ঢাকা, শুক্রবার ২২, নভেম্বর ২০২৪ ২৩:১৪:৪৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী

(ভূমিকা: পিটার হুদিস এবং কেভিন বি. এন্ডারসন)  

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৫:০৮ পিএম, ১৬ মার্চ ২০২২ বুধবার

রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী

রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী

ভূমিকা/ পর্ব-৩: সে বছরের মার্চ মাসে ‘ফোর্ভার্টস পত্রিকা, অর্থাৎ এসপিডির মুখ্য পত্রিকা, গণ ধর্মঘট বিষয়ে রোজার নিবন্ধ ছাপতে অস্বীকৃতি জানালো। কারণ হিসেবে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ জানান যে আপাতত: কিছুদিনের জন্য পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলী এই বিষয়ে কোন আলোচনা প্রকাশ করবে না। রোজা তখন নিবন্ধটি ‘নিউ জিট’ পত্রিকায় পাঠান যা কাউতস্কি সম্পাদনা করতেন। কাউতস্কিও প্রবন্ধটি ছাপতে অসম্মত হন। অসম্মতির কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে ‘রাজতন্ত্রে’র পরিবর্তে ‘গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য রোজার আহ্বান ছিল ‘অসমীচীন।‘ সংসদীয় শক্তি ফিরে পেতে কাউতস্কি অন্য যে কারো মতই এতটাই দৃঢ়চেতা ছিলেন যে দলের বিপ্লবী সব দাবিদাওয়ার কণ্ঠস্বর রোধ করে দিতে চাইতেন। লুক্সেমবার্গ তাই এবার প্রকাশ্যে প্রত্যাঘাত করলেন আর কাউতস্কিকে ‘সুবিধাবাদীতা’র দোষে দোষী করলেন। সংশোধনবাদ, রোজা এই যুক্তি তুললেন যে, শুধুই এসপিডির সংশোধনবাদী অংশের নেতা-কর্মীদের নয়, বরং পার্টির সবচেয়ে ‘প্রথাগত’ মুখপাত্রদের (অর্থাৎ অতীতে যারা প্রগতিবাদী ছিলেন) পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে তুলেছে। কাউতস্কি যখন ‘স্বর্গে ঝড় তোলা তত্ত্ব’ লিখছেন, রোজা তখন যুক্তি দেন যে কাউতস্কি সংসদীয়বাদে সবচেয়ে বস্তা-পচা বিষয়াদি আমদানি করছেন।

সত্যি বলতে ‘তত্ত্ব এবং প্রয়োগ (থিওরি এ্যান্ড প্র্যাক্টিস)’-এ   রোজার করা কাউতস্কির সমালোচনা এমনকি রোজারই রচিত ‘রিফর্ম অর রেভল্যুশন’-এ করা বার্ণস্টেইনের সমালোচনার চেয়েও নানা দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ।   অন্যদিকে কাউতস্কি বিপ্লবী মার্ক্সবাদের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করে যেতে থাকেন। যদিও কিনা পার্টির জন্য সংশোধনবাদী পথই তিনি বেছে নিয়েছিলেন। ১৯১০ সালে রোজা লুক্সেমবার্গ কাউতস্কির সমালোচনা করার সময় অচিরেই যে এসপিডি সমাজতন্ত্রের পথ পরিহার করে বামপন্থার সাথে প্রতারণা করবে, তার আগাম রূপরেখা আঁকেন যা ১৯১৪ সালে সত্য হয়ে দেখা দেয়। ১৯১০ সালে কেউই অবশ্য বোঝেননি যে এর প্রভাব কি হতে পারে। অনেকেই তখন রোজা ও কাউতস্কির এ পার্থক্যকে ‘ব্যক্তিগত’ পার্থক্য হিসেবে দেখান। বিপদের বোঝা আরো বাড়ে যখন রোজা উচ্চ পর্যায়ের এসপিডি নেতাদের কাছ থেকে বৈরিতা অর্জন করেন এবং নেতারা যখন তাদের ব্যক্তিগত, সব পুরুষের আড্ডায় তাঁকে নিয়ে কথা বলতেন, তখন লিঙ্গবাদী নানা গালি-গালাজে পরিপূর্ণ থাকত তাদের রোজা সম্পর্কিত বয়ান। ১৯১০-এর ১০ই আগস্ট তারিখে বেবেলকে লেখা একটি চিঠিতে কাউতস্কি বলেন, ‘মেয়েদের নিয়ে এই এক মুষ্কিল। তাদের পক্ষপাত বা আবেগ বা অহঙ্কারকে কোথাও যদি এতটুকু প্রশ্ন করা হয় এবং যথেষ্ট পরিমাণ বিবেচনা করা না হয়, তবে তাদের ভেতরের সবচেয়ে বুদ্ধিমতীরাও কি যে ভয়ানক চটে যায়! তারা অবিশ্বাস্য রকম শত্রুতা করতে থাকে। প্রেম এবং ঘৃণা পাশাপাশি থাকে; তাদের নেই কোন নিয়ন্ত্রণকারী যুক্তি ক্ষমতা।’ 

বেবেল, ‘নারী ও সমাজতন্ত্র (ওম্যান এ্যান্ড সোশ্যালিজম)’ নামক হ্যান্ডবুক রচনার জন্য যিনি রাতারাতি নারীবাদী হিসেবে জন পরিসরে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন, এই বইটিতে লুক্সেমবার্গ ও জেটকিন উভয়ের কথাই বলেছেন- জেটকিন যিনি কিনা রোজার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। এমনকি স্বয়ং লেনিন লুক্সেমবার্গ-কাউতস্কি বিতর্কের সময় দূরে সরে ছিলেন।   তবে, কাউতস্কির ডান দিকে মোড় নেয়াটা লুক্সেমবার্গের জন্য সবসময়ই একটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয় ছিল: স্বল্প-মেয়াদী নির্বাচনী লাভের জন্য সা¤্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান নিতে এসপিডি ক্রমাগত অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল। গোটা বিষয়টি ১৯১১-এর গ্রীষ্মে রোজার কাছে আরো পরিষ্কার হয়ে ওঠে যখন তিনি কাউতস্কিতে তীব্র ভাবে ভৎর্সনা করেন এবং সেই সাথে মরক্কোয় জার্মান ঔপনিবেশিক পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ গড়ে না তোলার জন্য এসপিডি নেতৃত্বকেও সমালোচনা করেন। রোজা স্পষ্ট দেখতে পেলেন যে এসপিডি নেতৃত্বের এই ভীরুতা যেন পুঁজিবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক বোঝা ও তার বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে প্রতিষ্ঠিত মার্ক্সবাদেরই একটি ব্যর্থতা।

সত্যি বলতে, যে মূহুর্ত থেকে মার্ক্সবাদী আন্দোলনে লুক্সেমবার্গ যোগ দিয়েছিলেন, সেই মূহুর্ত থেকেই একজন অত্যন্ত নীতি-নিষ্ঠ আন্তর্জাতিকতাবাদী হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি ‘সা¤্রাজ্যবাদ’ শব্দটি যথাযথ ভাবে উদ্ভাবন হবার পূর্বেই, সেই ১৮৯৯ সালে তিনি লেখেন:

 ১৮৯৫ সালে, (বিশ্ব রাজনীতিতে) একটি মৌলিক পরিবর্তন ঘটলো: জাপানের যুদ্ধ চীণের দরজা খুলে দিল এবং ইউরোপীয় রাজনীতি, পুঁজিবাদী এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থ দ্বারা তাড়িত হয়ে, এশিয়ায় অনুপ্রবেশ করলো...তখন থেকেই আফ্রিকায় ইউরোপীয় স্বার্থের বিরোধিতা পেল নতুন আবেগের স্পর্শ; সেখানেও আজ নতুন শক্তিতে সংগ্রাম মূর্ত হয়ে উঠছে (ফাশোদা, দেলেগোয়া, মাদাগাস্কার)। এটা পরিষ্কার যে এশিয়া ও আফ্রিকা ভূখন্ডের খন্ড খন্ড নানা ভাগে বিভাজন সেই শেষ সীমারেখা যার ওপারে ইউরোপীয় রাজনীতির নিজেকে আর নতুন করে কিছু উন্মোচনের নেই। এর পরেই প্রাচ্যদেশ প্রশ্নে আসে একই রকমের বিভঙ্গ এবং ইউরোপীয় শক্তিসমূহের তখন একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া  ছাড়া  আর কোন উপায়ই রইবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত রাজনীতির ভেতরে চূড়ান্ত সঙ্কট থিতু হয়। 

সা¤্রাজ্যবাদকে সামগ্রিক ভাবে আক্রমণ করা ছাড়াও, পরবর্তী বছরগুলোয় লুক্সেমবার্গ আজকের যে নামিবিয়া সেই অঞ্চল থেকে নামা এবং হেরেরো জনগোষ্ঠিকে উচ্ছেদ করার জন্য জার্মান উপনিবেশবাদের প্রচেষ্টার সক্রিয় বিরোধিতা করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে ‘আফ্রিকার নিগ্রোরা যাদের শরীর ইউরোপীয়দের কাছে ধরার জন্য একটি খেলা বিশেষ, তারা আমার ততটাই নিকটবর্তী যতটা নিকটবর্তী আমার কাছে ‘ইহুদিদের যন্ত্রণা।’ 

১৯০৭ সালে, এসপিডি যখন রোজাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বার্লিনে পার্টির স্কুলে শিক্ষকতা করার জন্য, সেই তখন থেকেই বস্তত: সা¤্রাজ্যবাদের প্রভাব বিষয়ে তাত্ত্বিক বিশেষণের একটি সুযোগ রোজা পেয়েছিলেন। অর্থনৈতিক তত্ত্ব এবং ইতিহাস বিষয়ে তাঁর বক্তৃতামালার সাথে যোগসূত্র রেখেই রোজা একটি গ্রন্থ ‘ইন্ট্রোডাকশন টু পলিটিক্যাল ইকোনমি’ রচনা শুরু করেন। তবে বইটি তাঁর মৃত্যু অবধি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। রোজার জীবনী প্রণেতা পল ফ্রলিখ রোজার চিঠি-পত্রের উপর নির্ভর করে জানাচ্ছেন:

 

আমরা গোটা কাজের একটি সাধারণ পরিকল্পনা ছকে নিচ্ছি যা নিচের অধ্যায়গুলো অন্তর্ভুক্ত করেছে:

 

১.               অর্থনীতি কি?

২.               সামাজিক শ্রম।

৩.              অর্থনৈতিক-ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত: আদিম সাম্যবাদী সমাজ।

৪.               অর্থনৈতিক-ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত: সামন্তবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।

৫.               অর্থনৈতিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত: মধ্যযুগের শহর এবং কারুশিল্পী বণিক সঙ্ঘ ।

৬.              পণ্য উৎপাদন।

৭.               মজুরি-শ্রম।

৮.               পুঁজির মুনাফা।

৯.               সঙ্কট।

১০.             পুঁজিবাদী বিকাশের প্রবণতাসমূহ।

 

১৯১৬ সালের গ্রীষ্মে প্রথম দুই অধ্যায় মুদ্রিত হবার জন্য প্রস্তত হয়ে গেছিল এবং অন্যান্য অধ্যায়গুলো ইতোমধ্যে খসড়া হয়ে গেছে। যাহোক, রোজার রচনাবলীর ভেতর এই বইয়ের ১,৩,৬, ৭ এবং ১০ম অধ্যায় আর খুঁজে পাওয়া যায় না। 

উপরোক্ত বইটির যতটুকু রয়ে গেছে বা খুঁজে পাওয়া যায়, তার যতটুকু ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে, তা’ প্রায় ২৫০ মুদ্রিত পৃষ্ঠার মত হবে।  ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি’ বা রাজনৈতিক অর্থনীতির একটি প্রমিত ভূমিকার থেকে ঢের বেশি দূরে গিয়ে এই খুঁজে পাওয়া পৃষ্ঠাগুলোর অর্দ্ধেকই (যা জার্মান এবং ফরাসীতে প্রকাশিত হয়েছে),শুধুই আদি এবং বর্তমান পুঁজিবাদের আলোচনা নয়, বরং প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজের বৈচিত্র্যময় নানা গোষ্ঠিতে ‘আদিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা’ নিয়েও তিনি আলোকপাত করেছেন। সেই আলোকপাত করতে গিয়ে রোজা শুধুই প্রাচীন গ্রীস বা আদি জার্মান গোত্রগুলোর কথাই বিধৃত করেননি, বরঞ্চ অ-পশ্চিমা সমাজের এক বিপুল বৈচিত্র্যের দিকও আলোচনা করেছেন, যাদের কিছু আজো আছে আবার অনেকে আবার লুপ্ত প্রায়। রোজার আপন জীবদ্দশাতেই রুশ মির (গ্রাম্য সম্প্রদায়), ভারতের সনাতনী পল্লী সমাজ, দক্ষিণ কেন্দ্রীয় আফ্রিকার লুন্ডাসা রাজ্য, আফ্রিকার কাবিলগণ এবং অস্ট্রেলিয়ার এ্যাবোরোজিন বা আদিবাসীরা, আমাজনের বোরোরো এবং ইনকা রাজ্যের শেষাবস্থা তিনি দেখতে পেয়েছেন। কাজের এই জায়গাটুকুর সম্পর্কে বলতে গিয়ে মিশেল লোওয়ি লেখেন, ‘রুশ ইতিহাসবিদ মাক্সিম কোভালেভস্কির কাজের উপর নির্ভর করতে গিয়ে আমরা (যে কাজে খোদ মার্ক্সেরও বিপুল আগ্রহ ছিল), রোজা কৃষিজীবী সম্প্রদায়গুলোর সর্বজনীননতাকে মানব সভ্যতার বিকাশের একটি বিশেষ পর্যায়ে গোটা মানব সম্প্রদায়ের একটি সাধারণ আঙ্গিক বা রূপ হিসেবে চিহ্নিত করার উপরে জোর দেন, যা যে কেউ আমেরিকান ইন্ডিয়ান, ইনকা এবং আফ্রিকান গোত্র কাবিলসদের ভেতর এবং হিন্দুদের ভেতর দেখতে পাবে। পেরুর সভ্যতা এ প্রসঙ্গে তাঁর কাছে যেমন বিশেষ গুরুত্ববহ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।     

প্রাক-পুঁজিবাদী সম্প্রদায়গুলোর গঠন কেন ভেঙ্গে গেল তার বাহ্যিক এবং অন্ত:স্থিত কারণগুলো বোঝার চেষ্টা করছিলেন রোজা। প্রাক-পুঁজিবাদী এই জনসম্প্রদায়গুলোর সংগঠনের ‘পশ্চাৎপদতা’র দিকে জোর দেবার চেয়ে তিনি বরং তাদের ‘অসাধারণ স্থৈর্য্য এবং স্থিতিশীলতা...(তাদের) স্থিতিস্থাপকতা  এবং অভিযোজনক্ষমতা’-র উপর গুরুত্ব দেন। ‘উৎপাদনের হাতিয়ারের সাম্যবাদী মালিকানা,’ তিনি লেখেন, ‘একটি কঠোর ভাবে সংহত ও সংগঠিত অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে চমৎকার যোগান দেয়, সবচেয়ে উৎপাদনশীল সামাজিক শ্রম প্রক্রিয়ার এবং বহু যুগের জন্য এর ধারাবাহিকতা এবং বিকাশের আশ্বাস নিশ্চিত করে।ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বের অবশিষ্ট আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর যত জনসংগঠন তা’ সবই ধ্বংস করেছিল।

আদিম সামাজিক সম্পর্কগুলোর জন্য সর্ব অর্থেই ইউরোপীয় সভ্যতার অনুপ্রবেশ ছিল একটি বিপর্যয়। ইউরোপীয় বিজয়ীরাই প্রথম যারা অধিকৃত, বিজিত জনতাকে বশ্যতা স্বীকার করিয়ে এবং অর্থনৈতিক শোষণ করেই ক্ষান্ত হয় নি, বরং অধিকৃত জনতার পায়ের নিচ থেকে মাটি কেড়ে নিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছে তার উৎপাদনের উপকরণও। এভাবেই ইউরোপীয় পুঁজিবাদ আদিবাসী জনসংগঠনকে তার আদিম সামাজিক ব্যবস্থার শৃঙ্খলা থেকে বঞ্চিত করে। নতুন যা দেখা দেয় তা’ যাবতীয় নিপীড়ন এবং বঞ্চণার থেকেও মন্দতর কিছু। পুরোটাই নৈরাজ্য এবং বিশেষত: ইউরোপীয় এক প্রপঞ্চ, সামাজিক অস্তিত্বেও অনিশ্চয়তা। পরাজিত, বশ স্বীকার করানো এই জনতা, তাদের সনাতনী উৎপাদনের উপকরণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, ইউরোপীয় পুঁজিবাদের চোখে হয়ে ওঠে নিছকই মজুর, এবং মজুর হবার দৈহিক যোগ্যতা যতদিন তাদের থাকে, ততদিন তাদের ক্রিতদাস বানানো হয় এবং যখন সে যোগ্যতা ফুরিয়ে যায়, তখন তাদের হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করা হয়। এই পদ্ধতির ব্যবহার আমরা দেখেছি স্প্যানিশ, ইংরেজি এবং ফরাসী উপনিবেশগুলোয়। পুঁজিবাদের জয়যাত্রার আগে, আদি সামাজিক ব্যবস্থা, যা অতীতের অন্য যত ঐতিহাসিক পর্বের চেয়ে বেশিদিন স্থায়ী হয়েছিল, তা’ আর বেশিদিন চলতে পারে না- পুঁজিবাদের কাছে তা’  আত্ম-সমর্পণ করে। আদিম সেসব সমাজের শেষ অবশিষ্টসমূহও পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে এবং এর হাতিয়ার- শ্রম শক্তি ও উৎপাদনের উপকরণসমূহ-সবকিছুই পুঁজিবাদের দ্বারা শোষিত হয়।   

রোজার সময়ের খুব কম মার্ক্সিস্টই অ-পুঁজিবাদী সামাজিক সম্পর্কগুলো কিভাবে পশ্চিমা সভ্যতার কারণে ধ্বংস হয়ে যায় সে বিষয়ে রোজার মত উদ্বেগাকুল ছিলেন বা রোজার মত সম্যক ধারণা রাখতেন এসব বিষয়ে। এই সঙ্কলণটিতে তাই প্রথমবারের মত আমরা ইংরেজিতে প্রকাশ করছি প্রাক-পুঁজিবাদী সম্প্রদায়গুলোর প্রকৃতি বিষয়ে রোজার আলোচনা যেখানে তিনি বিশেষ করে সম্প্রদায়গুলোর গঠন  ভেঙ্গে যাওয়ার উপর জোর দিয়েছেন। প্রাক-পুঁজিবাদী এই সভ্যতাগুলোয় জনসম্প্রদায় সমূহের নিজস্ব গঠন ভেঙ্গে যাবার জন্য তিনি অভ্যন্তরীণ কারণসমূহ যেমন জনসম্প্রদায়গুলোর ক্রমবর্দ্ধমান সামাজিক পৃথকীকরণ এবং বর্তমান, আধুনিক সময়ে- ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের বহি:স্থ প্রভাব- এই উভয়বিধ কারণকেই দায়ি করেছেন।

সেসময়ে লুক্সেমবার্গ সহ কেউই প্রাক-পুঁজিবাদী সম্প্রদায়গত গঠনসমূহ সম্পর্কে কার্ল মার্ক্সের নিজস্ব পঠন-পাঠনের পরিধি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। ১৯৩৯-এর আগ পর্যন্ত ‘গ্র্যান্ড রিস (Grundrisse)’ প্রকাশিত হয়নি। মার্ক্সের এই বইটিতে ‘প্রাক-পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক গঠন’ সম্পর্কে বর্তমানে বিখ্যাত অধ্যায়টি ছিল। রাশিয়া, ভারত, জাভা, উত্তর আফ্রিকা, অস্ট্রেলীয় আদিবাসী এবং রেড ইন্ডিয়ানদের সম্পর্কে মার্ক্সের বিস্তর লেখা-পত্র ১৯৭০ সালের আগে পর্যন্ত প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়নি, এবং অদ্যাবধি এবিষয়ক মার্ক্সের অনেক লেখা অপ্রকাশিত। পার্টি স্কুলে বক্তৃতা দেবার জন্য লুক্সেমবার্গ নিজের আগ্রহে এসব বিষয়ে গবেষণা উপকরণ খোঁজার সময় মার্ক্সের এসব অপ্রকাশিত রচনা কিছু পড়েন। তবে এবিষয়ে মার্ক্সের লেখা হাজার হাজার পাতা তাঁর কাছে অজানাই থেকে গেছিল। তবে, মার্ক্স এসব বিষয়ে যাদের লেখা পড়েছেন, সেসব বিষয়ে লুক্সেমবার্গও পড়েছেন। যেমন, রুশ সমাজতত্ত্ববিদ মাক্সিম কোভালেস্কি, বৃটিশ নৃ-বিজ্ঞানী হেনরি হামার মেইনে এবং মার্কিনী নৃ-তত্ত্ববিদ ল্যুইস হেনরি মর্গ্যান।
(চলবে)