রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী
(ভূমিকা: পিটার হুদিস এবং কেভিন বি. এন্ডারসন)
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১০:৩০ এএম, ৩০ মার্চ ২০২২ বুধবার
রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী
(ভূমিকা/পর্ব: ৫): রোজা লুক্সেমবার্গ এই পদক্ষেপসমূহকে সমাজতন্ত্রের মৌলিক নীতিমালার লজ্জাজনক পরিত্যাগ বলেই শুধু আক্রমণ করেননি, বরং সেই সাথে এটাও লিখেছেন যে কিভাবে নারীর ক্ষমতায়ণ সোশ্যাল ডেমোক্রেসি এবং সেই সাথে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেও ঝাঁকুনি দেবে: ‘নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ণের সাথে সাথে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনেও সবল, সতেজ বাতাস বয়ে যাবে যা দেশের বর্তমান দমবদ্ধ হাওয়াকে কাটাতে সাহায্য করবে, কঠোর যে পারিবারকি জীবন এমনকি আমাদের পার্টির সদস্য, শ্রমিক এবং নেতাদের গায়েও নির্ভুলভাবে সেঁটে থাকে তাকে মুছতে সাহায্য করবে।‘
দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনালের নেতাদের সাথে ‘নারী প্রশ্নে’ রোজার বিতর্ক এখানেই সীমিত থাকেনি। ১৯০৭ সালে তিনি ‘আর্ন্তজাতকি সমাজতন্ত্রী নারী সম্মেলন (দ্য ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট ওমেন্স কনফারেন্স)’-এ বক্তৃতা দেন। বক্তৃতায় রোজা এই যুক্তি প্রদর্শন করেন যে ব্রাসেলসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রী নারী সম্মেলনের স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে। ১৯১২ সালে তিনি আরো এই যুক্তি প্রদর্শন করেন যে জার্মানীর মধ্যবিত্ত নারী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণীর নারীর সংগঠনও গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ কথা তিনি তাঁর ‘নারীর ভোটাধিকার ও শ্রেণী সংগ্রাম (উইমেন্স সাফ্রেজ এ্যান্ড ক্লাস স্ট্রাগল)’ গ্রন্থেও উল্লেখ করেন। ১৯১৪ সালে তিনি ‘সর্বহারা নারী (‘প্রলেতারিয়ান উইমেন‘- এই সঙ্কলণে প্রথমবারের মত ইংরেজিতে অনূদিত)’ একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন যা ইউরোপে এবং আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় নারীর প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রতি একটি চলমান শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে নিবেদিত হয়:
‘দূর্দশাগ্রস্থ নারীর এক গোটা ভুবন অপেক্ষা করছে রিলিফ বা সাহায্যের জন্য। জীবনের ঘানির নিচে প্রায় চাপা পড়া কৃষকের বউ কাঁদছে। জার্মান অধিকৃত আফ্রিকায়, কালাহারি মরুভূমিতে আত্মরক্ষায় অক্ষম হেরেরো নারীর হাড়গুলো রৌদ্রে দগ্ধ হচ্ছে, সেই অভাগা নারীরা যাদের জার্মান সৈন্যের দল নিষ্ঠুরভাবে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে যেমনটা শিকারীরা করে পশুদের সাথে আর শেষমেশ সেই মেয়েরা মরেছে তীব্র ক্ষুুধা ও পিপাসায়। মহাসাগরের অন্য তীরে, পুতুমাইয়োর খাড়াই সমুদ্রশৈলর উপরে শহীদ ইন্ডিয়ান মেয়েদের মৃত্যু আর্তি উপেক্ষা করে গেছে গোটা পৃথিবী, আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদীদের রাবার চাষের ডামাডোলে তারা হারিয়ে গেছে। প্রলেতারিয়েত নারী, দরিদ্রের দরিদ্র, নি:সহায়ের নি:সহায়, নারীমুক্তির সংগ্রামে যোগ দিতে তথা পুঁজিবাদী আধিপত্যের হাত থেকে মানবপ্রজাতিকে রক্ষা করতে দ্রুত বেগে যাত্রা করে।’
১৯১৮ সালে জার্মান বিপ্লবের উত্তুুঙ্গ মূহুর্তে, লুক্সেমবার্গ জেটকিনকে স্পার্টাকাস লীগের নারী শাখা গঠনের জন্য এবং এর প্রকাশনা দাই রোতে ফাহনে-র দায়িত্ব নেবার জন্য আহ্বান জানান।
নারী বিষয়ক লুক্সেমবার্গের লেখালিখি পোলিশ আন্দোলনে তাঁর কাজ অবধি সম্প্রসারিত হয়েছিল। ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অব দ্য কিংডম অব পোল্যান্ড এ্যান্ড লিথুয়ানিয়া (এসডিকেপিআইএল)’-এর কার্যক্রমের ১০টি লক্ষ্যবিন্দু তিনি রচনা করেন যা আহ্বান জানিয়েছিল ‘দেওয়ানী ও ফৌজদারি সহ সকল রাষ্ট্রীয় আইন বাতিল করার জন্য যা মূলত: নারীর প্রগতির লক্ষ্যেই প্রণীত হয়েছিল, যেসব আইন যেকোন ভাবেই হোক না কেন নারীর ব্যক্তিগত স্বাধীণতাকে সীমিত করেছে, সম্পদের মীমাংসা করা বা সন্তান-সন্ততির উপর অভিভাবকের অধিকার পালনের ক্ষেত্রে সন্তানদের পিতার সমান অধিকার সে কখনোই পায় না।’ লুক্সেমবার্গের জীবনী রচয়িতা রিচার্ড আব্রাহাম পর্যবেক্ষণ করেছেন যে ‘লুক্সেমবার্গ এবং জেটকিন নারীর জন্য যেসব দাবি তুলছিলেন তা’ সেসময়ের বুর্জোয়া নারীবাদীদের দ্বারা পরিচালিত গণ সংগঠনগুলোর দাবি-দাওয়ার চেয়ে ঢের বেশি বৈপ্লবিক ছিল, বুর্জোয়া নারীবাদে আস্থাবান নেতাদের দ্বারা বিপথগামী করার কোন কৌশল তারা সহ্যই করেননি।’
নারী বিষয়ক লুক্সেমবার্গের লেখালিখি পোলিশ আন্দোলনে তাঁর কাজ অবধি সম্প্রসারিত হয়েছিল। ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অব দ্য কিংডম অব পোল্যান্ড এ্যান্ড লিথুয়ানিয়া (এসডিকেপিআইএল)’-এর কার্যক্রমের ১০টি লক্ষ্যবিন্দু তিনি রচনা করেন যা আহ্বান জানিয়েছিল ‘দেওয়ানী ও ফৌজদারি সহ সকল রাষ্ট্রীয় আইন বাতিল করার জন্য যা মূলত: নারীর প্রগতির লক্ষ্যেই প্রণীত হয়েছিল, যেসব আইন যেকোন ভাবেই হোক না কেন নারীর ব্যক্তিগত স্বাধীণতাকে সীমিত করেছে, সম্পদের মীমাংসা করা বা সন্তান-সন্ততির উপর অভিভাবকের অধিকার পালনের ক্ষেত্রে সন্তানদের পিতার সমান অধিকার সে কখনোই পায় না।’ লুক্সেমবার্গের জীবনী রচয়িতা রিচার্ড আব্রাহাম পর্যবেক্ষণ করেছেন যে ‘লুক্সেমবার্গ এবং জেটকিন নারীর জন্য যেসব দাবি তুলছিলেন তা’ সেসময়ের বুর্জোয়া নারীবাদীদের দ্বারা পরিচালিত গণ সংগঠনগুলোর দাবি-দাওয়ার চেয়ে ঢের বেশি বৈপ্লবিক ছিল, বুর্জোয়া নারীবাদে আস্থাবান নেতাদের দ্বারা বিপথগামী করার কোন কৌশলই তারা সহ্যই করেননি।’
লুক্সেমবার্গের আত্ম-বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণটি দেখা দেয় লিও য়োগিচেশেসের সাথে বিচ্ছেদের পর। ১৯০৫ সালের বিপ্লবে রোজার সংযুক্তির অল্প কিছুদিন পরেই এই বিচ্ছেদ ঘটেছিল। এর কয়েক বছর পরই প্রেমিক কনস্তান্তিন জেটকিন (কোস্তিয়া)-কে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘লিওর কাছ থেকে মুক্ত হবার পর থেকে আমি যেন আবার আমার আগের আমিকে খুঁজে পেয়েছি।’ রায়া দুনায়েভস্কায়া লিও-রোজার বিচ্ছেদের রাজনৈতিক প্রভাব সতর্কভাবে অন্বেষণ করেছেন, লক্ষ্য করেছেন যে ‘য়োগিচেশেসের উপর নির্ভরতা কমার পর রোজার আত্ম-বিকাশ নতুন সব উচ্চতা অর্জন করে...বিচ্ছেদের পর তাঁর সর্বোত্তম মেধা বিকাশ ঘটে।’ যেখানে কিনা বিচ্ছেদের আগে ‘লুক্সেমবার্গ, যার কিনা সংগঠন বিষয়ে আগ্রহ ছিল খুবই কম এবং য়োগিচেশেস যিনি কিনা নিজেই ছিলেন ‘আদ্যোপান্ত এক সংগঠন,’- তাঁদের দু’জনের ভেতরের প্রেমের সম্পর্কে সংগঠন অবশ্য কখনোই বিভেদ সৃষ্টিকর কিছু হয়ে দাঁড়ায়নি,’ ১৯০৭ সাল নাগাদ ‘রোজার আরো আরো আত্ম-বিকাশ নতুন উচ্চতায় পৌঁছচ্ছিল যার জন্য তাঁকে তত্ত্ব বা সংগঠন বোঝার কোন ক্ষেত্রেই লিওর উপর নির্ভর করতে হয়নি।’ প্রকৃতপক্ষে, লুক্সেমবার্গের কাজের একটি বড় দিক হলো স্বত:স্ফূর্ততা ও সংগঠনের সম্পর্ক বিষয়ক তাঁর স্বাতন্ত্র্যসূচক দৃষ্টিভঙ্গী। দ্যুনায়েভস্কায়া যেমন লিখেছেন যে রোজাকে নিয়ে লেখা নেটলের কর্তৃত্ববাদী জীবনীতে এই নতুন বিকাশগুলো একদমই আলোচনায় আসেনি, যেখানে অধ্যায় ১৯০৬-০৯ সময়পর্বকে নেটল ‘হারানো বছরসমূহ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নেটলের এই সমালোচনা প্রসঙ্গে নারীবাদী কবি অড্রিয়েন রিচ বলেছেন: ‘কীর্ত্তিময়ী নারীদের সমালোচকরা অনেক সময়ই এটা স্বীকার করতে ব্যর্থ হন যে একজন নারীরও মূল সম্পর্ক হতে পারে তাঁর কাজের সাথে, যদিও প্রেমিকেরা আসে এবং যায়।’
লেনিনের সাথে লুক্সেমবার্গের বিতর্ক মূলত: বৈপ্লবিক সংগঠনের সাথে তাঁর সামগ্রিক সম্পর্ককে প্রকাশ করে। লুক্সেমবার্গ লেনিনের গভীর অনুরাগী ছিলেন এবং শুধুমাত্র রোজার মৃত্যুর পর এই মিথের সৃষ্টি হলো যে বিপ্লব এবং সংগঠন বিষয়ে তাঁরা দু’জন দুই মেরুর ভাবনা ভাবতেন। যাহোক, লেনিনের সাংগঠনিক তত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর সমালোচনা বৈপ্লবিক আন্দোলনের পরবর্তী ইতিহাসের আলোয় নতুন চেহারা পেয়েছে।
তাঁর ‘রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেসির সাংগঠনিক প্রশ্নাবলী’ নিবন্ধে লুক্সেমবার্গ লেনিনের অত্যধিক কেন্দ্রমুখীনতার তীব্র বিরোধিতা করেন; তিনি সেই সাথে এই যুক্তি দেখান যে সর্বহারা শ্রেণী ‘সংগঠন নামে ধারণা বা তত্ত্বের একটি সামগ্রিক পর্যালোচনার আহ্বান করে।’ কঠোর সাংগঠনিক কেন্দ্রিকতার মাধ্যমে সুবিধাবাদ রোখার যে প্রয়াস পেয়েছেন লেনিন তা’ স্বত:স্ফূর্ত নানা উদ্যোগ এবং গণতান্ত্রিক আলোচনার কণ্ঠরোধ করতে পারে বলে রোজা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। সুবিধাবাদের সাথে লড়াইয়ের অবশ্যই দরকার আছে তবে সেটা সাংগঠনিক কাঠামোর প্রতিলিপি নির্মাণের মাধ্যমে নয়, লুক্সেমবার্গ মনে করেন। যদিও লেনিনের মতই লুক্সেমবার্গও একটি ভ্যানগার্ড বা অগ্রপথিক বাহিনীর প্রয়োজনের তত্ত্বকে উর্দ্ধে তুলে ধরেছিলেন, বৈপ্লবিক চেতনা ও সংগঠনের সম্পর্ককে কিছুটা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি দেখেছিলেন। লেনিন প্রায়শ:ই পার্টি বা দলকে শ্রেণী সচেতনতার জরুরি বাহন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যেখানে কিনা লুক্সেমবার্গ সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক সংগ্রামে শ্রেণী চেতনার অবস্থান নির্দেশ করেছেন এবং পার্টির করণীয় হলো সেই শ্রেণী চেতনাকে ধারণ ও বাস্তবায়িত করায় সাহায্য করা। ১৮৯৯ সালে ‘বিপ্লব অথবা সংস্কার (রিফর্ম অর রেভল্যুশন)’-এ তিনি লেখেন, ‘যতদিন ধরে তাত্ত্বিক জ্ঞান পার্টির কিছু সীমিত ‘বুদ্ধিজীবী’র করায়ত্ব হয়ে থাকবে, ততদিন পার্টির যে কোন সময়ে গোল্লায় যাবার আশঙ্কা থেকেই যাবে। শুধুমাত্র যখন বিপুল সংখ্যক শ্রমিকেরা তাদের নিজেদের হাতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তীক্ষè এবং নির্ভরযোগ্য অস্ত্র হাতে তুলে নেবে...শুধুমাত্র তখনি সুবিধাবাদী স্রোত নাই হয়ে যাবে।’
লেনিনের ‘হোয়াট ইজ টু বি ডানে’র উত্তরে ১৯০৪ সালে লেখা লুক্সেমবার্গের সমালোচনা যদিও বিখ্যাত, সম্প্রতি আবিষ্কৃত তাঁর বেশ কিছু পান্ডুলিপি লেনিনের সাংগঠনিক তত্ত্বের উপর নতুন আলো ফেলতে পারে। এগুলোর ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো একটি দীর্ঘ অপ্রকাশিত প্রবন্ধ যা রচিত হয়েছিল ১৯১১ সালের শরতে এবং ১৯৯১ সালে ফেলিক্স টিখ যা প্রকাশ করেন। মস্কোর এসডিকেপিআইএল-এর অফিসের মহাফেজখানায় তিনি এটি আবিষ্কার করেন। ‘ক্রেডো’ শিরোনামের এই লেখাটি এমন একটা সময় লেখা হয় যখন লেনিন ‘রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি- আরএসডিআরপি’ থেকে সব ধরণের অ-বলশেভিক প্রবণতা দূর করার চেষ্টা করছেন এবং যখন তাঁর ও রোজা-লিও’র এসডিকেপিআইএল-এর ভেতর টানটান উত্তেজনা দেখা দিচ্ছিল। ‘ক্রেডো’ নিবন্ধে ট্রটস্কি বা মেনশেভিকদের চেয়ে লেনিন এবং বলশেভিকদের প্রতিই রোজা তাঁর গভীরতর সম্বন্ধ পরিষ্কার করেন। তথাপি তাঁর ভাষায় ‘লেনিনবাদী বামদের নিষ্ঠুর, বৈপ্লবিক কার্যক্রমকেও’ তিনি কঠোর আক্রমণ করেন। এই নিবন্ধটির গুরুত্ব প্রথম তুলে ধরেন এ্যানেলিস লাসচিতজা যিনি লুক্সেমবার্গের সাম্প্রতিকতম জীবনীর প্রণেতা: ‘অর্গ্যানাইজেশনাল কোয়েশ্চেনস্ অব সোশ্যাল ডেমোক্রেসি-১৯০৪’ এবং ‘দ্য রাশিয়ান রেভল্যুশন-১৯১৮’-এর মত পান্ডুলিপির পাশাপাশি ক্রেডো লেনিনের রাজনীতির উপর লেখা রোজার রচনাবলীর উপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলোর একটি যা পার্টির একতা এবং পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র বিষয়ে নিয়মাবদ্ধ পার্থক্যগুলোকে পরিষ্কার করে।
বৈপ্লবিক গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রোজার অভিক্ষেপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ১৯১৮ সালে লেখা তাঁর দীর্ঘ নিবন্ধ ‘দ্য রাশিয়ান রেভল্যুশন’-এ যা ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়। যদিও নিবন্ধটিতে ১৯১৭-এর অক্টোবর বিপ্লবের অনেক কঠোর সমালোচনা ছিল, একথা আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে এই প্রবন্ধটি অক্টোবর বিপ্লবের পক্ষে দাঁড়িয়েছেও বটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরোধিতা করার দায়ে কারাভোগ করার সময় লিখিত এই প্রবন্ধে বলশেভিকদের প্রশংসা করা হয় তাদের সাহস ও উদ্যোগের জন্য। যাহোক, আবার একই সময়ে- লুক্সেমবার্গের লেখার কিছু বিষয় অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে- ক্ষমতায় আসার পর বলশেভিকদের গৃহীত বেশ কিছু নীতিমালা- যেমন কৃষকদের জমি দেয়া বা গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে জাতীয় আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রশ্নে জোর দেয়া- এসব নীতির তিনি কঠোর সমালোচনা করেন। তবে, তাঁর করা সমালোচনাগুলোর ভেতর লেনিন এবং ট্রটস্কি কর্তৃক গৃহীত বৈপ্লবিক গণতন্ত্র রোধ করার বিরুদ্ধে জারিকৃত প্রতিবাদ সবচেয়ে শক্তিশালী এবং স্থায়ীতম সমালোচনা হিসেবে রয়েছে। লুক্সেমবার্গ এবিষয়ে গভীর উদ্বিগ্ন ছিলেন যে বাক্, সংগঠন ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ করার বলশেভিক প্রবণতা সাম্যবাদী আন্দোলনকে একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার দিকে নিয়ে যাবে। সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্র, রোজার মতে, পরষ্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত; একটি ছাড়া অপরটি অর্জন সম্ভব নয়। এছাড়াও, একটি মাত্র দলে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে, লেনিন এবং ট্রটস্কি রাশিয়ার বৈপ্লবিক উন্নতির ভিত্তিই ধ্বংস করেছেন। পুরণো আমলের পতনের পর চিন্তা ও স্বত:স্ফূর্ত প্রকাশভঙ্গীর স্বাধীণতার প্রয়োজনের কথা তুলে রোজা মার্ক্সিস্ট আন্দোলনের জন্য সবচেয়ে দূরূহ ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নও তুলেছেন, যেমন: বিপ্লবের পরে কি হয়? বিপ্লবের পর কোন নতুন শ্রেণী বা আমলাতন্ত্র যেন জন্ম না নেয়, সেটা নিশ্চিত করতে কি করা দরকার? - যেসব পরবর্তী ঘটনার স্বাক্ষী হতে রোজা যেন আর বেঁচে যেতে না পারে? কোন বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার পক্ষেই কি ‘চিরস্থায়ী’ভাবে চলমান হওয়া সম্ভব যাতে করে বিচ্ছিন্নতার সর্বোৎকর্ষ অর্জন সম্ভব হয়?
লুক্সেমবার্গ কর্তৃক উত্থাপিত এই প্রশ্নগুলো পরবর্তী সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয় যখন মার্ক্সিস্ট আন্দোলনের ভেতর থেকে স্ট্যালিনীয় সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ববাদ দেখা দেয় এবং দশকের পর দশকের অত্যাচার ও সন্ত্রাসের পর যখন স্ট্যালিনের শাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে- যদিও সেসব পরবর্তী ঘটনার স্বাক্ষী হতে রোজা আর বেঁচে ছিলেন না। এসবই রোজার পূর্বজ্ঞানের স্বাক্ষ্য দেয় যে তাঁর করা রুশ বিপ্লবের সমালোচনা এবং যা অমন একটি বৈপ্লবিক ভাবে ভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে উত্থাপিত হয়েছিল- এই উত্থাপন তবু একটি প্রশ্নকে নিয়ে কথা বলেছে যা আজো লাখক্ষ লাখক্ষ মানুষের হৃদয়ে আছে- আর সেই প্রশ্নটি হলো: প্রস্থানোদ্যত পুঁজিবাদ এবং সেই পুঁজিবাদের প্রতি সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক/কর্তৃত্ববাদী বিরোধিতা- এ দুই ব্যতীত অন্য কোন বিকল্প কি আমাদের সামনে আছে?