ঢাকা, শুক্রবার ২২, নভেম্বর ২০২৪ ২৩:০৩:০১ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী

(ভূমিকা: পিটার হুদিস এবং কেভিন বি. এন্ডারসন) 

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১১:৩৪ পিএম, ২৩ মার্চ ২০২২ বুধবার

রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী

রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী

ভূমিকা/পর্ব- ৪: নিজের বক্তৃতা গুছিয়ে নেবার জন্য পড়াশুনা বা গবেষণা করার নিমিত্তে রোজা প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজের বিষয়ে আরো বেশ কিছু লেখা লেখেন। এই রচনাগুলো এবং সংশ্লিষ্ট আরো বেশ কিছু রচনা আলোয় এসেছে মাত্র কিছু দিন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর। তার আগে কম্যুনিস্ট পার্টি আর্কাইভের সংরক্ষিত ছিল এসব রচনা। রোজার লেখা এসব রচনার একটি ১৯০৭ সালের কিছু পরে লেখা গ্রিক এবং রোমক দাসত্বের উপর। গ্রিসের দাসত্বের উপর লেখা এই রচনাটি প্রথম আমাদের এই সঙ্কলণে ইংরেজিতে প্রকাশিত হলো। লুক্সেমবার্গ গবেষক নারিহিকো ইতো প্রথম এই লেখাটি ২০০২ সালে প্রকাশ করেন। ইতো বলেন, লুক্সেমবার্গ এই রচনায় ‘এঙ্গেলসকে সমালোচনা’ করেছেন; দাস ব্যবস্থার উদ্ভবের কারণ হিসেবে এঙ্গেলস ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবকে দায়ি করেছেন কিন্তÍ রোজা তাঁর এই রচনায় দাসত্বের বিকাশের একটি তুলনামূলক কম একরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করেছেন ।
১৯০৭ থেকে ১৯১৪ সাল ইতিহাস ও তত্ত্বের একত্রে করা লুলুক্সেমবার্গের গবেষণা জন্ম দিয়েছে তাঁর মহত্ত্বম তাত্ত্বিক কাজ- ‘পুঁজির সঞ্চয়: সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যখ্যার অবদান (দ্য এ্যাকুমুলেশন অফ ক্যাপিট্যাল: আ কন্ট্রিবিউশন টু দ্য ইকোনোমিক এক্সপ্ল্যানেশন অফ ইম্পেরিয়ালিজম)।’   রোজার মত ছিল এই যে কোন মার্ক্সবাদীই, এমনকি খোদ মার্ক্স নিজেও, সাম্রাজ্যবাদী বিস্তারের অন্তর্নিহিত প্রণোদনা এবং প্রয়োজনকে পর্যাপ্তভাবে ব্যখ্যা করেননি। ‘এ্যাকুমুলেশন অফ ক্যাপিট্যাল’ বা ‘পুঁজির সঞ্চয়ে’ রোজা এই যুক্তি প্রদর্শন করেন যে ‘উৎপাদক শক্তিগুলোর অপরিসীম প্রসারণ ক্ষমতা’ এবং ‘সামাজিক খরচের সীমিত প্রসারণ ক্ষমতা’র ভেতরেই নিহিত রয়েছে পুঁজিবাদের মৌলিক বিরোধ। যেহেতু উদ্বৃত্ত মূল্যের নিষ্কাশন ক্ষমতার উপর পুঁজিবাদী উৎপাদন নির্ভরশীল, সেহেতু উদ্বৃত্ত পণ্য ‘কিনে নেয়া’র জন্য মজুরি হিসেবে যথেষ্ট মূল্য পাওয়া শ্রমিকদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়; একই কথা পুঁজিপতিদের ক্ষেত্রেও সত্য যাদের কিনা বর্দ্ধিত পুঁজি সঞ্চয়ের জন্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উদ্বৃত্ত-মূল্যের আরো বড় পরিমাণ অংশ বিনিয়োগ করতে হয়। একই পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক এবং পুঁজিপতিদের পক্ষে উদ্বৃত্ত মূল্যের আয়তন সমভাবে আদায় করা একরকম অসম্ভব বিষয়, রোজা বলেন। তাহলে পুঁজিবাদ কিভাবে উদ্বৃত্ত মূল্য আদায় করে এবং নিরন্তর পুঁজি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করতে পারে? উত্তরে রোজা এই যুক্তি দেন যে উদ্বৃত্ত উৎপাদন বিক্রির জন্য ক্রেতাদের একটি স্তর অবশ্যই পেতে হবে পুঁজিবাদী সমাজের বাইরে, প্রাক-পুঁজিবাদী পৃথিবী থেকে: ‘নিষ্পত্তিমূলক ঘটনা এটাই যে উদ্বৃত্ত মূল্য শ্রমিক বা পুঁজিপতিদের কাছে বিক্রি করে আদায় করা যায় না, বরং উদ্বৃত্ত মূল্য শুধুমাত্র তখনি আদায় করা সম্ভব যখন উদ্বৃত্ত উৎপাদন এমন সব সামাজিক সংগঠন অথবা স্তরের কাছে বিক্রি করা যায় যাদের নিজেদের উৎপাদন পদ্ধতি পুঁজিবাদী নয়।’  এই দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে সাম্রাজ্যবাদ এবং প্রাক-পুঁজিবাদী সম্প্রদায়গুলোর গঠন পুঁজিবাদের কোন দূর্ঘটনামূলক বৈশিষ্ট্য নয় বরং তা’ পুঁজিবাদের বলতে গেলে জৈব প্রকৃতির মত কিছু একটা:

‘একদম সূচনা থেকেই, পুঁজিবাদী উৎপাদনের আঙ্গিক এবং আইনগুলো গোটা বিশ্বকেই উৎপাদন শক্তিসমূহের একটি গুদামঘর হিসেবে গঠনের লক্ষ্যাভিমুখী। পুঁজি, শোষণের জন্য উৎপাদক শক্তিসমূহকে যথাযথ ব্যবহারের জন্য যা তাড়িত, লুট করে সারা পৃথিবী, উৎপাদনের হাতিয়ারসমূহ সংগ্রহ করে পৃথিবীর সব কোণা থেকে, দরকার হলে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সারা বিশ্ব থেকে উৎপাদনের হাতিয়ারগুলো সংগ্রহ করে, সংগ্রহ করে সভ্যতার সকল স্তর থেকে এবং সব ধরণের সমাজ থেকে... পুঁজির জন্য গোটা বিশ্বের সবখানেই তার কার্যক্রমের মাধ্যমে এটা মীমাংসা করা দরকার হয়ে পড়ে, দরকার হয়ে পড়ে গুণগত ও পরিমাণগত- উভয় নিরিখেই উৎপাদনের হাতিয়ারের অপরিসীম পছন্দ অর্জন করা, যাতে করে আদায় করে নেয়া উদ্বৃত্ত মূল্যের জন্য উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান খুঁজে পাওয়া যায়।’  

লুক্সেমবার্গের এই দৃষ্টিভঙ্গি খোদ মার্ক্সের পুঁজি সঞ্চয় তত্ত্বের প্রতি (বিশেষত: ‘পুঁজি’র দ্বিতীয় খন্ডে সম্প্রসারিত পুনরুৎপাদনের নক্সায় মার্ক্স যেভাবে পুঁজি সঞ্চয়ের বিষয়টি ব্যখ্যা করেছেন তার প্রতি) চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। মার্ক্স সেখানে, সরলতার স্বার্থেই, শুধুমাত্র শ্রমিক এবং পুঁজিপতি দিয়ে গড়া একটি একক পুঁজিবাদী সমাজের কথা ভেবেছেন যেখানে বৈদেশিক বাণিজ্যের বিষয়টি ভাবাই হয়নি। এই অনুমান মূলত: মার্ক্সের এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নি:সরিত হয়েছিল যে উদ্বৃত্ত মূল্যের আয়তন ব্যক্তিগত ভোগ বা খরচ দিয়ে আদায় হয় না, বরঞ্চ ‘অব্যাহত/ধ্রুব/স্থিতিশীল পুঁজি’ দ্বারা আদায় হয়, বিশেষত: যন্ত্রপাতির আকারে এটি আদায় হয়ে থাকে। তাঁর প্রতিপাদ্য ছিল এটাই যে পুঁজি সঞ্চয়ের জন্য নির্দিষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্যের সমগ্রতার আর্থিক আকারে সমপরিমাণ কিছু উৎপাদের দরকার নেই; মার্ক্স ধরে নিয়েছিলেন যে উদ্বৃত্ত মূল্যের অনেকটাই সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে আদায় করা সম্ভব, টাকার অঙ্কে রূপ না নিয়ে এবং জীবন্ত মানুষের দ্বারা ভোগ হয়েই উদ্বৃত্ত মূল্যের প্রত্যক্ষ এই আদায় সম্ভব।

লুক্সেমবার্গ কড়া ভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেন; তিনি এই যুক্তি দেখান যে সম্প্রসারিত উৎপাদনের উপর মার্ক্সের নক্সাগুলোয় এটাই উহ্য যে অসঙ্গতি বা উদ্দেশ্যগত সঙ্কট ব্যতিরেকেই পুঁজির সঞ্চয় সম্ভব হতে পারে। রোজার কাছে এই দৃষ্টিভঙ্গি গভীর পীড়াদায়ক মনে হয় যেহেতু মার্ক্সের উপরোল্লিখিত দৃষ্টিভঙ্গি রোজার কাছে এটাই জ্ঞাপন করে যে সম্প্রসারিত পুঁজির তত্ত্ব পুঁজিবাদের অপ্রতিরোধ্য ধস বা বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে দায়ি হতে ব্যর্থ হয়। কাজেই তিনি এই যুক্তি দেন যে একটি বদ্ধ পুঁজিবাদী সমাজকে শুধুই শ্রমিক এবং পুঁজিপতি দ্বারা গঠিত বলে অনুমান করে মার্ক্স একটি মৌলিক ভুল করেছেন।
তবে রোজার ‘দ্য এ্যাকুমুলেশন অফ ক্যাপিটাল’-এ  মার্ক্সের সমালোচনা করার জন্য ঐতিহ্যবাহী মার্ক্সিস্টদের অনেকেই রোজাকে সমালোচনা করেন।   তাঁদের যুক্তি অনুসারে- প্রথমত: মার্ক্সের তত্ত্ব অভ্যন্তরীণ প্রতিবন্ধকতা ও  সীমা ব্যতীত সঞ্চয়ের কোন মসৃণ প্রক্রিয়াকে অনুমান করে নেয়নি, যেহেতু সম্প্রসারিত পুনরুৎপাদন শ্রম শক্তির মূল্যে উৎপাদনের হাতিয়ারের অসমানুপাতিক বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যায় যা কিনা মুনাফার হার কমায়। যখন অর্থনৈতিক সঙ্কট উদ্বৃত্ত উৎপাদন ভোগ করার ক্ষেত্রে অক্ষমতার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে, তখন মুনাফার হার কমে যাওয়ার কারণে পুঁজির সঞ্চয়ে ভাঙনে নিহিত থাকে সেই সঙ্কটের শেকড়। দ্বিতীয়ত: সমালোচকরা এটাও মনে করেন যে লুক্সেমবার্গ ‘পুঁজি’র দ্বিতীয় খন্ডে সম্প্রসারিত পুনরুৎপাদন বিষয়ে মার্ক্সের আঁকা নক্সাগুলো প্রকৃতপক্ষে বিদ্যমান পুঁজিবাদী বাস্তবতাকে নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়নি; নক্সাগুলো মূলত: এক প্রকার বিমূর্তায়ণ যা এটাই দেখাতে চায় যে এমনকি কেউ যদি উদ্বৃত্ত মূল্যের আদায়ের সমস্যা যদি কেউ তুচ্ছতাচ্ছিল্যও করে থাকে, তবু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপাদনে তার উদ্দেশ্যগত সীমাগুলো খুঁজে পায়। তৃতীয়ত, লুক্সেমবার্গের সমালোচকরা এটা বলেছেন যে একবার প্রাক-পুঁজিবাদী স্তরকে নি:শেষিত করে ফেলার পর পুঁজিবাদের ধস নামবে (যেহেতু উদ্বৃত্ত মূল্যের আয়তন ক্রয়ের জন্য আর কোন ক্রেতাই অবশিষ্ট থাকবে না) বলে রোজার ধারণা পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের যবনিকা টানায় মানবীয়, বিষয়ী শক্তিগুলোর ভূমিকা বিশদ করতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতি সমূহের আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রশ্নে এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গোটা ব্যবস্থাকে টেনে নামানোর জন্য  একটি বৈপ্লবিক শক্তি হতে পারে এই মর্মে রোজার তীব্র আপত্তি এই সমস্যা বিশেষভাবে সংকটপূর্ণ করে তোলে।  উপরোক্ত নানা সমালোচনা সত্ত্বেও আজ এ বিষয়ে বিশদ মতৈক্য রয়েছে যে ‘দ্য এ্যাকুমুলেশন অফ ক্যাপিট্যাল’ যা আজকের ‘পুঁজির বিশ্বায়ণ’কে বোঝার ক্ষেত্রে
মার্ক্সবাদের ইতিহাসে অদ্যাবধি গৃহীত ব্যপকতম নানা প্রয়াসের ভেতর প্রতিনিধি স্থানীয় একটি।
লুক্সেমবার্গের প্রজন্মের খুব কম মার্ক্সবাদীই তাঁর মত এত তীব্রভাবে তৃতীয় বিশ্বের উপর সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংসাত্মক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। আরো বিশেষত: সচেতন ছিলেন প্রাক-পুঁজিবাদী সম্প্রদায়গত গঠন সম্পর্কে। আলজেরিয়ায় ফরাসী সাম্রাজ্যবাদ, ভারতে ও চীণে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় ও ল্যাটিন আমেরিকান অঞ্চলে মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদ ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ সম্পর্কে রোজার ধ্বংসাত্মক সমালোচনা সৃজনশীল পর্যালোচনার বাতিঘর হয়ে আছে। উপরন্তÍ, পুঁজিবাদের প্রকৃতির সাথে সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণকে একসূত্রে গ্রথিত করার জন্য রোজার যে প্রচেষ্টা তা’ আজকের ‘চিরস্থায়ী যুদ্ধ’-এর জন্য বৈশ্বিক পুঁজিবাদের প্রণোদনার পেছনে যে কাঠামোগত কারণগুলো কাজ করছে, সেসব কারণকে নতুন আলোয় নিয়ে আসছে। যেমনটা রোজা লিখেছেন তাঁর ‘দ্য এ্যাকুমুলেশন অফ ক্যাপিট্যাল- এ্যান এন্টি-ক্রিটিক’-এ:  

            একটি ‘বিচ্ছিন্ন পুঁজিবাদী সমাজে’ পুঁজি সঞ্চয়ের সম্ভাব্যতায় বিশ্বাস, ‘সম্প্রসারণ ব্যতীত পুঁজিবাদ বিরাজ করতে পারে’ এমন ধারণায় বিশ্বাস একটি নির্দিষ্ট ও নিশ্চিত কৌশলগত প্রবণতা। এই ধারণা সাম্রাজ্যবাদের পর্যায়কে একটি ঐতিহাসিক প্রয়োজন হিসেবে দ্যাখে না, কিম্বা পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের ভেতরের নিষ্পত্তিমূলক প্রতিযোগিতা হিসেবেও দ্যাখে না, তবে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক আগ্রহী পক্ষগুলোর মন্দ উদ্ভাবন হিসেবে দ্যাখে। এহেন বিশ্বাস বুর্জোয়াদের কাছে এমন মিনতি করার জন্য ঝুঁকে পড়ে যে সাম্রাজ্যবাদ এবং রণবাদ এমনকি বুর্জোয়া স্বার্থের জন্যও খারাপ আর এভাবেই এহেন বিশ্বাস কিছু সুবিধাপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দলকে আলাদা করে, এর ফলে প্রলেতারিয়েত এবং বুর্জোয়াদের বিস্তৃত স্তরের ভেতর একটি আপাত: ঐক্য তৈরি হয় যা কিনা ‘সাম্রাজ্যবাদ’কে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করার লক্ষ্য থেকে উদ্ভুত, সাম্রাজ্যবাদকে যা শুকিয়ে মারবে ‘আংশিক নিরস্ত্রীকরণে’র মাধ্যমে এবং রণবাদের ‘দূর্গন্ধ’ দূর করার মাধ্যমে।    

মার্ক্সবাদের ইতিহাসে লুক্সেমবার্গই সেরা নারী তাত্ত্বিক হিসেবে পরিচিত। বহু বছর ধরেই অবশ্য তাঁর সম্পর্কে অনেক পন্ডিতের এমন দাবি ছিল যে নারী প্রশ্নে তিনি খুব কম দৃষ্টি দিয়েছেন বা একদমই দেন নি। যেহেতু নারী মুক্তি নিয়ে তিনি লিখেছেনই খুব কম। উপরন্তÍ, তাঁর রচনাবলী প্রায়ই ‘বুর্জোয়া নারীবাদ’কে আক্রমণ করে। নারী অধিকারের প্রশ্নে কর্মী হিসেবে বিপুল সময়ও তিনি ব্যয় করেননি। জার্মানিতে আসার পরপরই বেশ কিছু এসপিডি নেতা তাঁকে এসপিডির নারী শাখার দায়িত্বে নিয়োজিত হবার সুপারিশ করলেও তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তাঁর একদমই ইচ্ছা ছিল না ‘প্রান্তিক’ অবস্থানে যাবার। পার্টির পুরুষ নেতারা যেসব কেন্দ্রীয় বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতেন, সেসব থেকে অনেক দূরে কোথাও স্থাপিত হবার ইচ্ছে তাঁর ছিল না। তবে, সাম্প্রতিক কালের গবেষণাগুলো- বিশেষত: মার্ক্সিস্ট-মানবতাবাদী রায়া দ্যুনিয়েভস্কায়া তাঁর ‘রোজা লুক্সেমবার্গ, ওমেন্স লিবারেশন এ্যান্ড মার্ক্স’স ফিলোসফি অফ রেভল্যুশন (১৯৮২)’-এ রোজার জীবন ও চিন্তার নারীবাদী মাত্রাগুলো যা ইতোপূর্বে উপেক্ষিত থেকেছে সেসব মাত্রা নতুন করে নির্দেশ করেন। পল লোব্লঁশ যেমন সম্প্রতি উত্থাপন করেছেন যে লুক্সেমবার্গের ছিল ‘নারীমুক্তি ও শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তি’ বিষয়ে ব্যখ্যা করার স্পন্দমান ক্ষমতা।’ প্রায় এক দশক আগে নারীবাদী দার্শনিক আন্দ্রিয়া নিই  প্রস্তাব করেন যে নারীবাদ বিষয়ে লুক্সেমবার্গের শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গী ‘একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি যোগায় যা বৈচিত্র্যের প্রতি উদারনৈতিক সহনশীলতা এবং উত্তরাধুনিকতার ভিন্নতার নীতিমালা- এ উভয়ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত।’  ১৯৮৮ সালে জার্মান মার্ক্সিষ্ট নারীবাদী  ফ্রিগা হোগ অতীতের যেসব দৃষ্টিকোণ থেকে লুক্সেমবার্গকে ‘পুরুষালী নারীর বিভাগে রাখা হতো, অর্থাৎ রাখা হতো সেইসব নারীদের দলে যাদের কিনা নিজের নারীত্বকে অস্বীকার করে পুরুষালী পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয় সফল হবার জন্য’- তেমন দৃষ্টিকোণ বাতিল করেন।  
বহু এসপিডি নেতার ভেতরেই বিরাজমান পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে রোজা যথেষ্ট সচেতন ছিলেন এবং প্রায়ই নেপথ্যে থেকে হলেও ক্লারা জেটকিনের মত ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাজকে পরিপূর্ণ ভাবে সমর্থন করে গেছেন যারা কিনা নারী মুক্তিকে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের এক অখন্ড মাত্রা হিসেবে মনে করে।   এই সঙ্কলণ নারী প্রশ্নে লুক্সেমবার্গের বেশ কিছু রচনাকে একত্রিত করেছে যার ভেতর আছে অতীতে কখনোই ইংরেজিতে অনূদিত না হওয়া কিছু লেখা; এই রচনাগুলো তাঁর নারীমুক্তির সংগ্রামে সজীব এবং চলমান অংশগ্রহণকেই প্রমাণ  করে।
সেইসব নতুন অনূদিত রচনাবলীর মাঝে রয়েছে ‘আ ট্যাকটিকাল কোয়েশ্চেন (১৯০২)’ যা কিনা বেলজিয়ান সমাজতন্ত্রী নেতা এমিল ভান্দেরভেলদের উদারনৈতিকদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধার একটি জবাব যেখানে নতুন এই নির্বাচনী জুটি সর্বজনীন পুরুষ ভোটাধিকারকে সমর্থন করলেও নারীর ভোটাধিকারের জন্য সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের দীর্ঘদিনের দাবিকে অস্বীকার করে। (চলবে)