ঢাকা, শুক্রবার ২২, নভেম্বর ২০২৪ ২২:৪২:৩৮ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

গরীব দুঃখী মানুষে ভরসার জায়গা ডা. মানবেন্দ্র 

অনলাইন ডেস্ক

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০২:৪৬ পিএম, ১ মার্চ ২০২২ মঙ্গলবার

সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি

কুমিল্লা জেলার গরীব-দুঃখী মানুষের ভরসার জায়গা ডা. মানবেন্দ্র নাথ সরকার। যিনি সানন্দে রোগী দেখে মনে তৃপ্তি পান। তিনি রোজ যে কয়জন রোগী দেখেন তাদের বেশিরভাগের কাছ থেকেই টাকা নেন না। 
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার একটি গ্রাম রহিমপুর। গ্রামে আছে রহিমপুর অযাচক আশ্রম। সেখানে রোগী দেখেন চিকিৎসক মানবেন্দ্র নাথ সরকার। এ আশ্রমেই থাকেন, বাগান করেন, অনাথ-পিছিয়ে পড়া ছেলেদের গড়ে তোলার কাজ করেন। এক-দুই বছর ধরে নয়, তিন যুগের বেশি সময় ধরে এভাবে মানবসেবায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন তিনি। লোকে তাকে ডাকেন ‘যুগল ব্রহ্মচারী’ নামে।
কুমিল্লার মুরাদনগর রহিমপুর অযাচক আশ্রমটি  ১৯৩১ সালে শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপা নন্দ পরমহংস দেব আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৪ সালে এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেন মানবেন্দ্র। মানবেন্দ্র নাথ সরকার রহিমপুর অযাচক আশ্রমের অধ্যক্ষ। এরপর ৩৭ বছর ধরে তিনি এখানেই আছেন। 
মানবেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, আশ্রমে এসে বিনা মূল্যে রোগী দেখতে শুরু করি। অসহায় মানুষের জন্য কাজ শুরু করি। বাগান করি। কৃষিকাজ করি। দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করি। পিছিয়ে পড়া মানুষকে সামনে আনার চেষ্টা করি। এভাবেই তিন যুগের বেশি সময় পার করে ফেললাম।
সেকাল আর একালের চিকিৎসা সম্পর্কে চিকিৎসক মানবেন্দ্র বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশে চিকিৎসাসেবা শুরু হয়েছিল বিনা মূল্যে। চিকিৎসক এসে রোগী দেখতেন। তখনকার চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগীর ছিল আত্মার আর মনের সম্পর্ক। আমি ১৯৮৪ সালে দুই টাকা নিবন্ধন ফি নিয়ে রোগী দেখা শুরু করি। ১৯৯৫ সালে তা বেড়ে পাঁচ টাকা হয়। এখন ১০ টাকা করে নেওয়া হয়। ওই টাকা নেওয়া হয় জবাবদিহির জন্য। এখন প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী দেখি। আগে দেখতাম ৪০ থেকে ৫০ জন। সময় নিয়ে রোগী দেখার চেষ্টা করি। সমস্যার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমার বিশ্বাস, গ্রামের মানুষের কাছে আমাদের এ প্রজন্মের চিকিৎসকেরা ফিরে আসবেন। তাঁদের সেবা করবেন। রাষ্ট্র একজন চিকিৎসককে কেবল অর্থ উপার্জনের জন্য তৈরি করেনি, তৈরি করেছে মানবসেবা করার জন্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডা. মানবেন্দ্র নাথ সরকার সারাদিনে যতজন রোগী দেখেন, তার মধ্যে অধিকাংশই দেখেন বিনামূল্যে। তার ঘনিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি মাসে অন্তত ৩০০ জন রোগীই বিনামূল্যে দেখে থাকেন তিনি। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁর  এ অনুশীলন।
১০ বছর ধরে তাঁর চিকিৎসা নিয়ে আসছেন দাউদকান্দি উপজেলার মনির খন্দকার। তিনি বাসসকে বলেন, একজন ডাক্তারের যেসব গুণাবলী থাকা দরকার, অনেকের মধ্যেই তা পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে ডা. মানবেন্দ্র নাথ সরকার অনন্য। তিনি শুধু ডাক্তার হিসেবেই নয়, ব্যক্তি হিসেবেও অসাধারণ। জেলার দেবীদ্বার উপজেলার পুনরা গ্রামের রুমা আক্তার এসেছেন মানবেন্দ্রর কাছে। তিনি বলেন, আমার মাথায় সমস্যা। ওনারে দেখাতে আসলাম। তিনি অনেকক্ষণ ধরে রোগী দেখেন। টাকা লাগে না। 
বরুড়ার আড্ডা গ্রামের স্কুল শিক্ষক মোতাহের হোসেন বলেন, একজন শিক্ষক হিসেবে তাকে আমি স্যালুট জানাই। ওনি শুধু আমাকে বিনামূল্যে চিকিৎসাই দেন না, তাঁর কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের ওষুধও পেয়ে থাকি বিনা টাকায়। মুরাদনগর উপজেলার বাখরাবাদ গ্রামের মনির হোসেন ও হোসনেয়ারা বেগম এসেছেন তাঁর কাছে। তাঁরা বললেন, তাঁর (মানবেন্দ্র) কাছ এলে রোগ ভালো হয়ে যায়। ওষুধ নয়, ব্যবহারে। হোমনা উপজেলার মাইরচর গ্রামের রাবেয়া বেগম এসেছেন তাঁর ১৫ বছরের ছেলে জনিকে নিয়ে। বলছিলেন, ছেলেটার জ্বর। টাকা নাই। তাই গরীবের ডাক্তার যুগল ব্রহ্মচারীর (মানবেন্দ্র) কাছে এসেছি। কেবল কুমিল্লা নয়, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী ও চাঁদপুর থেকে অনেক রোগী আসেন তাঁর কাছে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত রোগী দেখেন।
জানা গেছে, গ্রামের গরীব অসহায় মানুষের টাকার অভাবে চিকিৎসা না পাওয়া ও তাঁদের দুঃখ-দুর্দশা দেখে বড় হয়েছেন ডা. মানবেন্দ্র নাথ সরকার। বিষয়টা তাঁকে খুবই পীড়া দিতো। এজন্যই মূলত তাঁর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন জাগে। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে হয়ে উঠেন দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের ভরসাস্থল। কুমিল্লার মুরাদনগরের এ চিকিৎসক গত তিন যুগ ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সেবা দিয়েছেন।
কুমিল্লার জেলার মুরাদনগর উপজেলার মোচাগড়া গ্রামে ১৯৫৫ সালের ১০ জানুয়ারী  জন্মগ্রহণ করেন মানবেন্দ্র নাথ সরকার। তাঁর বাবার নাম সুধীর রঞ্জন সরকার ও মায়ের নাম রেণু বালা সরকার। তিনি ১৯৬৪ সালে মাকে হারান । ১৯৭১ সালে তাঁর বাবাকে মোচাগড়া গ্রাম থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে হত্যা করে। দুই ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে মানবেন্দ্র দ্বিতীয়।
কীভাবে এমন জীবনে জড়িয়ে গেলেন, সেই গল্প করতে গিয়ে মানবেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, আমি তখন কিশোর। এক পূর্ণিমার রাতে বাবা আমাকে নিয়ে ঘরের বাইরে গেলেন। বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে পরম মমতায় বাবা বললেন বড় হয়ে মানুষের জন্য কাজ করবে। বাবার ওই কথা মনের মধ্যে গেঁথে যায়। স্বপ্ন দেখি চিকিৎসক হওয়ার। ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করি। এরপর একটি প্রতিষ্ঠানে দেড় বছর কাজ করি। সেখানে কিছু ভালো লাগত না। গ্রামে ফিরে আসি। শুরু হয় রহিমপুর অযাচক আশ্রমের জীবন।
রোগী দেখার পাশাপাশি মানবেন্দ্র নাথ সরকার আশ্রম প্রাঙ্গণে নার্সারি করেছেন। নাম দিয়েছেন ‘স্বাবলম্বী নার্সারি’। ২০০০ সাল থেকে তিনি আশ্রমে মোমবাতি ও আগরবাতির কারখানা করেন। এখন মোমবাতির কারখানা বন্ধ। তবে আগরবাতির কারখানা চালু আছে। এর মাধ্যমে আশপাশের অন্তত ৫০টি পরিবার আর্থিকভাবে লাভবান হয়। অসহায় নারী, বৃদ্ধা ও অনাথদের জন্য তিনি উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামের সাত একর জায়গা নিয়ে বিপন্ন মাতৃসদন ও অনাথ আশ্রম বানিয়েছেন। এ ছাড়া খাগড়াছড়িতে ছোট ছোট অন্তত সাতটি স্কুল করেছেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়।
জেলার মুরাদনগর উপজেলা চেয়ারম্যান আহসানুল আলম সরকার কিশোর বাসসকে বলেন, ব্যক্তি হিসেবে ডাক্তার মানবেন্দ্র নাথ সরকার চমৎকার একজন মানুষ। প্রচুর গরীব-অসহায় রোগী তার কাছে আসে এবং বিনামূল্যে চিকিৎসা নেয়। অন্যান্য ডাক্তাররা যেখানে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, সেখানে তিনি গরব ী অসহায়দের নিরবে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
মানবেন্দ্রর মানবসেবা নিয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, তিনি সত্যিকারের মানবহিতৈষী, নিভৃতচারী কর্মবীর। কর্মবীর মানবেন্দ্র স্বপ্ন দেখেন, যত দিন তিনি বেঁচে থাকবেন, তত দিন মানুষের সেবায় কাজ করে যাবেন।
কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন মোবারক হোসেন  জানান, ব্যক্তিগতভাবে তিনি একজন সৎ মানুষ। তার মত প্রত্যেক ডাক্তারেরই সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করা উচিত।