ঢাকা, শুক্রবার ২২, নভেম্বর ২০২৪ ১৬:৪৫:৩৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী

(ভূমিকা: পিটার হুদিস এবং কেভিন বি. এন্ডারসন) 

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১১:৫৯ এএম, ২৫ মে ২০২২ বুধবার

রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুন

রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুন

প্রথম অধ্যায়: রাজনৈতিক অর্থনীতি, সাম্রাজ্যবাদ ও অ-পশ্চিমা সমাজ
১. সঞ্চয়ের ঐতিহাসিক শর্ত, ‘পুঁজির সঞ্চয় (দ্য এ্যাকুমুলেশন অফ ক্যাপিটাল)’ থেকে

যাহোক, সঞ্চয়ের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় উৎপাদনের পদ্ধতিতে প্রযুক্তিগত বদলের প্রভাবকে আমরা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে পারি। আর এই বিবেচনা করতে গেলে মার্ক্সের বৃত্তের মৌল সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্থ না করে তা‘ করা সম্ভব নয়।
এবং আরো বিশদে বলতে হলে: মার্ক্সের বৃত্ত অনুযায়ী, মূলধন বা পুঁজি হিসেবে ব্যবহৃত উদ্বৃত্ত মূল্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরবর্তী উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ততক্ষণাৎ এবং সম্পূর্ণভাবে শোষিত হয়। যেহেতু ভোগের জন্য বরাদ্দকৃত অংশটুকু ছাড়া এই উদ্বৃত্ত মূল্যের রয়েছে একটি নির্দিষ্ট আকৃতি যা শুধুমাত্র একটি বিশেষ ধরণের কর্ম সংস্থানের অনুমতি দেয়। মার্ক্সের এই বৃত্ত কিন্তÍ উদ্বৃত্ত মূল্যর নগদ অর্থে ভাঙ্গানো এবং জমা করে রাখার অনুমতি দেয় না। যেহেতু পুঁজিকে সবসময়ই কোথাও না কোথাও বিনিয়োগ হতে হবে। ব্যক্তিগত পুঁজির মুক্ত আর্থিক আঙ্গিক, মার্ক্সের দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে, প্রথমত: এটা স্থির পুঁজির নানামাত্রিক ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে সঞ্চিত অর্থ এবং এই অর্থের একধরণের চূড়ান্ত পুননর্বীকরণ হয়েই থাকে। এবং দ্বিতীয়ত: যে পরিমাণ অর্থ উদ্বৃত্ত মূল্যের আদায় করা অংশের প্রতিনিধিত্ব করে অথচ কোন বিনিয়োগের জন্যই সেই অর্থকে ‘যথেষ্ট‘ বলা চলে না। সংহত পুঁজির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, মুক্ত আর্থিক পুঁজির এই উৎসগুলো আসলে অতি নগণ্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে আমরা যদি ধরেও নিই যে সামাজিক উদ্বৃত্ত মূল্যের একটি অংশ ভবিষ্যত বিনিয়োগের জন্য আর্থিক আঙ্গিকে আদায়কৃত হয়ে থাকে, তাহলে সাথে সাথেই একটি প্রশ্ন দেখা দিতে পারে: এই উদ্বৃত্ত মূল্যের বস্তÍগত উপকরণগুলো কে কিনেছে এবং কে এই ক্রয়ের অর্থ যুগিয়েছে? যদি এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে অন্য পুঁজিপতিদের কথা বলা হয়, তবে নি:সন্দেহে মার্ক্সের এই বৃত্তের দুই বিভাগে পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব দেখে উদ্বৃত্ত মূল্যের এই নির্দ্ধারিত অংশটুকুকেও বস্তÍত: বিনিয়োগকৃত মূলধন হিসেবে ধরে নিতে হবে।
অথবা কতিপয় পুঁজিপতির হাতে আর্থিক আঙ্গিকে উদ্বৃত্ত মূল্যের একটি অংশের এই হিমায়িতকরণ কি এটাই বোঝায় যে অন্য পুঁজিপতিরা এই উদ্বৃত্ত উৎপাদনের অনুরূপ অংশটি বস্তÍগত আঙ্গিকে পাবেন? কিছু ব্যক্তির দ্বারা আদায়কৃত উদ্বৃত্ত মূল্যের মজুত কি তবে এটাই বোঝায় যে অন্যরা আর উদ্বৃত্ত মূল্য আদায় করতে সক্ষম নয়? যেহেতু পুঁজিপতিরাই উদ্বৃত্ত মূল্যের একমাত্র ক্রেতা? এর অর্থ এটাই দাঁড়াবে যে মার্ক্সের বৃত্তে বর্ণিত পুনরুৎপাদন এবং একইসাথে সঞ্চয়ের মসৃণ প্রক্রিয়া এতে করে বাঁধাগ্রস্থ হবে। এর ফলাফল হিসেবে দেখা দেবে বিপর্যয়। এই বিপর্যয় অতি উৎপাদনের কারণে সৃষ্ট হবে না নিছকই সঞ্চয়ের উদ্দেশ্য থেকে এই বিপর্যয় দেখা দেবে তা‘ বলা কঠিন। তবে এই বিপর্যয়ের কথা সিসমন্ডি আগেই পূর্বানুমান করে গেছেন। ১৪
মার্ক্স তাঁর ‘থিওরিজ‘ ১৫ বা তত্ত্বের একটি অনুচ্ছেদে নানাবিধ শব্দের প্রয়োগের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন যে ‘এই প্রসঙ্গে তিনি আদৌ পুঁজির সঞ্চয় প্রশ্নে ভাবিত নন যে সঞ্চয় কিনা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহারযোগ্য অর্থের পরিমানের চেয়ে বড় এবং ব্যঙ্কগুলোয় নিষ্ক্রিয় অর্থ হিসেবে অলস পড়ে থাকতে পারে, এবং ফলাফল হিসেবে ভবিষ্যতে বিদেশে ধার হিসেবে এই অর্থ যেতে পারে।‘ এই বিশেষ দিকটিকে মার্ক্স তাঁর ‘প্রতিযোগিতা‘ বিষয়ক অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। তবু এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি যে মার্ক্সের বৃত্তটি বাস্তবিকই এমন কোন বাড়তি পুঁজি তৈরির বিষয়টি বর্জন করে। প্রতিযোগিতার তত্ত্বটিকে অবশ্য আমরা যতই বাড়াই না কেন, অবশ্যই এটি মূল্য তৈরি করতে পারে না। পারেনা পুনরুৎপাদমূলক প্রক্রিয়ায় নিজেরাই অংশ নয় এমন কোন কিছু দিয়ে পুঁজি বা মূলধন সৃষ্টি করতে।
মার্ক্সের বৃত্তটি তাই উৎপাদনের লাফিয়ে লাফিয়ে প্রসারণ বা বিস্তারকে প্রতিরোধ করে। এটা শুধুই একটি ধারাবাহিক প্রসারণকে অনুমতি দেয় যা উদ্বৃত্ত মূল্যের গঠনের সাথে কঠোরভাবে সঙ্গতিপূর্ণ এবং উদ্বৃত্ত মূল্যের আদায় ও মুনাফাকরণের মধ্যকার অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল।
এই একই কারণে মার্ক্সের এই বৃত্ত এমন এক বিশেষ প্রকারের সঞ্চয়কে অনুমান করে নেয় যা পুঁজিবাদী উৎপাদনের সব শাখাকে প্রভাবিত করে। চাহিদার লাগামছাড়া বা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়াকে যেমন এটি নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি পুঁজিবাদী উৎপাদনের একপাক্ষিক অথবা অপরিণত বিকাশও প্রতিহত করে।
এভাবেই এই বৃত্তটি মোট মূলধন বা পুঁজির গতিবিধি অনুমান করে যা পুঁজিবাদী বিকাশের প্রকৃত গতিপথের মুখে উড়ে যায়। প্রথম দৃষ্টিতে, পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির ইতিহাসের জন্য দু‘ধরণের ঘটনার প্রতীকি অর্থ আছে:  একদিকে উৎপাদনের সমগ্র ক্ষেত্রের পর্যাবৃত্ত বা পর্যায়ক্রমিক বিস্তার এবং অন্য দিকে উৎপাদনের বিভিন্ন শাখার চূড়ান্ত অসম বিকাশ। মার্ক্সের বৃত্তের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আঠারো শতকের প্রথম পঁচিশ বছর থেকে উনিশ শতকের সত্তর দশক পর্যন্ত বৃটেনের তুলা শিল্পের ইতিহাস ব্যখ্যাতীত বলে মনে হবে যদিও বৃটেনের তুলা শিল্পের এই বিকাশ পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে স্বতন্ত্র অধ্যায় হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।  
সবশেষে মার্ক্সের এই বৃত্ত তাঁর ‘পুঁজি‘-র তৃতীয় খন্ডে বর্ণিত সমগ্র পুঁজিবাদী প্রক্রিয়া এবং তার গতিপথের সাথে বিরোধিতাপূর্ণ। এছাড়াও এই ধারণাটি পুঁজিবাদী বন্টনের শর্তে উৎপাদন শক্তির সীমাহীন ক্ষমতা এবং সামাজিক ভোগের পরিমিত তবে বিস্তৃত ক্ষমতার অন্তর্নিহিত দ্বন্দের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।

(পাদটীকা: * জাঁ চার্লস সিসমন্ডি (১৭৭৩-১৮৪২) শিল্পবাদের শুরুর দিককার একজন সমালোচক ছিলেন। তাঁর ‘রাজনৈতিক অর্থনীতির নব্য মূলনীতি (নিউ প্রিন্সিপলস অফ পলিটিক্যাল ইকোনমি-১৮১৯) উৎপাদন এবং ভোগের ভেতর সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় প্রবিধানের পক্ষে বক্তব্য রেখেছিল।
           * ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বাবলী (থিওরজি অফ সারপ্লাস ভ্যালু,‘পৃষ্ঠা ১১৬)।
(চলবে)