ঢাকা, মঙ্গলবার ২৬, নভেম্বর ২০২৪ ১২:২৮:৫৬ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

কিস্তি-২ : এদোযুগে সাকুরা

প্রবীর বিকাশ সরকার

উইমেননিউজ২৪.কম

প্রকাশিত : ০৯:০৩ পিএম, ১ এপ্রিল ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০৮:৪৯ পিএম, ৫ এপ্রিল ২০১৮ বৃহস্পতিবার

এদোযুগে সাকুরা :

এই যুগে (১৬০০-১৮৬৮) এসে সাকুরার প্রতি মানুষের আদরই শুধু বৃদ্ধি পায়নি, অভূতপূর্ব মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয় সে। ‘হানামি’ ধীরে ধীরে গণমানুষের উৎসেব পরিণত হতে শুরু করে। কেননা হানামি বরাবরই ছিল সমাজের উঁচু শ্রেণীর জন্য। কিন্তু এদোযুগে সমাজের শি-নোও-কোও-শোও=যোদ্ধা-কৃষক-কারিগর-ব্যবসায়ী-এই চারটি শ্রেণীর মধ্যে শেষোক্ত দুটি শ্রেণীর লোকজন অন্যান্য উৎসব, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি হানামি উপভোগ করার আরও বিস্তৃত সুযোগ লাভ করে। জাপানি সমাজে সর্বকালেই কৃষক শ্রেণী ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী শ্রেণী। এই শ্রেণীটি ছিল হেইমিন বা সাধারণ নাগরিক। এদোযুগে সর্বপ্রথম কারিগর, মিস্ত্রী ও ব্যবসায়ীদের সাধারণ নাগরিকের পদমর্যাদা দান করা হয়। ব্যবসায়ীরা প্রশাসন থেকে শুরু করে সমাজের সর্বত্র অপ্রতিরোধ্য প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় কালক্রমে। ফলে এদোযুগের সামুরাই বা সামন্ত শাসকগোষ্ঠীর আনন্দ-উৎসবে ব্যবসায়ীরাও অংশগ্রহণ করার অধিকার লাভ করেন। ব্যবসায়ীদের বাসভবন, বাগান, গ্রীষ্মাবাস, বাগানবাড়ি কিংবা উদ্যানে হানামি তথা সাকুরাউৎসবের আয়োজন করা সহজ হয়ে ওঠে। এভাবে সমাজের অর্থশালীরা সাকুরা বৃক্ষের তলে সুরায় মত্ত হয়ে হাইকু কবি মাৎসুও বাশোও, ফুজিওয়ারা প্রমুখের হাইকু আবৃত্তি করে, ওয়াকা গান গেয়ে হানামি উদ্যাপন করতেন। অন্যদিকে দরিদ্র মানুষ একই সময়ে কোন পানশালায় বা ‘রাকুগোইয়া’য় বা ‘কৌতুক গল্পকারের আসরে’ হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছেন এমন ছবি পাওয়া যায় এ যুগের সামাজিক ইতিহাসে।


এদোযুগে লিখিত ‘কোশোকু গোনিন্ নো ওননা’ গ্রন্থে সাকুরা বিষয়ক প্রেমময় বর্ণনা রয়েছে। সাকুরা এ যুগে মানুষের দেহমনে মিশে গিয়ে যেন প্রেমের দেবী হয়ে উঠেছে। তার চমৎকার প্রমাণ পাওয়া যায় এ যুগের শ্রেষ্ঠ হাইজিন মাৎসুও বাশোও রচিত হাইকুগুলোতে। তার বিখ্যাত হাইকুগুলো এই আমলে লিখিত। বাশোও রচিত ‘অকু নো হোসো মিচি’ গ্রন্থে সাকুরা ভাস্বর হয়ে আছে। বাশোও শুধু নন, আরও বহু কবি হাইকু, ওয়াকা গান, তানকা কবিতা লিখেছেন সাকুরাকে নিয়ে। এ যুগে নোহ্, কাবুকি থিয়েটার নতুন মর্যাদা লাভ করে। কাবুকির মঞ্চসজ্জায় সাকুরা বিপুল সৌন্দর্য নিয়ে সর্বদাই উপস্থিত। সাকুরা বিষয়ক গান নাটকের মধ্যে পরিবেশিত হয়েছে বারংবার।


এদোযুগ জাপানের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এ আমলে সমাজের সর্বত্র সাংস্কৃতিক আলোড়ন-আন্দোলনের চিত্র পাওয়া যায়। হাইকু, ওয়াকা, তানকা, কাবুকি, উকিয়োএ বা ছাপচিত্র, রাকুগো বা কৌতুক-গল্প, চাদোউ বা চা ক্রিয়ানুষ্ঠান, শোদোউ বা লিপিকলাচর্চা, তাঁতশিল্প, মৃৎশিল্প, ইকেবানা, বোনসাই ইত্যাদিতে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। আর বলা বাহুল্য, এসবের প্রত্যেকটিতে ছিল সাকুরার বৈচিত্র্যময় উপস্থিতি। এ সকল কারণে এ যুগকে বলা হয় ‘গেনরোকু জিদাই’ বা ‘স্বর্ণযুগ।’ বিশেষ করে পৃথিবী বিখ্যাত উকিয়োএ বা কাঠ খোদাই চিত্রকলার রং ও সূক্ষ্ম কারুকাজ সুপ্রতিষ্ঠিত পশ্চিমা চিত্রশিল্পীদেরও গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। যেমন ভ্যান্ গগ্। এই ছাপচিত্রের বিখ্যাত চিত্রকররা হচ্ছেন উতামারোও, কাৎসুশিকা হোকুসাই, হোরিশিগে প্রমুখ। উকিয়োএ মাস্টার উতামারোও কর্তৃক অঙ্কিত ‘Hideyoshi enjoying the cherry blossoms with his five concubines’ একটি সুবিখ্যাত শিল্পকর্ম। এই শিল্পীরা তাঁদের চিত্রে জাপানের নারী, কিমোনো, জানোমেকাসা বা জানোমে ছাতা এবং সাকুরার সমন্বয়ে এমন এক চিত্রময়তাকে ফুটিয়ে তুলেছেন যা সত্যিই অতুলনীয়। আর এখানেই উকিয়োএর বিশেষত্ব। হানামি এমনই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এ যুগের সামুরাই, শোউগুন, দাইমেয়ো বা সামন্ত যোদ্ধাদের পৃষ্ঠপোষকতায়, যে কারণে এ আমলে একটি কথা চালু হয়েছিল ‘ফুল থাকলে সাকুরা আর পুরুষ থাকলে বুশি বা যোদ্ধা।’


প্রবন্ধের শুরুতেই বলা হয়েছে, সাকুরা জাপানিদের দেহমনের সঙ্গে মিশে যাওয়া এক সংস্কৃতি। সাকুরার রূপ যেমন নরনারীর দৈহিক সৌন্দর্যচর্চা এবং বস্তুর শৈল্পিক চর্চায় বিশেষ ভূমিকা রেখে এসেছে অতীতকাল থেকে তেমনি করে প্রাচীন, প্রবীণ জাপানিদের মানসিক, আধ্যাত্মিক চেতনায় ভয়ানক রসবোধেরও বিস্তার ঘটিয়েছে। ‘ফুল থাকলে সাকুরা আর পুরুষ থাকলে যোদ্ধা’ এই প্রবচনটি মূলত সৃষ্টি হয়েছে সাকুরার অনন্য সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে মানসিক আন্দোলন থেকে। সাকুরার সৌন্দর্য প্রাচীন জাপানিদের মধ্যে বা এখনকার প্রবীণ জাপানি মানব জীবনের আয়ুষ্কালের সঙ্গে সাকুরার ক্ষণকালীন অস্তিত্বের তুলনা করতে প্রয়াস পেয়েছেন। সাকুরার অনিশ্চিত অস্তিত্ব, ক্ষণজন্মা জীবন বা তার দ্রুত পতনের সঙ্গে আপন জীবনের অনিশ্চিতয়তাকে একাকার করে ফেলে আহত, নিঃসঙ্গ অথবা আত্মহারা হওয়ার মতো মানসিকতা সম্ভবত বিশ্বের আর কোনও জাতির মধ্যেই দেখা যায় না। একে অনেকে অতিরিক্ত অভিব্যক্তি বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন বিশিষ্ট জার্মান সঙ্গীতজ্ঞ যোসেফ রোগেনর্ডফ্। মহিলা কথাসাহিত্যিক তাকাহাশি তাকাকোর উপন্যাস ‘লোনলি ওম্যান’-এ সাকুরাকে এক অশুভ উপলক্ষণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। রোগাক্রান্ত নায়িকা হাসপাতালের শয্যায় থেকে প্রাচীরসংলগ্ন ফুটন্ত সাকুরাকে পরোক্ষভাবে মৃত্যুর দূত হিসেবেই কল্পনা করেছেন। রক্ত-মাংশে-ক্লেদাক্ত আঁশটে মৃত্যুর স্বাদ যেন সে তার অস্তিত্বে অনুভূত হচ্ছে--এমনভাবে সাকুরার সৌন্দর্যকে ভয়ংকর রসে রঞ্জিত করা হয়েছে।


মেইজিযুগে সাকুরা :

মেইজিযুগের (১৮৬৮-১৯১২) সামাজিক বিপ্লব ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার সাধারণ মানুষের সকল অধিকারের দ্বার উম্মোচিত করে দেয়। সকল শ্রেণীর ভেদ-বিভেদ দূর করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালানো হয় রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে। স্বাধীনতা লাভ করে খেটেখাওয়া পদবীশূন্য মানুষজন। অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ডের মতন উচুঁ শ্রেণীর মানুষজনের সঙ্গে, নিম্নস্তরের লোকজন এই প্রথম একসঙ্গে হানামি উপভোগের সুযোগ লাভ করে রাষ্ট্রের সর্বত্র। যে সাকুরা শত-শত বছর ধরে কেবলমাত্র শাসক, যোদ্ধা ও অভিজাত শ্রেণীর একচেটিয়া আনন্দ-উৎসবের উৎস ছিল এবং ছিল তাঁদের দ্বারা সীমাবদ্ধ সেই সাকুরাউৎসব মেইজি-সংস্কারের বদৌলতে গণতান্ত্রিকভাবে সকল স্তরের নাগরিকের আনন্দ-বিনোদনের প্রাণবিন্দুতে পরিণত হয়। সাকুরা যে কতখানি আদরণীয় ফুল হয়ে ওঠে তার প্রমাণ একটি বাক্যে সুস্পষ্ট হয়ে যায়। আবালবৃদ্ধ এক বাক্যে বলে ওঠেন ‘সাকুরা ওয়া তোমোদাচি’ অর্থাৎ ‘সাকুরা হচ্ছে বন্ধু।’ মেইজিযুগ থেকে শুরু করে তাইশোযুগ (১৯১২-১৯২৬), শোওয়াযুগ (১৯২৬-১৯৮৯) পর্যন্ত অনেক গান রচিত হয়েছে সাকুরাকে নিয়ে। সবচেয়ে জনপ্রিয় যে গানটি এখনো সকল বয়সীদের কন্ঠে শোনা যায় সেটি হল, ‘সাকুরা, সাকুরা, ইয়ায়োনো সোরা গা....’. গানটি। প্রখ্যাত নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক তানাকা সুমিএ-র বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, এ গানটি শুধু জাপানেই নয়, ইতালী ভ্রমণকালে সেখানকার পত্রিকায় একটি সংবাদ দেখেন যে, এক দল জাপানি পর্যটক পোপ্ সকাশে ‘সাকুরা সাকুরা’ গানটি পরিবেশন করছেন। এছাড়াও য়োরোপের অন্যান্য দেশে থাকাকালীন অনেক রেস্তরাঁতে জাপানি অতিথির সম্মানার্থে ‘সাকুরা সাকুরা’ গানটি বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে বাজানো হয়ে থাকে। যুগের সাহিত্যে-শিল্পেও সাকুরা বারংবার এসেছে। তবে এসব ক্ষেত্রে ইয়ামাজাকুরা, ইয়ায়েজাকুরা ও শিদারেজাকুরা বেশ প্রাধান্য পেয়েছে। মেইজিযুগে এসে এ ধারা চরম উৎকর্ষতা লাভ করে।


মেইজির পর শোওয়াযুগে (১৯২৬-১৯৮৯) সাকুরাকে সাহিত্যে লালন করেছেন প্রায় সব লেখক। কাওয়াবাতা ইয়াসুনারি, সাকাগুচি আনগো, ইয়ামোমোতো শুগোরোও, নাগাই কাফু, শিমাজাকি তোওসোন, হিগুচি ইচিয়ো, আরিয়োশি সায়াকো প্রমুখ। ইচিয়োর ‘ইয়ামি জাকুরা’ একটি বিখ্যাত উপন্যাস। লেখা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে সাকুরা বিষয়ক অনেক ভ্রমণকাহিনী, উপন্যাস, তথ্যভিত্তিক গ্রন্থাদি। বসন্তকালে নামী-দামী ম্যাগাজিনগুলো সাকুরা নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রচার করা শোওয়াযুগের প্রকাশনা রীতির একটি অন্যতম দিক। (চলবে)