রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী
(ভূমিকা: পিটার হুদিস এবং কেভিন বি. এন্ডারসন)
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১২:১৪ পিএম, ১৩ জুলাই ২০২২ বুধবার
রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী
পর্ব- ১৫: এখন আমাদের দক্ষিণ আমেরিকার পুরণো ইনকা সাম্রাজ্যের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে দিন। ইনকা সাম্রাজ্যের যে এলাকাটি আজকের দিনের পেরু, বলিভিয়া এবং চিলিসহ মোট ২.১ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার আয়তন। এলাকাটি এক কোটি বিশ লাখ অধিবাসীসহ এক বিপুল ভূখন্ডের প্রতিনিধিত্ব করছে। সেটা মূলত: স্প্যানীশ বিজয় অভিযানের সময় পিজারোর নেতৃত্বে এই চেহারা লাভ করেছিল। পিজারোর অভিযানের আগেও বহু শতাব্দী ধরে এই ভূখন্ড নিশ্চিত তেমনটাই ছিল।
ইতিহাসের শুরুতে প্রাচীন জার্মানদের ভেতরে আমরা অনেকটা এই ধাঁচের সংগঠন দেখতে পাই। দক্ষিণ আমেরিকাতেও প্রায় শ‘খানেক মানুষের প্রতিটি উপজাতীয় সম্প্রদায়েরই নিজেদের সামরিকভাবে রক্ষা করার ক্ষমতা থাকতো। দক্ষিণ আমেরিকার এই গোত্রগুলোও অনাদিকাল থেকেই নিজ দখলে পেয়ে আসা ভূমির একটি অংশে আবাসন গড়ে তুলতো এবং এবং কৌতূহলোদ্দীপক শোনালেও তাদেরও নাম ছিল ‘মার্কা।‘ চাষের খামার অবশ্য পৃথক করা হতো, ছোট ছোট নানা ভাগে বিভক্ত এই জমি ফসল বপনের আগে পরিবারগুলোর ভেতরে ভাগ করে দেয়া হতো।
এক/একটি পরিবারের আয়তন অথবা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী এই জমির আয়তন নির্দ্ধারিত হতো। গ্রামের প্রধান মোড়ল বা মাতব্বর, সমাজে যার অবস্থান ইতোমধ্যেই অথবা সঠিকভাবে বলতে গেলে দশম ও একাদশ শতকে ইনকা সাম্রাজ্য গঠনের সময় নাগাদ নির্বাচিত অবস্থান থেকে উত্তরাধিকার সূত্রের হয়ে গেছে। বার্ষিক এই ফসল বপনের আগে সবচেয়ে বেশি জমি পেতেন। উত্তর পেরুতে বাড়ির পুরুষ প্রধান তার জমি একা একাই চাষ করত না; বরং দশজনের একটি দল একজন নেতার নির্দেশনায় জমি চাষ করতো।
এই ব্যবস্থাটিও জার্মান মার্ক সংগঠনের ব্যবস্থারই কাছাকাছি। দশজনের এই দলটি তাদের গোত্রের সব সদস্যের জমি পালা করে চাষ করতো। এমনকি যারা যুদ্ধে গিয়ে বা ইনকাদের জন্য বাধ্যতামূলক শ্রম দেবার কাজে ব্যস্ততার জন্য অনুপস্থিত থাকতো, তাদের জমিও কর্ষণ করে দেয়া হতো। প্রত্যেক পরিবারই তাদের জমিতে ফলা ফসল পেত। তবে, শুধুমাত্র মার্কে বসবাস করা এবং গোত্রের সদস্য পুরুষেরাই জমির একটি খন্ড পেত। তারা প্রত্যেকেই তার অংশের জমি চাষ করতে বাধ্য থাকতো।
কোন পুরুষ যদি তার জমি তিন বছর অনাবাদী বা পতিত রাখতো, তবে সে তার জমির অধিকার হারাতো। মেক্সিকোয় তিন বছর একটানা কেউ জমি অনাবাদী রাখলে জমির অধিকার হারাতো। জমির এই অংশগুলো বিক্রি করা বা কাউকে দান করা যেত না। গোত্রের সদস্যদের নিজের মার্ক ছেড়ে বাইরের কোন এলাকায় গিয়ে বসতি স্থাপন করা ছিল কঠোর ভাবে নিষেধ। গ্রামীণ এই গোত্রীয় সংগঠনগুলো কঠোর রক্তের সম্পর্কে আবদ্ধ থাকতো।
উপকূলীয় এলাকাগুলোয়, যেখানে মাঝে মাঝে শুধু বৃষ্টিপাত হতো সে সব এলাকায় কৃষিকাজের জন্য খালের মাধ্যমে কৃত্রিম জল সেচ করা দরকার হতো। এই খালগুলো গোটা গোত্রের সবার মিলিত পরিশ্রমে খনন করা হতো। সেচ কাজে জলের ব্যবহার এবং আলাদা আলাদা গ্রামগুলোর ভেতর এই জলের বন্টণের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম পালন করা হতো। প্রতিটি গ্রামেই ‘নি:স্বদের ক্ষেত‘ও থাকতো। এই ক্ষেতগুলো গোত্রের সবাই মিলে চাষ করে দেয়ার পর তার ফসল গ্রামের নেতারা বয়ষ্ক, বিধবা ও অন্যান্য অভাবী মানুষজনের ভেতর বণ্টণ করে দিত।
কৃষি জমি ব্যতীত গ্রামের বাকি জমিকে ‘মার্কাপাচা (সর্বজনীন ভূমি)‘ বলা হতো। দক্ষিণ আমেরিকার পাহাড়ি এই এলাকাগুলোয় ফসলী ক্ষেতের বাড়-বাড়ন্ত হওয়া স্বাভাবিক ভাবেই একটু কঠিন ছিল। সেখানে পরিমিত স্তরে পশুপালন চলতো। আর এই গৃহপালিত পশুদের ভেতর লামারই ছিল একচ্ছত্র রাজত্ব। দক্ষিণ আমেরিকার এই বিশেষ অঞ্চলের অধিবাসীদের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে লামার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই লামার পিঠে চেপেই দক্ষিণ আমেরিকার অধিবাসীদের জন্য বছরের নির্দিষ্ট সময়ে লামার পশম থেকে তৈরি উল উপত্যকার বাজারে যেত। উলের বিনিময়ে চাষীদের কাছ থেকে শস্য, মরিচ এবং সীম আনা হতো।
স্প্যানীশ অভিযানের সময় নাগাদ এই উপত্যকায় প্রচুর ব্যক্তিগত পশুপাল ছিল এবং পাহাড়ি এলাকায় ইতোমধ্যেই মানুষে মানুষে সম্পদের প্রভেদ তৈরি হয়েছিল। একজন সাধারণ মার্কের মালিকানায় যেখানে বড় জোর তিন থেকে দশটি লামা থাকতো, সেখানে গোত্রনেতার অধিকারে পঞ্চাশ থেকে একশোটি লামা থাকতো। শুধু বনভূমি, মৃত্তিকা ও চারণভূমি ছিল সবার সর্বজনীন সম্পত্তি এবং ব্যক্তিগত পশুপালের বাইরে গ্রামীণ পশুপালগুলো ভাগ করা যেত না। বছরের কোন কোন নির্দিষ্ট সময়ে গোত্রীয় পশুপালের কিছু অংশ জবাই করা হতো এবং এর মাংস ও উল গ্রামীণ পরিবারগুলোর ভেতর ভাগ করা হতো।
কোন নির্দিষ্ট কারুশিল্পী না থাকলেও প্রতিটি পরিবারই নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী নানা কিছু বানাতে পারতো। তবে দক্ষিণ আমেরিকার এই গ্রামগুলোর ভেতরে এক/একটি গ্রাম একটি বিশেষ ধরণের শিল্পে দক্ষ হতো। যেমন, তাঁতী, কুম্ভকার বা ধাতু শিল্পীদের কথা এ প্রসঙ্গে বলা যায়। যেহেতু গ্রামের প্রধান হতেন একজন গ্রামীণ নেতা, শুরুতে নির্বাচিত হলেও পরে যখন এটা জন্মসূত্রে উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া পদ হয়ে দাঁড়ালো, এই গ্রামীণ নেতাই গ্রামের চাষবাদের সব কিছু তদারকি করতেন। তবে এতদসত্ত্বেও গ্রামের বৃদ্ধদের সাথে সভা আয়োজনের মাধ্যমে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিতেন এবং শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে এই সভা ডাকা হতো।
টীকা: ইনকা সাম্রাজ্য আসলে উপরোল্লিখিত সময়েরও কয়েক শতক পরে গঠিত হয়েছিল।
(চলবে)