের সাথে যেতে পারিনি। কিন্তু সবার আনন্দ আজ আমার চোখে ধরা পড়ছে। যাক, শেষে পর্যন্ত দুষ্টু শিকারির দলকে ধরা গেল। আজ গ্রামবাসীদের মনে অনেক আনন্দ। বেশ অনেক বছর ধরেই শিকারিরা এ পাখিদের উত্যক্ত করছিল, হত্যা করছিল। আজ আমার মায়ের সহায়তায় শয়তানগুলো ধরা পড়েছে। গ্রামবাসীরা মাকে বার বার ধন্যবাদ দিচ্ছে, কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। তারা সত্যি পাখি ভালোবাসে। 
এখন ফুুলপুর গ্রামের প্রবেশমুখসহ নানা স্থানে সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে। তাতে লেখা ‘পাখি মারা নিষিদ্ধ’, ‘পাখিরাও বাঁচতে চায়’, ‘পাখিদের উত্যক্ত করবেন না’। পুরো গ্রাম জুড়ে এখন পাখিদের কলরব। শুধু আনোয়ার কাকার বাসা নয়, পুরো গ্রামই পাখিদের অভয়াশ্রম আজ। 
ফুলপুরের মানুষের খুব ভোরে ঘুম ভাঙে পাখির কলরবে। এখন কেউ আর পাখিদের উত্যক্ত করে না। দূর-দূরান্ত থেকে এ গ্রামে অনেকে পাখি দেখতে আসে। দেশের কত পত্রিকায় এ গ্রামের পাখিদের নিয়ে খবর ছাপা হয়! 
এখন আনোয়ার কাকার বাসায় গেলেই সে আগ্রহ ভরে সেই রাতের ঘটনা আমাদের কাছে বর্ণনা করে। কীভাবে সেসব পাখি শিকারি ধরা পড়ল, মা কীভাবে অত সাহস করে ওদের ধরল তা গর্ব করে বলতে থাকে কাকা। আর আমি দূর থেকে তাকিয়ে দেখি বাঁশবনের মাথায় সাদা বকগুলো নিশ্চিন্ত মনে ডানা

সোমা দেব: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, গবেষক, শিশুসাহিত্যিক ও লেখক।