দেশভাগ: ৭৫ বছর পর বোনের সঙ্গে ভাইদের নাটকীয় সাক্ষাৎ
অনলাইন ডেস্ক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১২:২৮ পিএম, ২৯ মে ২০২২ রবিবার
গুরমুখ সিং ও বলদেভ সিং ৭৫ বছর পর তাদের বোন মুমতাজ বিবির সঙ্গে মিলিত হলেন।
মুমতাজ বিবি নামে পাকিস্তানি এক নারী ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান ভাগের সময়, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। ৭৫ বছর পর তিনি তার ভারতীয় ভাইদের সাথে প্রথমবারের মতো মিলিত হয়েছেন।
উত্তাল ওই সময়ে মুমতাজ বিবি তার শিখ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং জীবনের দীর্ঘ সময় পাড়ি দিয়ে গত এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের একটি গুরদুয়ারাতে তার দুই ভাই গুরমুখ সিং ও বলদেভ সিং-এর সঙ্গে মিলিত হন।
এই ঘটনায় উদ্বেলিত তার এক ভাই গুরমুখ সিং বলেন, আমরা জীবদ্দশায় আমাদের বোনের সঙ্গে মিলিত হতে পেরেছি বলে খুবই আনন্দিত।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে ভারত ও পাকিস্তান, দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের বাইরে পৃথিবীর ইতিহাসে সে সময় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে হয়েছিল। এক হিসেবে বলা হয়, দেশভাগের সময় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ শরণার্থী হন। এছাড়াও সেসময় সংঘটিত ধর্মীয় দাঙ্গায় নিহত হয় পাঁচ থেকে ১০ লাখ মানুষ।
গুরমুখ সিং বলেন, এই সহিংসতায় আমাদের জীবনও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
দেশভাগের ফলে তাদের বাবা পালা সিং পাকিস্তান থেকে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের পাতিয়ালা জেলায় চলে যান। পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া সহিংসতায় তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি ভারতে চলে যান।
অপর ভাই বলদেভ সিং বলেন, আমার বাবা ধারণা করেছিলেন, স্ত্রীর সঙ্গে হয়তো তার কন্যাকেও হত্যা করা হয়েছে। এর পরে তিনি তার শ্যালিকাকে বিয়ে করেন (সে সময় পাঞ্জাব পরিবারে এটাই ছিল সামাজিক রীতি)।
দুই ভাই-এর মধ্যে কনিষ্ঠ বলদেভ সিং।
কিন্তু মুমতাজ বিবি ঘটনাক্রমে পাকিস্তানের একটি মুসলিম পরিবারের হাতে চলে যান। ওই পরিবার তাকে দত্তক নেয় এবং তারাই তাকে বড় করে তোলেন।
দুই ভাই-এর জন্য তাদের বোন মুমতাজ বিবির সন্ধান পাওয়াও ছিল বেশ নাটকীয়।
খোঁজ পাওয়া গেল যেভাবে: বলদেভ সিং বলেন, প্রায় দুই বছর আগে আমাদের সন্তানরা সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের বোনের খোঁজ পায়। মমতাজ বিবিও তার পরিবারকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।
এবিষয়ে তিনি পাকিস্তানি ইউটিউবার নাসির ধিলনের সঙ্গে কথা বলেন। ইউটিউবে নাসির ধিলনের একটি চ্যানেল আছে যার সাহায্যে দেশভাগের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কয়েকটি পরিবার পুনরায় একত্রিত হতে সক্ষম হয়েছে। ওই চ্যানেলটির নাম পাঞ্জাবি লেহার।
মুমতাজ বিবির সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য গুরমুখ সিং পাকিস্তানে তাদের পৈত্রিক নিবাস শেখুপুরা জেলার একটি গ্রামের একজন দোকানদারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
গুরমুখ সিং বলেন, তিনি আমাদের মুমতাজের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন।
তিনি জানান, মুমতাজ বিবির পরিচয়ের ব্যাপারে প্রথম দিকে তাদের পরিবার খুব বেশি আশাবাদী ছিল না।
তিনি বলেন, সে কি অন্য কেউ হতে পারে? কিন্তু আমরা ধীরে ধীরে একটা ঘটনার সঙ্গে আরেকটা ঘটনা মেলাতে পারলাম। একের পর এক প্রমাণ পেলাম এবং সে যে আমাদের বোন সেই সত্যটা প্রতিষ্ঠিত হলো।
তিনি আরও বলেন, এর ফলে আমাদের আনন্দের সীমা রইল না। এরপরে আমরা যে কোন মূল্যে তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু আমাদের তো ভিসার সমস্যা ছিল।
কোথায় দেখা হলো: তারা যেসব জায়গায় মিলিত হতে পারেন বলে তাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল তার একটি ছিল শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক দেভকে। যেখানে সমাহিত করা হয়েছে সেই কর্তারপুর সাহিব গুরদুয়ারা মন্দির। এই গুরদুয়ারাটি পাকিস্তানের রাভি নদীর পারে নারোয়াল জেলায় যা ভারতের ডেরা বাবা নানকের মন্দির থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে।
এই কর্তারপুর করিডোরটি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে উদ্বোধন করেন। তারপর থেকে হাজার হাজার ভারতীয় তীর্থযাত্রী ভিসা ছাড়াই ওই করিডোর দিয়ে ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়েছেন।
দেশভাগের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কয়েকটি পরিবারও এই স্থানে একত্রিত হতে সক্ষম হয়েছে। তবে কোভিড মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে কর্তারপুরে তীর্থযাত্রা স্থগিত করা হয়। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে এটি পুনরায় খুলে দেওয়া হয়েছে।
এ বছর ২৪ এপ্রিল দুই ভাই তাদের পরিবার নিয়ে কর্তারপুর সাহিব গুরদুয়ারা মন্দিরে এসে পৌঁছান এবং তাদের বোনের সঙ্গে মিলিত হন। বোন মুমতাজ বিবিও তার পরিবার নিয়ে ওই মন্দিরে হাজির হয়েছিলেন।
বলদেভ সিং বলেন, আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরি এবং কাঁদতে থাকি। এসময় তার চোখ ছলছল করে উঠছিল।
তিনি বলেন, আমরা বিচ্ছিন্ন হতে চাইনি। আমরা পরস্পরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা ভিসা সংগ্রহ করবো। মুমতাজ বিবি সব ফর্ম পূরণ করেছে। আশা করছি সে আমাদের দেখতে খুব শীঘ্রই ভারতে আসবে।
মুমতাজ বিবি বেড়ে ওঠেছেন একজন মুসলিম হিসেবে। গুরমুখ সিং বলেন, আমাদের পরিবার তার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই আমরা এটি মেনে নিয়েছি। আমাদের ধমনীতে তো একই রক্ত বইছে।
তিনি বলেন, যখন আমাদের সাক্ষাৎ হলো তখন আমরা বাকি সবকিছু ভলে গিয়েছিলাম। আমাদের বোন মুসলিম, তাতে কী হয়েছে? তার ধমনীতেও একই রক্ত বইছে। আর সবকিছুর চাইতে এটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, এটা সত্য যে আমাদের জীবনধারা কিছুটা আলাদা। তারা পাকিস্তানে অনেক বেশি মাংস খায়, আমরা খুব কম খাই। কিন্তু গুরু নানক সব মানুষকে সমানভাবে গ্রহণ করার কথা বলে গেছেন।
মিলনস্থল এই শিখ মন্দির: গুরমুখ সিং বলেন, কর্তারপুর সাহিব গুরদুয়ারার মাধ্যমে আমাদের মতো বহু মানুষ তাদের হারিয়ে যাওয়া আত্মীয় স্বজনকে ফিরে পেয়েছে। তবে ভারত সরকারের কাছে তার একটি অনুরোধ আছে।
তিনি বলেন, তারা যেন কর্তারপুর সাহিবে যাওয়া এবং দুটো দেশের মধ্যে ভিসা নেয়ার প্রক্রিয়া আরো সহজ করে দেয়।
গুরমুখ সিং আরও বলেন, আমাদের দেখা হতে ৭৫ বছর লেগেছে। এখন আমরা বার বার দেখা করতে এবং একসাথে সময় কাটাতে চাই।
সূত্র: বিবিসি বাংলা