লতা মঙ্গেশকর: এক নীরব আত্মা, সরস্বতী
অনলাইন ডেস্ক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১১:২৫ এএম, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রবিবার
লতা মঙ্গেশকর। সংগৃহিত ছবি।
লতা মঙ্গেশকর! ভারতের সর্বকালের সেরা এই গায়িকা নিজেকে লুকিয়ে রাখতেই ভালবাসতেন। পা অবধি লম্বা চুল! পা অবধি বিনুনি! হঠাৎ-ই কেউ দেখে ফেলতেন বাড়ি গেলে। খোঁপা, ঘোমটা, শাড়ি... আমিকে আগলে রাখার আত্মবিশ্বাস ছিল তাঁর মধ্যে। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “অমিতাভ বচ্চন বা সচিনকে কি চিৎকার করে বলতে হয় আমি অমিতাভ! আমি সচিন! আমায় দেখ!?”
বাবার নাটক লেখা, বাড়িতে গানের ক্লাস, লোকজন— এই সব দেখতে দেখতে তৈরি হয়েছেন লতা। প্রথম দিন স্কুলে গিয়েই অন্য বাচ্চাদের গান শিখিয়েছিলেন। সেই কারণে শিক্ষকের কাছে বকা খাওয়ায়, পরের দিন থেকে স্কুল যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি।
ইতিমধ্যে বাবার একটা নট্টকোম্পানি ছিল সেটা বন্ধ হয়ে যায়। তাঁরা চলে আসেন পুণেতে। বাবাই ছিলেন পরিবারের বটবৃক্ষ। হঠাৎ সেই বাবা চলে গেলেন। লতা মাত্র তেরো। আছে আশা, ঊষা, মিনা আর হৃদয়নাথ। পুরো পরিবারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে।
পয়সাও সংসারে দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ল। কাজে মনপ্রাণ বসিয়ে দিলেন লতা। নাহ্, শোক আগলে বসে থাকেননি। মাঠে নামলেন লড়াই করতে। সাহায্য পেলেন বিনায়ক দামোদর কর্নাটকির, যিনি ছিলেন ‘নবযুগ চিত্রপট’ ফিল্ম কোম্পানির মালিক।
১৯৪২-এ মরাঠি ছবি ‘কিতী হসাল’-এ প্রথম গান রেকর্ড করেন লতা। ১৯৪৫-এ ‘নবযুগ চিত্রপট’ মুম্বই পাড়ি দেয়। লতাজির প্রথম উপার্জন ছিল ২৫ টাকা। প্রথম বার মঞ্চে গাওয়ার জন্য লতা ওই ২৫ টাকা পান।
এ বার লতা আসছেন আরব সাগরের পাড়ে তাঁর সুরের আসন নিয়ে। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীত শিখতে আরম্ভ করেন উস্তাদ আমন আলি খানের কাছে। বিনায়কের মৃত্যুর পর গুলাম হায়দার লতার দায়িত্ব নেন। তিনি লতাকে আলাপ করিয়ে দেন প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। শশধর মুখোপাধ্যায় লতার গলার স্বর শুনে বলেছিলেন, ‘বড্ড সরু গলা’। কিন্তু হায়দার জানতেন, এমন এক দিন আসবে যখন সবাই এই লতার পায়ে পড়ে থাকবে গান রেকর্ডিং এর জন্য।
হায়দারের ‘মজবুর’ ছবিতে ১৯৪৮-এ গান রেকর্ড করেন লতা। এর পর আরও সুযোগ এলেও, তখনও সঙ্গে ছিল সমালোচনা। বলা হত নুরজাহানকে নকল করেন লতা। দিলীপ কুমার লতার উর্দু অ্যাকসেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তোলেন! লতা জানতেন সমালোচনা শুনতে। উর্দু শিখতে আরম্ভ করেন তিনি। অবশেষে ১৯৪৯-এ হিট হয় ‘আয়েগা আনেওয়ালা’। সেখান থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
পঞ্চাশের দশক থেকে আজ পর্যন্ত, বিশ্ব সংগীতের জমি লতার কণ্ঠকে জড়িয়ে আছে। অনিল বিশ্বাস থেকে শচীন দেববর্মণ, খৈয়াম, নৌসদ, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কল্যাণজি-আনন্দজি, রামচন্দ্রমের মতো অগুনতি পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন লতা।
ষাটের দশকে লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলালের ঘরানায় লতার সুরবিহার দেশ রাগ কালকে ছাপিয়ে নিজস্ব ঘরানা তৈরি করে। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সাতশো গান রেকর্ড করেন লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলালের সঙ্গে। শোনা যায় লতাকে বিষ দিয়ে মারার চেষ্টাও হয়েছিল। তিন মাস অসুস্থ ছিলেন তিনি।
নব্বইয়ের দশকে সিনেমার ক্যানভাস বদলালেও লতা রইলেন স্বমহিমায়। নদিম-শ্রবণ থেকে এ আর রহমান, তার আগে আর ডি বর্মণ— কেউ বাদ দেওয়ার স্পর্ধা দেখাননি লতাকে। প্রখ্যাত এই সঙ্গীতশিল্পীকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান অফিসার দে লা লিজিয়ঁ দ্য ’নর প্রদান করেছিল সে দেশের সরকার।
এক অখণ্ডধার রাগের আলাপ ধুন— এ সবের দেশ নেই। ভাষা নেই। তা বয়ে চলে কালের যাত্রায়। এই যাত্রার নাম লতা মঙ্গেশকর। নীরব আত্মার বিপ্লব। বিশ্ব সংগীতের সব জাতি তাঁর কাছে ঋণী। তিনিই পারেন শিল্প, দর্শন, চিত্রকলা, সিনেমা, নাটক, কবিতাকে তাঁর সুরে জাগিয়ে দিতে। এই ঋণ চুকিয়ে দেওয়ার নয়। যে সময়ে তিনি এসেছিলেন সেই সময়ের সমগ্র মানব সভ্যতা তাঁর ঋণ নত হয়ে স্বীকার করছে!
লতা মঙ্গেশকর। এক নীরব আত্মা। সরস্বতী। সরস্বতীর সৎকার হয় না!
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা