রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী
(ভূমিকা: পিটার হুদিস এবং কেভিন বি. এন্ডারসন)
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১২:১১ এএম, ১৩ এপ্রিল ২০২২ বুধবার
রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী
ভূমিকা/পর্ব – ৭: যে পন্থায় মার্ক্সের ‘ক্রিটিক অফ দ্য গোথা প্রোগ্রাম’ সংগঠনের এক স্বাতন্ত্র্যসূচক ধারণার অভিক্ষেপণ করেছিল যা তাঁর কোন অনুসারী তখনো পর্যন্ত গঠন করেননি এবং সেসময় সংগঠনের স্বাতন্ত্র্যসূচক ধারণা লুক্সেমবার্গ সহ কেউ স্বীকরাও করেনি- বহু যুগ লেগে গেছে ‘ক্রিটিক অফ দ্য গোথা প্রোগ্রাম’-এর গুরুত্ব পুনরাবিষ্কৃত হতে।
১৯১৯ সালের ৪ঠা জানুয়ারি, কেপিডি গঠনের অল্প কিছুদিনের ভেতরেই, বার্লিনের পুলিশ প্রধান এমিল আইখহর্ণ যিনি কিনা বামপন্থী দল ইউএসপিডির সাথে জড়িত ছিলেন, তিনি এসপিডি-নিয়ন্ত্রিত প্রুশীয় সরকার কর্তৃক বহিষ্কৃত হন। জানুয়ারির ৫ তারিখ- রোববার- বার্লিণ ইউএসপিডি কর্তৃক খসড়াকৃত একটি আহ্বানের প্রেক্ষিতে, বৈপ্লবিক দোকান পরিচালকেরা (দ্য রেভল্যুশনারি শপ স্টিওয়ার্ডস) এবং কেপিডি-র নেতৃত্বে এক লক্ষের উপর শ্রমিক বার্লিনের রাস্তায় নামল আইখহর্ণের বহিষ্কারের প্রতিবাদ করতে। সেই সন্ধ্যায়, শ্রমিক বাহিনীগুলো স্বত:স্ফূর্তভাবে ‘ভরওয়ার্টস’ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ছাপাখানাগুলো অধিকার করল। সমাবেশের অপ্রত্যাশিত বেশি জমায়েত এবং অংশগ্রহণকারীদের বৈপ্লবিক মানসিকতায় বিষ্মিত হয়ে দ্রুতই বার্লিন এসপিডি, রেভল্যুশনারি শপ স্টিওয়ার্ডস এবং লিবেনীখট ও কেপিডি-র উইলহেলম পিক মিলে একটি ‘বৈপ্লবিক কমিটি’ গঠিত হল। লুক্সেমবার্গকে কিছু না জানিয়েই রোববার গভীর রাতে এবের্ট-শেইডম্যান সরকারকে ছুঁড়ে ফেলার পক্ষে তাঁরা ভোট দিলেন। পরবর্তী দিন অর্থাৎ জানুয়ারির ৬ তারিখে সরকারবিরোধী আন্দোলন আরো তীব্রতর হল যখন কমপক্ষে পাঁচ লাখ শ্রমিক বার্লিণের রাস্তায় মার্চ করল। জার্মানীর ইতিহাসে এটাই ছিল শ্রমিক শ্রেণী প্রদর্শিত বৃহত্তম বিক্ষোভ। তবে বার্লিনের ব্যারাকগুলোয় সৈন্যরা এই জন উত্থানে অংশ নেয়নি এবং কারখানাগুলোয় অনেকেই বিভিন্ন সমাজতন্ত্রী দলের ভেতরে একতাকে সমর্থন করেছে।
পরবর্তী কয়েক দিনে ঘটনাপ্রবাহ যে জটিল এবং বিভ্রান্তিকর মোড় নেয় তা’ এখানে বিস্তারিত ব্যখ্যা করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে অল্পই সন্দেহ আছে যে একটি বিদ্রোহের ডাককে লুক্সেমবার্গ সেই মূহুর্তে অপরিণত পদক্ষেপ বলেই মনে করেছিলেন; কেপিডি তখনো পর্যন্ত একটি ছোট্ট ও সদ্যোজাত সংগঠন এবং এটাও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না যে বিপ্লবীরা শ্রমিক এবং সেনাবাহিনী পরিষদের সাহায্যের উপর ভরসা করে চলতে পারবে কিনা- কৃষকদের কথা বাদই দেয়া যাক। তবু বিদ্বজ্জনদের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে অট্টোকার লুবান দীর্ঘদিনের স্থগিত তর্কটিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন যা বলতে চায় যে স্পার্টাকাস বিদ্রোহে অংশ নিতে লুক্সেমবার্গ মৌলিকভাবেই অনিচ্ছুক ছিলেন। এসপিডি এবং অন্যরা সেসময়টা যেমন দাবি করেছিল তেমনটা না রোজা লুক্সেমবার্গ, না কেপিডি বা এসপিডির কোন নেতা- কেউই এই বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেননি। তবে, জানুয়ারির ৭ তারিখে, লুক্সেমবার্গ যখন দেখলেন যে রাস্তায় অসংখ্য শ্রমিক জড়ো হয়ে এবার্ট-শেইডম্যান সরকারের বহিষ্কার চাচ্ছে, তখন তিনি ‘দাই রোতে ফাহনে’ পত্রিকায় ‘সব ক্ষমতাসূচক পদ দখলে’র আহ্বান জানান। একদিন পর তিনি এবার্ট-শেইডম্যান সরকারের অপসারণকে ‘একটি প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্য’ বলে বর্ণনা করেন। যদিও লুক্সেমবার্গ এবিষয়ে মোটামুটি সচেতন ছিলেন যে ক্ষমতার ভারসাম্য বিপ্লবীদের সহায়তা করবে না, তবু তিনি এই জন অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করেননি এটা ভেবে যে একবার গতি পেলে ‘একটি বৈপ্লবিক বিকাশ কখনোই পিছপা হবে না।’ জনতা পরিষ্কারভাবেই রাস্তায় ছিল এবং তিনি বোধ করলেন যে বিপ্লবীদের ঘাড়ে সেরা লড়াইটা লড়ার দায়িত্ব বর্তায়।
বার্লিনের শ্রমিক এবং সৈন্য পরিষদের ও জন নাবিক বিভাগের বাহিনীগুলো থেকে সমর্থন পেতে বিপ্লবীদের ব্যর্থতা জন অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দিতে সাহায্য করল; সরকারী বাহিনী আক্রমণাত্মক হল এবং দমন করল এই আন্দোলন। লুক্সেমবার্গ এবং লিবেনীখট আত্মগোপনে বাধ্য হলেন যেহেতু এসপিডি বেশ খোলাখুলিভাবেই তাদের মস্তক দাবি করল। যদিও কেউ কেউ রোজাকে বার্লিন ত্যাগের পরামর্শ দিলেন, রোজা সে পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করলেন। জানুয়ারির ১৫ তারিখে লিবেনীখটের সাথে তিনি গ্রেপ্তার হলেন। গ্রেপ্তার করল সরকার কর্তৃক পুষ্ট ‘ফ্রেইকর্পসে’র সদস্যরা যারা ছিল বস্তত: নাজিদের অগ্রদূত। রোজা ও লিবেনীখট- দু’জনকেই একইদিনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পরের মাসগুলোয় রোজার বিকৃত দেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
যে যুগে রোজা লুক্সেমবার্গ জন্মেছিলেন এবং কাজ করেছিলেন তা’ সুনিশ্চিতভাবেই আমাদের কাছ থেকে মুছে ফেলা হয়েছে- শুধু ঐতিহাসিকভাবেই নয়, তাত্ত্বিক ভাবেও। রুশ বিপ্লব কিভাবে একটি চূড়ান্ত কর্তৃত্ববাদী সমাজে রূপান্তরিত হয়েছিল তা’ দেখবার আগেই তিনি মারা যান- আর রুশ বিপ্লবের পতন ত’ আরো পরের কথা! আফ্রিকা, এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকায় সা¤্রাজ্যবাদ-বিরোধী বিপ্লবগুলো দেখার মত দীর্ঘ আয়ু তিনি পাননি। সুশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত কার্ল মার্ক্সের সমগ্র রচনাবলী প্রকাশ পাওয়ার আগেই তিনি মারা গেছেন যা পরবর্তী প্রজন্মগুলোকে মার্ক্সের চিন্তার দৈর্ঘ্য ও গভীরতা বিষয়ে আরো অনেক গভীরতর অনুধাবনে সক্ষম করেছে। তাঁর ‘রাজনৈতিক ও দার্শনিক পান্ডুলিপিসমূহ ১৮৪৪’ ‘গ্র্যান্ডরিস (মহা সম্পদ)’ এবং প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত সমাজসমূহ সম্পর্কে জীবনের শেষ এক দশকের লেখা-পত্র প্রকাশিত হওয়াটা তখনো অবধি লুক্কায়িত ছিল ভবিষ্যতের গর্ভে। তবু তিনি যে সময়ে বেঁচে ছিলেন সেই সময়ের ঐতিহাসিক ও তাত্ত্বিক যত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রোজা লুক্সেমবার্গ বিপ্লব ও স্বাধীণতার একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন যা আমাদের সাথে আজো কথা বলে, যদিও আমাদের পরিস্থিতি আজ আমূলভাবেই ভিন্নতর।
স্যোশালিস্ট ডেমোক্রেসি ও মানবিক মুক্তির প্রতি রোজার স্বপ্নদর্শী প্রতিশ্রুতি এবং আমলাতন্ত্র, অত্যধিক কেন্দ্রমুখীনতা এবং আভিজাত্যবাদের প্রতি তাঁর তীব্র বিরোধিতা সেইসব রাজনীতিকদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল যারা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে টুকরো-টাকরা কিছু সংস্কার অথবা প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতাসমূহের সাথে নীতিহীণ বোঝা-পড়ায় সীমিত করে তোলে। তাঁর উচ্চারিত শব্দমালা গণতন্ত্রের এক গভীরতর আঙ্গিকের প্রয়োজনের কথা বলে, মানবতাবাদী মুখশ্রীতে বিন্যস্ত এক সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র বা স্যোশালিস্ট ডেমোক্রেসির কথা বলে যা কর্তৃত্ববাদ থেকে মুক্ত থাকবে, একইসাথে মুক্ত থাকবে এমন কোন দাবি থেকে যে ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের সঙ্কীর্ণ দিগন্ত থেকে মুক্ত হবার যে কোন চেষ্টা অবশ্যম্ভাবীভাবেই বিশৃঙ্খলা বা সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ববাদে শেষ হবে।
সর্বোপরি, যুদ্ধ ও Imperialism বিষয়ে লুক্সেমবার্গের সমালোচনা এবং একইসাথে বৈশ্বিক পুঁজিবাদের আধিপত্যে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িতদের (শ্রমিক শ্রেণির নারী থেকে ঔপনিবেশিক শাসনের নিষ্ঠুরতায় পদপিষ্ট জনতা) সাথে তাঁর গভীর একাত্মতাবোধ আজো প্রতিধ্বনিত হয়।
আজকের এই সামগ্রিক বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে, প্রজন্মসমূহের মাঝে একটি মন্দ বিচ্ছেদ আমরা মেনে নিতে পারিনা- অন্তত: যখন রোজা লুক্সেমবার্গের মত ঐতিহাসিক এক ব্যক্তিত্বের অবদানকে আত্মস্থ করা ও পুনর্মূল্যায়ণ করার বিষয়টি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। রোজার কলম থেকে শেষ যে বাক্যটি বের হয়েছিল তা’ যেন তাই আজো সশব্দে ধ্বনিত হয়: ‘আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকব!’
(চলবে)