ঢাকা, শুক্রবার ২২, নভেম্বর ২০২৪ ২:০১:২৬ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী

(ভূমিকা: পিটার হুদিস এবং কেভিন বি. এন্ডারসন) 

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৯:৪৯ এএম, ১৭ আগস্ট ২০২২ বুধবার

রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী

রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী

পর্ব- ১৭: এভাবেই আদি ইনকা সাম্রাজ্যে একটি নির্দিষ্ট পরিসর অবধি আমরা দুটো সামাজিক স্তর দেখতে পাচ্ছি, একটি আর একটির উপরে। উভয় সংগঠনই যে যার সংগঠনগত দিক থেকে অভ্যন্তরীণভাবে সাম্যবাদী। তবে দুই সংগঠন মিলে আবার একটি বঞ্চনা ও পরাধীনতার সম্পর্কে আবদ্ধ বলেই মনে হয়। 

এমন ভাবনা শুরুতে দূর্বোধ্য মনে হতে পারে যেহেতু ইনকাদের সামাজিক সংগঠনকে আপাত:দৃষ্টে সমতা, ভ্রাতৃত্ব ও গণতন্ত্রের বিরোধী বলে মনে হবে যা জার্মানীর মার্ক সম্প্রদায়ের ভিত্তিভূমি। তবে একইসাথে আমাদের কাছে আসলে খুবই কম এবং জ্যান্ত প্রমাণ আছে যে বাস্তবে আদিম সাম্যবাদী সামাজিক সংগঠনগুলোর কতটা সাধারণ স্বাধীণতা এবং সমতা ছিল। 

সমতা, ভ্রাতৃত্ব বা গণতন্ত্রের মত আজকের সর্বজনসম্মত বা বৈধ ‘নীতিমালা‘ সকল বিমূর্ত মানুষের’ প্রতি প্রযোজ্য হয়েছে বা আরো সঠিকভাবে বললে সব ‘সভ্য’ দেশের মানুষের প্রতি বা পুঁজিবাদী সভ্যতার দেশগুলোর প্রতি প্রযোজ্য হয়েছে। 

এই  তো সেদিন- আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের এক বিলম্বিত সৃষ্টি এই নীতিমালা এবং পুঁজিবাদী দেশগুলেয় সঙ্ঘটিত বিপ্লব- ফরাসী বিপ্লব হোক আর মার্কিনী বিপ্লব- এই নীতিমালার কথা প্রথমবারের মত উচ্চারণ করে। তথাকথিত সভ্য এই জাতিগুলোর রক্তের রেখা ও মালিকানা যতদূর পর্যন্ত পরিব্যপ্ত হয়েছে, তত দূর অবধি অধিকারের সমতা ও স্বার্থের সংহতি অগ্রসর হয়েছে। 

এই দুয়ারগুলোর বাইরে যা কিছু ছিল- যেহেতু সেসব ছিল কোন গ্রামের দেয়ালের মত। অথবা বিস্তৃততম ভাবে বললে কোন একটি উপজাতি বা আদিবাসী গোত্রের আঞ্চলিক সীমারেখা। এর বাইরের সবকিছু ছিল বিদেশী এবং তাই বৈরী। 

প্রকৃতপক্ষে, অর্থনৈতিক সংহতির উপর নির্ভরশীল কোন সম্প্রদায়কে একইভাবে নির্মিত বা সংগঠিত অন্য কোন সম্প্রদায়ের সাথে স্বার্থের ভয়ানক সঙ্ঘর্ষে মুখোমুখি হবার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। আর তা হতে পারে উৎপাদনের নিচু স্তরের উন্নয়নের কারণে অথবা জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে খাদ্যের উৎস সমূহের ক্ষয় প্রভৃতি কারণেও। 

কঠিন লড়াই, যুদ্ধ প্রভৃতির মাধ্যমে অনেক সময়ই ঠিক করা হয়ে যেত যে যুদ্ধে প্রতিদ্বন্দী দুটো পক্ষের মধ্যে কোন একটি পক্ষ বিলুপ্ত হবে অথবা কিভাবে একটি শোষণ ও বঞ্চণা নির্ভর ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।  সমতা ও স্বাধীণতার বিমূর্ত নীতিমালার প্রতি আনুগত্য এই আদিম সাম্যবাদের ভিত্তি কাঠামো ছিল না। বরং একটি তুলনামূলক কম বিকশিত মানব সভ্যতার নিষ্ঠুর প্রয়োজন এবং প্রকৃতির মুখে অসহায় মানবতাই আদিম মানুষদের বাধ্য করতো একটি বৃহত্তর মৈত্রীর বন্ধনে সবাই একসাথে আবদ্ধ হয়ে থাকতে এবং নিয়মানুগ ভাবে কাজ করতে প্রেরণা যোগাত। 

এসবই তারা করতো শ্রম এবং জীবন সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা সহকারে যাতে করে তারা অস্তিত্বের একটি নিরঙ্কুশ ও সামগ্রিক শর্ত অর্জনে সক্ষম হয়। তবু শ্রমের ক্ষেত্রে সীমিত পরিকল্পনা এবং তুলনামূলক ক্ষুদ্র আয়তনের প্রাকৃতিক চারণভূমি অথবা পুনরুদ্ধারকৃত গ্রামীণ আবাসনে কাজের তুলনায় প্রকৃতির উপর সেই একই সীমিত মাত্রার নিয়ন্ত্রণ আদিম মানুষদের বৃহত্তর মাত্রায় সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুপযুক্ত করে তুলেছিল। 

সেই সময়ে কৃষির সেই প্রাগৈতিহাসিক দশা একটি গ্রামীণ মার্ক জনসম্প্রদায় গড়ে তোলার চেয়ে বৃহত্তর কোন সংস্কৃতি গঠনের উপযুক্ত ছিল না, আর মূলত: সেজন্যই সম্প্রদায়গত স্বার্থের ঐক্যে তাদের বিচ্যূতির মাত্রা ছিল খুবই কম। শেষত:, এটা ছিল শ্রম উৎপাদনশীলতার সেই একই অপর্যাপ্ত বিকাশ যা ব্যক্তিগত সামাজিক জোটসমূহের ভেতর পর্যায়ক্রমিক দ্বন্দ তৈরি করেছে। এভাবেই সমাজের পাশব শক্তিকে এসব দ্বন্দ নিরসনের ঢাল হিসেবেই শুধু ব্যবহার করেছে। আর এভাবেই যুদ্ধ হয়ে উঠলো সামাজিক সম্প্রদায়সমূহের ভেতর দ্বন্দ নিরসনের এক চিরস্থায়ী পন্থা। 

প্রকৃতির উপর মানুষের চূড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা না পাওয়া পর্যন্ত যে পন্থা শ্রম উৎপাদনশীলতার সর্বোচ্চ বিকাশ পর্যন্ত প্রাধান্য পাবে- আর প্রকৃতির উপর মানুষের চূড়ান্ত আধিপত্য কায়েমই মানুষে মানুষে স্বার্থের বস্তÍগত দ্বন্দের অবসান ঘটায়। 

যদি বিভিন্ন আদিম সাম্যবাদী সমাজের সঙ্ঘর্ষ সত্যিই একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে থাকতো, তবে শ্রম উৎপাদনশীলতার সমানুপাতিক বিকাশ যার যার নিজস্ব ফলাফল নির্দ্ধারণ করত। উদাহরণস্বরূপ, দুটো পারষ্পরিক যাযাবর ও পশুচারণকারী সম্প্রদায়ের ভেতর যখন গবাদিপশুর চারণভূমি নিয়ে লড়াই শুরু হতো, তখন একমাত্র নিষ্ঠুর শক্তির ব্যবহারই বলে দিতে পারত যে কে এই জমির মালিক হবে এবং কারা খরা-ক্লিষ্ট, বৈরী অঞ্চলে বিতাড়িত হবে অথবা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। 

তবু যেখানে কৃষি সেই এলাকার পুরো শ্রমশক্তিকে ব্যবহার না করেই এবং সব মানুষের গোটা আয়ুষ্কাল কাজে না লাগিয়েই সবাইকে খাইয়ে-পরিয়ে রাখার মত বিকশিত হয়েছে, তেমন সব অঞ্চলেও বিদেশী বিজেতাদের মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের একটি নিয়মানুগ বা প্রণালীবদ্ধ বঞ্চণার একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 

আর এভাবেই আমরা দেখতে পাই, কিভাবে পেরুতে একটি সাম্যবাদী আদিম সমাজ আর একটি সাম্যবাদী আদিম সমাজের শোষক হয়ে ওঠে।  
(চলবে)