ঢাকা, রবিবার ২৪, নভেম্বর ২০২৪ ২০:২২:২২ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী

(ভূমিকা: পিটার হুদিস এবং কেভিন বি. এন্ডারসন) 

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০১:১৬ পিএম, ১৬ জুন ২০২২ বৃহস্পতিবার

রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী

রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী

পর্ব- ১৩: অনেক মানুষের দ্বারা জমির পর্যায়ক্রমিক পুনর্বন্টণ ও সীমানা অঙ্কনের পর এসব জমি কখনো কখনো আবার অব্যবহৃতও হয়ে পড়তো। খামারের কাজ সমেত মার্ক সম্প্রদায়ের সদস্যদের কাজ পুরোপুরি গোষ্ঠিগত কাজ হয়ে পড়লো এবং কঠোর নিয়ম-কানুনের মাধ্যমে খামারের কাজ সবার জন্য বাধ্যতামূলকও হলো। এর ফলে শুরুতে খামার জমির প্রতিটি অংশের মালিকের সাধারণ দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় খামারে কাজ করা যেহেতু মার্ক সম্প্রদায়ের জন্য নির্দিষ্ট আবাসন এলাকায় বসতি থাকাটাই সদস্য হবার জন্য যথেষ্ট ছিল না। যে কোন ব্যক্তি যদি বেশ কয়েক বছর ধরে তার জমি চাষ না করতো বা চাষে অবহেলা করতো, তবে সে এই জমির উপর তার মালিকানা চিরতরে হারাতো এবং মার্ক সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ তখন জমির মালিকানা অন্য কারো হাতে হস্তান্তর করতেন। এজন্য এই সম্প্রদায়ের ভেতরের কাজ-কর্ম কে কি করবে সবটাই গোষ্ঠিগত ভাবে নির্দ্ধারিত হতো। শুরুতে জার্মানরা বসতি স্থাপন করতো এবং জার্মানদের অর্থনৈতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল গবাদিপশুর দেখ-ভাল করা। গবাদিপশুর দেখ-ভালের এই কাজটি অবশ্য গোটা গোষ্ঠির জমি এবং তৃণভূমির উপরে সম্পন্ন হতো এবং গ্রামের পশুপালকেরা গোটা কাজের তত্ত্বাবধান করতেন। মূলত: ফসল কাটার পর পতিত জমিই গবাদিপশুর চারণক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। জমিতে বীজ বপন এবং ফসল তোলার সময়সূচি এবং প্রতি বছর প্রতিটি ক্ষেতে ফসল কাটা ও জমি অনাবাদী হয়ে পড়ার সময়ের পার্থক্যের কারণে গোষ্ঠিগত ভাবেই বীজ বপনের সময় ঠিক করা হতো এবং সম্প্রদায়ের সবাইকে গোষ্ঠিগত প্রতিটি নির্দেশ মেনে চলতে হতো। প্রতিটি জমির থাকতো একজন পরিদর্শক বা তত্ত্বাবধায়ক বা ভূমির অভিভাবক যাকে কিনা মার্ক জন-গোষ্ঠির যাবতীয় দাপ্তরিক কাজের নির্দ্ধারিত আদেশনামা মেনে চলতে হতো। ক্ষেত জুড়ে সমস্ত গ্রামগুলোর মানুষের দলবদ্ধ মিছিল রীতিমতো বড় অনুষ্ঠানে পরিণত হতো যে অনুষ্ঠানে সবাই বাড়ির শিশুদের নিয়ে আসতো। শিশুদের কাণে দাগিয়ে দেয়া হতো যেন তারা এরপরে জমির সীমানা মনে রাখতে পারে এবং স্বাক্ষ্য দিতে পারে।

গবাদিপশুর প্রজনন কাজের দেখা-শোনাও গোষ্ঠিতে সবাই মিলেই করা হতো, একক কোন ব্যক্তির পশুপাল দখলে রাখা সম্প্রদায় দ্বারাই ছিল নিষিদ্ধ। পশুর প্রকৃতি অনুযায়ী গ্রামের সব পশু কিছু সাধারণ পশুপালে ভাগ করা হতো এবং প্রতিটি পালের নেতা হিসেবে গোটা পশুপালের অগ্রভাগে গ্রামের একজন পশুচারক এবং একটি পশুকে রাখা হতো। এছাড়া সম্প্রদায়ের ভেতর এমনটাও নির্দেশ থাকতো যে যেন প্রতিটি পশুপালের সাথে একটি করে ঘন্টা থাকে। শিকার এবং মাছ ধরার অধিকারের মত বিষয়গুলোও মার্ক সম্প্রদায়ের ভেতর গোষ্ঠিগত ভাবেই নির্দ্ধারণ করা হতো। পেতল এবং অন্য যা কিছু মার্ক সম্প্রদায়ের আওতাধীন জমি থেকে খনন করে বের করা হতো এবং লাঙলের ফলা যতটা যায় তার চেয়েও আরো খানিকটা গভীর থেকে পাওয়া যেত এমন সব বস্তÍই সম্প্রদায়ের সামগ্রিক অধিকারে চলে যেত এবং কেউ এই পেতল বা মাটির অনেকটা গভীর থেকে কিছু খনন করে পেলেও তার অধিকারী হতো না। মার্ক সম্প্রদায়ের প্রতিটি আস্তানাতেই কারিগরদের থাকতে হতো। তবে কারিগররা থাকলেও প্রতিদিনের চাষাবাদ সংক্রান্ত কাজের দরকারী জিনিষগুলো চাষী পরিবারগুলো নিজেরাই বানিয়ে নিত। রুটি সেঁকা, মদ বানানো, সূতো কাটা ও বোনার কাজগুলো এই কৃষক পরিবারেরা নিজেরাই সম্পন্ন করতো। তবু কৃষিকাজের জন্য জরুরি কিছু বিশেষ যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য ধীরে ধীরে ধাতু শিল্পের উদ্ভব ও বিকাশ পরিলক্ষিত হলো। এভাবেই লোওয়ার স্যাক্সনির ওলপের গোষ্ঠিগত অরণ্যগুলোয় মার্ক সম্প্রদায়ের সদস্যরা ‘কারিগরদের ভেতর থেকে এর প্রতিটি শাখার কাজ জানা অন্তত: একজন করে মানুষকে পেতেন যে অরণ্য থেকে পাওয়া কাঠ নানা বস্তÍ থেকে অনেক কাজের জিনিষ বানাতে পারতেন।‘ অরণ্যর সুরক্ষা ও মার্ক সম্প্রদায়ের সদস্যদের জন্য দরকারী নানা জিনিষ বানাবার প্রয়োজন অনুসারে কারিগরদের জন্য কাঠের পরিমাণ ও প্রকৃতি নির্দ্ধারণ করা হতো। এই কারুশিল্পীরা মার্ক সম্প্রদায় থেকেই তাদের প্রয়োজনীয় সব কাজের রসদ পেতেন এবং গোষ্ঠির অন্যান্য মানুষ বা কৃষকদের মতই তাদের দৈনন্দিন জীবন নির্বাহ করতেন। তবু এই কারিগরদের কৃষকদের মত পূর্ণ অধিকার ছিল না। যেহেতু তারা কৃষকদের মত আদি থেকেই ভূমি-সংলগ্ন প্রকৃতির মানুষ ছিল না এবং খানিকটা যাযাবর বা ভবঘুরে প্রকৃতিই ছিল এদের চারিত্র্য। যেহেতু চাষাবাদের কাজে কারিগররা জরুরি বা প্রয়োজনীয় ছিলেন না অথচ চাষাবাদই ছিল সেসময়কার অর্থনৈতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু এবং কৃষিকাজকে কেন্দ্র করেই মার্ক সম্প্রদায়ের সদস্যদের অধিকার, তাদের জনজীবন এবং দায়িত্ব-কর্তব্য আবর্তিত হতো, সেহেতু কারিগররা কোনদিনই কৃষকের সমান গুরুত্ব পায়নি। এভাবেই মার্ক সম্প্রদায়ে প্রত্যেকেই যে তার নিজস্ব অধিকার অর্জন করতে পেরেছে এমন না। কোন বিদেশীকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সেই সিদ্ধান্ত মার্ক সম্প্রদায়ের সবার দ্বারা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হতে হতো। মার্ক সম্প্রদায়ের একজন সদস্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে হলেও সেটা অন্য কোন মার্কের কাছেই দিতে পারতেন এবং সেটাও গোটা মার্ক সম্প্রদায়ের বিচারসভার সামনে- কিন্তÍ কখনোই কোন বিদেশীর কাছে নয়।

পাদটীকা:

*             জর্জ ল্যুডউইগ ভন ম্যোরেরের ‘Geschichte der Markenverfassung in Deutschland)’ বইটি মার্ক সম্প্রদায় সম্পর্কে বিশদ ধারণা দেয় (এরল্যাঞ্জেন, ১৮৫৬), পৃষ্ঠা ১১৯।

*       হোমারের যুগে গ্রিক কারুশিল্পীদেরও হুবহু একই সামাজিক অবস্থান ছিল: ‘এই সকল মানুষ (ধাতুকর্মী, মিস্ত্রি, সঙ্গীতজ্ঞ ও চিকিৎসক) হলেন ‘demiurgoi ‘ (demos/ডেমস= জনতা সম্ভূত); অর্থাৎ তারা সম্প্রদায়ের সব মানুষের জন্য কাজ করে, নিজেদের জন্য নয়, তারা ব্যক্তিগত পরিসরে মুক্ত বা স্বাধীন, তবে তাদের সম্প্রদায়ের পূর্ণ সদস্য মনে করা হয় না; তাদের অবস্থান সম্প্রদায়ের মূল সদস্যবৃন্দ বা ক্ষুদ্র কৃষকদের নিচে)। এই কারিগর সম্প্রদায় খানিকটা যাযাবর চারিত্র্যের; তারা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পরিভ্রমণ করেন; যদি তাদের কোন নির্দিষ্ট নাম থাকে, তবে দূর থেকে তাদের ডাকা যেত।

(চলবে)