ঢাকা, রবিবার ২৪, নভেম্বর ২০২৪ ১৪:০৬:০৫ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

মরণ যাত্রা যেদিন যাবে!

জাহিদ আল আমীন

উইমেননিউজ২৪.কম

প্রকাশিত : ১০:৫৩ পিএম, ১৩ মার্চ ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ১১:৫০ পিএম, ২৯ মার্চ ২০১৮ বৃহস্পতিবার

অগোছালো লাগেজগুলো পড়ে আছে। বিধ্বস্ত বিমানটির আশেপাশে। আধপোড়া! যত্রতত্র! গতরাতে ঘুমুতে যাবার আগে কী ঘটা করেই না এই ব্যাগগুলো সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখে দিয়েছিলো। ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় টুকিটাকি সবকিছু দিয়ে।


খুব ভোরে উঠে বিমানবন্দরে পৌঁছাতে হবে। যাত্রার আগে আরেকবার হয়তো দেখে নিয়েছিলো। জরুরি কোনকিছু বাদ পড়লো কী না!


রওয়ানা দেবার আগে কেউ হয়তো ব্যালকনির ছোট বাগানটিতে একটু ঘুরে আসলো। গুন গুনাগুণ গাইতে গাইতে পরম মমতায় গাছের টবগুলোতে হয়তো কিছুটা জল ঢেলে দিয়েছিলো। এই অনুপস্থিতির দিনগুলোতে গাছগুলো যাতে মরে না যায়! ঘরের সবগুলো ইলেকট্রিক সুইচ বন্ধ করা হয়েছিলো। ফ্লাটের দরজাটায় তালা লাগানোর পরও আরো একবার হয়তো পরীক্ষা করে দেখেছিলো, সঠিকভাবে বন্ধ হয়েছে কী না! গাড়িতে ওঠার আগে বৃদ্ধ দারোয়ান কাকার হাতে ৫০ টাকার একটা নোট গুজে দিয়ে গৃহকর্তী হয়তো বলেছিলো-কাকু আমাদের বাসার দিকে খেয়াল রাখিয়েন। গাড়িতে উঠে শেষবারের মতো বাসার পানে হয়তো একবার তাকিয়েও ছিলো। তড়িঘড়ি এয়ারপোর্টে চেক-ইন করে বোর্ডিং পাস নিয়ে একটুখানি স্বস্তি! আরেকটু পরেই বিমানটি উড়াল দিবে। এই ফাকে মায়ের সঙ্গে কেউ হয়তো টেলিফোনে একটুখানি কথা বলে নিয়েছিলো। কেউ হয়তো একটা সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্টও করে দিয়েছিলো।


তারপর উড়লো! ধীরে ধীরে নেটওয়ার্কের বাইরে চলে গেলো! চিরতরে! বিমানবন্দরে এগিয়ে দিতে আসা কোন আপনজন হয়তো আকাশে উড়তে থাকা বিমানটির দিকে তাকিয়ে ছিলো, যতক্ষণ না দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে যায়!


কী চমৎকার সব প্রস্তুতি!


ছোট্ট যে শিশুটি বাবা-মায়ের সঙ্গে হিমালয় দর্শনে বেড়িয়েছিলো। সে হয়ত বেড়াতে যাবার আনন্দে ভাসছিলো। নিশ্চয় সে জানালার পাশে বসবে বলে বায়না ধরেছিলো। তার মনে কতো যে প্রশ্ন! ফিরে গিয়ে স্কুলের বন্ধুদের কাছে হিমালয় বিজয়ের গল্প করতে হবে না!


বিমানের জানালা থেকে আকাশের নীলিমায় শিল্পীর ছবি আঁকার ক্যানভাসের মতো ওই যে দূরে তুষার ঢাকা চির আরাধ্য শ্বেত-শুভ্র হিমালয়টাও দেখা যাচ্ছে। ভ্রমণ পিয়াসু মানুষগুলোর ফুরফুরে মন। সেই মনে কতো শতো প্ল্যান, পরিকল্পনা!


প্রথমবারের মতো নেপালে বেড়াতে আসা কোন নববধু হয়তো তার মেহেদী রাঙা হাতখানি লাজুক ভঙ্গিতে পাশে বসা স্বামীর হাতে রেখেছিলো। স্বামীটি তখন হয়তো বইয়ে পড়া, নেটে দেখা ছবির সঙ্গে এই সুউচ্চ মৌন পর্বতের শৃঙ্গগুলো অনুমান করে ঠাওর করার চেষ্টা করছিলো। অনুমানের ওপর ভর করেই হয়তো প্রিয়তমাকে মুগ্ধ করার প্রায়াসে দ্রুত অপসৃয়মান দৃশ্যগুলোর ধারা বিবরণী দিচ্ছিলো: কোনটা কাঞ্চনজঙ্ঘা, চমোলুংমা, মাকালু, ধবলগিরি; কোনটাইবা অন্নপূর্ণা! আর মাউন্ট এভারেস্টইবা কোনটা? এরই মধ্যে বিমান নোঙ্গর করার ঘোষণা এলো।


এতোক্ষণ ধরে শুনতে থাকা জগজিৎ সিংএর মায়াবী গজলের সুরে কারও হয়তো তাল কাটলো পাইলটের বেসুরো কণ্ঠস্বরে! কানের হেডফোন, চোখের সামনে মেলে ধরা বই অথবা সিনে ম্যাগাজিনটাও বন্ধ করে কেউ হয়তো সিটবেল্টে হাত রেখেছিলো কেবল।


তারপর ! তারপর ! তারপর....... বিকট কোন শব্দ, হঠাৎ কোন ঝাকুনি, চারদিকে ধোয়া, আগুনের দাউদাউ লেলিহান শিখা যেন ধেয়ে আসছে ...... চিৎকার করারও কোন ফুরসত মেলে নি! মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতির এতটুকুন সময়ও মিললো না! চোখের পলকে ঝরে গেলো পঞ্চাশটি তরতাজা প্রাণ।


মৃত্যু অবধারিত, চরম অনিশ্চিত। তাই বলে জীবন এতোটাই সহজ! ঠুনকো! এতো বেশি অনিশ্চিত !


এই দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের কাউকেই আমি চিনি না। কারো সম্পর্কে এর আগে কখনো শুনিও নি। এই দুর্ঘটনার স্থান থেকে আমার বসতি সাড়ে সাত হাজার মাইল দূরে! তবুও গতকাল থেকে সবকিছুতে অরুচি ধরে গেছে! ডিনারে কিছুই মুখে তুলতে পারি নি। চোখের সামনে এই মুখগুলি বারবার ভেসে উঠছে। বুকের মাঝে তীব্র হাহাকার। একটা অব্যক্ত কষ্ট যেন অক্টোপাসের মতো অষ্ঠেপৃষ্ঠে আকড়ে ধরেছে। এই অচেনা, অজানা মামুষগুলোকে পরম আত্নীয় মনে হচ্ছে।


চলুন! কল্পনার ঘুড়িটা আরেকটু উচুতে উড়িয়ে দেই! মনে করুন, এই কল্পনার `কেউ` টা আমি বা আপনি! কাঠমান্ডুতে বিধ্বস্ত হওয়া ওই বিমানটিতে আমরা যে কেউ থাকতে পারতাম! এতাক্ষণে হয়তো হলুদ পলিথিনে মোড়া আমাদের ছিন্নভিন্ন, নিথর দেহের চারপাশে তালেবে এলেমরা সুর করে সুরা ইয়াসীন পাঠ শুরু করে দিতো! আগরবাতির ধোয়া আর গোলাপ জলের গন্ধের মাঝে স্বজনহারা মানুষগুলোর বোবা কান্না আর হাহাকার চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তো! জীবন নামের এই নাট্যমঞ্চে আমরা প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ এমন অনবদ্য অভিনয় করে চলছি! এসবই কি মিথ্যা! ছলনা? যদি তাই হয়, তবে কেনো এই সত্যটাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করছি? সব জেনে-বুঝেও কেনো নিজের সঙ্গে প্রতারণা করছি? কেনো ক্ষণিকের দুনিয়া নিয়ে আমাদের এতো শত ব্যস্ততা? পরকালের অন্তহীন জীবনের জন্য আমরা কি প্রস্তুত? কী নিয়ে যাবো সর্ব শক্তিমান আল্লাহর কাছে, শেষ বিচারের ময়দানে?


পবিত্র কুরআন তো বার বার আমাদের সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় :
"কোন প্রাণসত্তা জানে না,
আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে?
এবং
কোন ব্যক্তির জানা নেই.
তার মৃত্যু কোন জমীনে হবে।" ---সূরা লোকমান ৩৪


"হে প্রশান্ত আত্মা! ফিরে চলো তোমার প্রভুর দিকে, সন্তুষ্ট চিত্তে ও সন্তোষভাজন অবস্থায়। অতঃপর প্রবেশ কর আমার বান্দাদের মধ্যে।
এবং প্রবেশ কর আমার জান্নাতে।" (সূরা ফজর: ২৭-৩০)

 

জাহিদ আল আমীন
ফ্রাইবুর্গ, জার্মানি
মার্চ ১৩, ২০১৮।