ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২১, নভেম্বর ২০২৪ ২২:৪৭:১১ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

চীনের চিঠি: মেঘ-পাহাড়ের দেশে, বেইজিং থেকে ছাংশা

আইরীন নিয়াজী মান্না

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:৪৮ এএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০২২ মঙ্গলবার

ছাংশার একটি গ্যাস স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন লেখক।

ছাংশার একটি গ্যাস স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন লেখক।

বেইজিং থেকে ছাংশা, ২৮ জুলাই ২০১৫: আদি সভ্যতার দেশ চীন।পৃথিবীর একমাত্র দেশ যার সীমানা প্রাচীর দিয়ে নির্ধারণ করা। মেঘ-পাহাড়-হ্রদ আর সমুদ্র এ দেশের পাহাড়ী সৌন্দর্যকে বর্ণীল করে তুলেছে।প্রায় পাঁচ হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস তাদের। সে ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে শুধু রাজধানী বেইজিংয়েই রয়েছে ছয়টি ঐতিহাসিক রাজবাড়ি। 
২০১৫ সালের কথা। প্রায় বছর ঘুরতে চললো চীনে এসেছি।  ফরেন এক্সপার্ট হিসেবে চীন আন্তর্জাতিক বেতারের (সিআরআই) বাংলা বিভাগে চাকরি করছি। চীনের আসার পর রাজধানী বেইজিংয়ের বাইরে কোথাও যাওয়াই হয়নি।  প্রত্যাশা ছিলো যাবো।  সেই প্রত্যাশা পূরণ হলো অপ্রত্যাশিতভাবে।  চীনা সহকর্মী  ওয়াং চুই ইয়াং (জিনিয়া) সেদিন জানালো আমাদের বিভাগের প্রধান ম্যাডাম ইউ (আনন্দী) হুনান প্রদেশে একটি ট্যুরের জন্য আমাকে নির্বাচন করেছেন। চমত্কৃত হলাম সংবাদটি শুনে। চীনের মহান নেতা কমরেড মাও সে তুং-এর জন্মস্থান হুনানের শাওশান। চীনের এই মহান নেতার জীবন ও রাজনীতি নিয়ে একটি বড় জীবনীগ্রন্থ লেখা শুরু করেছি। আহা কি অপূর্ব সুযোগ! তার জন্মভূমিতে যাবো আমি!
ম্যাডামের সাথে কথা বলে সব ঠিকঠাক করে ২৮ জুলাই আমরা বেড়িয়ে পরলাম। দলে আমরা তিনজন। আমি এবং চীনা সহকর্মী লি ওয়ান লু (শিশির) ও ওয়াং চুই ইয়াং (জিনিয়া)। ঠিকানা বেইজং বিমান বন্দর। বেইজিং থেকে যাবো হুনান প্রদেশের রাজধানী ছাংশায়। সেখান থেকে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতে যাবো। 
চীন-বাংলাদেশে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সাংস্কৃতিক উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে চিত্রশিল্পীদের একটি দল এসেছে হুনানে। তাদের সাথে অবস্থান করে আমাদের সংবাদ সংগ্রহ করতেই হুনানের পথে ছুটে যাওয়া। ওই শিল্পীদের সাথে আমরাও বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াবো।
ভোর ছটায় বেইজিং বিমানবন্দরে পৌঁছে জানা গেলো হুনানের রাজধানী ছাংশাগামী চায়না এয়ারের ফ্লাইট খারাপ আবহাওয়ার কারণে দেরি হবে আসতে। যথারীতি বিমানবন্দরে বসে বসে অপেক্ষার পালা। অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে বিমান এসে পৌঁছালো দুপুর সোয়া দুইটায়। আমরা ছাংশার পথে যাত্রা শুরু করলাম আড়াইটায়।
আড়াই ঘন্টার বিমানযাত্রা শেষে আমরা অবশেষে পৌঁছালাম ছাংশা, হুনান আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে।  ঘড়ির কাটায় তখন পাঁচটার বেশি বাজে। বিমান বন্দরে আগে থেকেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন চীনা নাগরিক মিস্টার লি।  তিনি আমাদের সযতনে নিয়ে গেলেন ছাংশা শহরের সান হে হোটেলে। এ হোটেলেই উঠেছেন বাংলাদেশ থেকে আসা অতিথিরা।
আমরা হোটেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ডিনারের সময় হয়ে গেলো।  মিস্টার লি জানালেন ডিনার টেবিলে অতিথিরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। অগত্যা কি আর করা। গাড়ি থেকে নেমে মিষ্টার লিকে অনুসরণ করে আমরা সরাসরি ডাইনিং রুমের দিকে চলে গেলাম। সেখানে এই ট্যুরের প্রধান গাইড হুনান বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা শিক্ষার্থী ন্যান্সি আমাদের স্বাগত জানালেন। 
ডাইনিং হলে ঢুকতেই দেখি অতিথিরা বসে আছেন। ভাব-বিনিময়ের পর তারা যখন জানলেন আমি বাংলাদেশী সকলে আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন। বিদেশ-বিভুইয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে একজন স্বদেশীর দেখা পেয়ে তাদের অনেকরই চোখ ছলছল করে উঠলো। খেতে খেতে গল্প জমতে লাগলো পুরো দমে।বিরাট খাবার টেবিলের ও প্রান্তে শিশির আর জিনিয়াও গল্প জমিয়ে ফেলেছে অতিথিদের সাথে। গল্পের ফাঁকে কয়েকজন জানালেন প্রথমে আমাকে দেখে তারা মনে করছিলেন আমি ভারতীয়। পরে আমার মুখে বাংলা শুনে তারা আনন্দিত হয়ে ওঠেন। আর আমি অনেক দিন পর এতোজন বাংলাদেশীকে একসাথে দেখে বিচলিত হয়ে উঠলাম।
আলাপে আলাপে জানা গেলো এই সাতজন চিত্রশিল্পী বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী। তাদের সাথে দলপতি হিসেবে আছেন বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন তালুকদার এবং এই কর্মশালার বাংলাদেশী আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-চীন ফ্রেন্ডশীপ সেন্টারেরভাইস প্রেসিডেন্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) তাওহীদ।
‘বিউটুফুল চায়না-বিউটিফুল বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ ট্যুরে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশী শিল্পীরা হলেন আনিসুল হক, মোহাম্মদ ইব্রাহীম, মুস্তাহিদা রেহমান কিরণ, সুমন কুমার সরকার, সজল চন্দ্র নাথ, শাপলা সিংহ, মো. বকুল মিয়া। 

ছাংশা শহর, ২৯ জুলাই ২০১৫: এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে ফিরতে ফিরতে পথে দেখছিলাম রাজধানী ছাংশার রূপ ও সৌন্দর্য। হুনান পাহাড়ী এলাকা। চীনের একটি অন্যতম পর্যটন প্রদেশ। বেইজং থেকে বারো শ মাইল দূরে। ছাংশায় পাহাড় কেটে কেটে শহর গড়ে তোলা হয়েছে। আকাশ ছোঁয়া বিশাল বিশাল অট্টালিকা আর প্রশস্ত রাস্তার শহর ছাংশা। রাস্তার দু’ধার ধরে নানা রকম দোকানপাট। সারা শহরজুড়ে সবুজায়ন দেখে মুগ্ধ হলাম। রংবেরংয়ের ফুল ফুঁটে আছে গাছে গাছে। চকচকে আলো ঝলমলে শহরটি দেখে মনে হলো হংকং বা সিঙ্গাপুরের মতো। শিশির জানালো এই শহরকে দুভাগ করে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে ছিয়াং নদী। পূর্ব দিকে পুরাতন শহর এবং পশ্চিম দিকে নতুন শহর। একাধিক ব্রীজ দিয়ে শহরের দুই অংশের সাথে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে।
ডিনার শেষে নিজের রুমের দিকে গেলাম। গাইড ন্যান্সি এবং আমার জন্য হোটেলে একটি রুম বরাদ্দ ছিলো। ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়েই কাটলো রাত। সকালে ঘুম ভেঙ্গে ন্যান্সি জানালো নাস্তা শেষ করে আমরা যাবো ছাংশা শা ওয়ান সাবওয়েস্টেশনে। সেখানে বাংলাদেশের শিল্পীদের সাথে চীনা সাংবাদিকরা কথা বলবে। পাতাল ট্রেনে বাংলাদেশী এবং চীনা শিল্পীদের এক অভিনব ভ্রাম্যমান চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশের সাত শিল্পীর চৌদ্দটি চিত্রকর্ম ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে সারা ট্রেনের বগিতে বগিতে। প্রতিটি বগিতে বাংলা বর্ণমালা দিয়ে লেখা রয়েছে বাংলা-চীন বন্ধুত্ব শব্দটি। ট্রেনের দেয়ালা দেয়ালে লেখা রয়েছে লাল রঙে বাংলা বর্ণমালা অ-অ-ক-খ। এত চমত্কার আয়োজন দেখে আমি অভিভূত। ট্রেনের ওয়ালে নিজের মাতৃভাষা দেখে চোখ ছলছল করে উঠলো।
আমরা ট্রেনে চড়ে বসেছি। চীনা যাত্রিতে সারা ট্রেন ভরা। এ ট্রেন আমাদের বুকে ধারণ করে পাঁচটি স্টেশন ঘুরবে। চীনা সাংবাদিকরা ঘুরে ঘুরে কথা বলছেন আমাদের শিল্পীদের সাথে। ক্লিক ক্লিক করে জ্বলে উঠছে ক্যামেরার আলো।টিভি ক্যামেরা ঘুরছে এদিক-ওদিক। 
আমার এবং আমার সহকর্মী দুজনের কাজও শুরু হয়ে গেছে। সহকর্মী শিশির আর জিনিয়া চীনা নাগরিকদের সাথে কথা বলে তাদের অনুভূতি জানার চেষ্টা করছেন। যাত্রিরা প্রথমে এ আয়োজনের বিষয়ে কিছুই জানতেন না। পরে তারা এত বিদেশী দেখে এবং সাংবাদিকদের তৎপরতা দেখে বুঝতে পারলেন কিছু একটা হচ্ছে।  তারা অভিভূত হয়ে বাংলাদেশের শিল্পীদের কাজ দেখতে লাগলেন।
এক মধ্যবয়সি চীনা যাত্রির মাথার ওপরই ঝুলছিলো বাংলাদেশের সবচেয়ে কম বয়সী শিল্পী শাপলা সিংহর আঁকা ছবিটি। আমি তাকে তা দেখিয়ে প্রশ্ন করলাম কেমন লাগছে। তিনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বললেন, বাহ্ বেশ ভাল। আমি প্রথমে বুঝতেই পারিনি কি হচ্ছে। এত টিভি ক্যামেরা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এখন খুবই আনন্দ হচ্ছে। ভাগ্যিস এই ট্রেনেই আমি চড়েছি।
এই ব্যতিক্রধর্মী প্রদর্শনী পাতালট্রেনে ভ্রমণকারী ছাংশাবাসীর মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে লক্ষ্য করলাম। তাদের চোখে-মুখে তৃপ্তির ছোঁয়া। যাত্রিরা অনেকেই এগিয়ে এসে আমাদের শিল্পীদের সাথে ছবি তুললেন। তাদের কাজগুলোর পাশে দাড়িয়ে সেলফি তুললেন অনেক যাত্রি।
এক ঘন্টা পাতাল ট্রেন ভ্রমণ শেষে আমরা গেলাম ছাংশা সেন্ট্রাল পার্কে। সে কি অপরূপ পার্ক। সে কি বিশাল তার আয়তন।পুরো পার্কটি চারদিকে একটিহ্রদ দিয়ে ঘেরা দ্বীপের মতো।পার্কে ঢুকতেই মহান নেতা কমরেড মাও সে তুং-এর বিশাল আকৃতির অবক্ষ মূর্তি। এতো বিশাল মূর্তি যেন আকাশ ছুঁয়েছে। প্রিয় এই নেতার সাথে ছবি তুলতে আমরা মত্ত হয়ে গেলাম। তারপর ট্রয় ট্রেনে চড়ে ঘুরে বেড়ালাম সারা পার্ক। কারো ছবি তোলা আর বন্ধ নেই।
দুপুরের খর রোদ মাথায় নিয়ে আমরা ফিরে এলাম হোটেলে।এ সময়টায় প্রচন্ড গরম হুনান প্রদেশে। লাঞ্চ শেষে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমাদের যেতে হবে হোটেলের পাশেই ‘হুনান পেইন্টিং একাডেমি’তে। সেখানে বাংলাদেশের সাত শিল্পীসহ চীনা পঁচাত্তরজন শিল্পীর কাজ নিয়ে এক বিশাল আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে।
বেলা ৩ টায় আমরা হুনান পেইন্টিং একাডেমির ‘হো উইয়েন’ গ্যালারীতে উপস্থিত হলাম। হোটেলের ঠিক পাশেই দুটো বিল্ডিং পরেই এই বিশাল প্রতিষ্ঠান।
এখানে বাংলাদেশের চীন দূতাবাস ও বাংলাদেশ-চীন ফ্রেন্ডশীপ সেন্টারের যৌথভাবে বর্ণাঢ্য এ চিত্রপ্রদর্শনী আয়োজন করা হয়েছে।যথা সময়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাত দিনব্যাপী এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হলো। 
এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখলেন বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চরুকলা বিভাগের চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন তালুকদার, বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশীপ সেন্টারের ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) তাওহীদ, হুনান প্রদেশের সাংস্কৃতিক ইউনিয়ের ভাইস চেয়ারম্যান লিউ লয়ুন, হুনান নরমাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের প্রধান চু সুন তে এবং বাংলাদেশের শিল্পী শাপলা সিংহ।  
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা বললেন, আমরা অনুপ্রাণীত এবং আপ্লুত। এ ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দু’দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময় বৃদ্ধির পাশাপাশি বন্ধুত্বের হাত আরো প্রসারিত করা সম্ভব। 
প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের সাত শিল্পীর ১০টি কাজ সুযোগ পেয়েছে। এছাড়াও চীনা ৭৫জন শিল্পীর ৮০টি কাজ স্থান পেয়েছে। দু’দেশের শিল্পীরা তেলরঙ, জলরঙ ও অ্যাক্রেলিক মাধ্যমে আঁকা ছবিগুলোতে নিজস্ব দেশের স্বকীয়তা, প্রকৃতি ও পরিবেশকে উপস্থাপন করেছেন।আমরা গ্যালারী ঘুরে ঘুরে দেশী-বিদেশী শিল্পীদের কাজ দেখতে শুরু করলাম। চীনা শিল্পীদেরকয়েকটা ভাস্কর্য কাছে থেকে দেখার চেষ্টা করলাম। বেশির ভাগই বৌদ্ধের মূর্তি। বিভিন্ন আকৃতি ও মাধ্যমের।একটা কাজের দিকে চোখ আকৃষ্ট হলো। কয়েকটা ছোট ছোট নারীমূর্তি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে নাচের ভঙ্গি করে। কোনো মূর্তিরই হাত নেই। আরেকটু কাছে গিয়ে ভাল মত দেখি প্রত্যেকটা মূর্তি একই ভঙ্গিতে দাঁড়ালেও একেকটা মূর্তির হাতের ও পায়ের পজিশন আলাদা। এই মূর্তিগুলো একসাথে দেখে প্রথম মনে হয়েছিল মডার্ন ভাস্কর্য কিন্তু কাছে গিয়ে দেখি পুরানো একটা ফর্ম। আমার একটু আগ্রহ হল জানতে যে চীনা আধুনিক শিল্পচর্চার ধরনটা তাহলে কী? এখানকার শিল্পচর্চা কি মূলত ধর্মকেন্দ্রিক?
আমরা হোটেলের দিকে রওয়ানা দিলাম। আজ প্রদর্শনী উদ্বোধন উপলক্ষে বিশাল ডিনারের আয়োজন করেছে ন্যান্সি। হোটেলে প্রায় চলে এসেছি তখন মনে হল একটু হ্যান্ডিক্রাফটের দোকানগুলো ঘুরে গেলে কেমন হয়। ভাবলাম ডিনারের পর সবাই এক সাথে যাবো।
কিন্তু পরে গিয়ে দেখি ততক্ষণে সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু দোকান খোলা দেখা যাচ্ছিল, দেখে ঢুকলাম। কিন্ত গিয়ে বুঝলাম এগুলো টুরিস্টদের দোকান নয়। এখানে পাওয়া যায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যবহার্য্য জিনিস। কী ধরনের কাপড় বা জিনিসপত্র ছাংশাবাসী ব্যবহার করে সেটা বোঝার জন্য একটু ঘুরাঘুরি করলাম।গ্যালারীর ঠিক নিচে দুয়েকটি রং-তুলির দোকান তখনো খোলা ছিলো। তরুণ শিল্পীরা সেখান থেকে তাদের প্রয়োজনীয় কিছু ক্যানভাস ক্লথ, রঙ আর তুলি কিনলো। আমিও একটি তুলি কিনলাম আর্টিস্ট ছোট বোনের জন্য।
পথের পাশের একটি ফলের দোকানে গিয়ে ঢুকলাম আমরা। ওরা বিভিন্ন ফল ধরে ধরে দেখতে লাগলো। আমি কিছু ফল কিনে ওখানেই খাওয়ালাম ওদের। দোকানী মেয়েটি বিদেশী দেখে আগ্রহ করে আমাদের পিচ ফলগুলো কেটে কেটে দিলো। বেশ অনেকটা সময় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে গল্প করলাম আমরা।

থাও ইউয়ানের পথে, ৩০ জুলাই: আমরা আজ ছাংশা ছেড়ে যাবো। সকাল সাড়ে আটটায় নিচে নেমে দেখি হোটেল প্রাঙ্গণে বিশাল এসি বাস অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। বাসে উঠে বসলাম। থাও ইউয়েন শহরে যাবো আমরা। থাও ইউয়েন একটি ছোট্ট প্রশাসনিক শহর। সেখানে জেলা প্রশাসক আমাদের শিল্পীদের একটি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংবর্ধণা দেবেন।
যখন গাড়ি চলতে শুরু করল পাহাড়ি রাস্তার আঁকাবাঁকা ঢাল দিয়ে থাও ইউয়েন শহরের দিকে। যত বেলা যায় রোদের তেজ তত বাড়তে থাকে। ন্যান্সি একটি মাইক্রোফোন এগিয়ে দিয়ে বললো, তোমরা গান শুরু করো। মতিন স্যারের নেতৃত্বে শুরু হলো গান গাওয়া। একে একে চলছে দেশের গান, মায়ের গান। চীনা কয়েকজন চিত্রশিল্পীও বেশ ভরাট কণ্ঠে গান গাইলেন। দেশী-বিদেশী সকলেই গান গাইছে। হল্লা করতে করতে আমরা ছুটে চলেছি অজানার পথে।
এমন সময় মতিন স্যার বললেন, মায়ের গান কেন বেশি গাইছি জানো? বিদেশে এলে মায়ের কথা বেশি মনে পড়ে। মা আর মাতৃভূমি এক বিষয়। আমাদের যেন একটু মন খারাপ হয়ে গেলো। আমার মনে পড়ে গেলো আমার মায়ের স্নিগ্ধ চেহারাটা। সদ্য প্রয়াত মায়ের কথা মনে করে চোখ যেন ভিজে উঠলো। পাশে বসা বাংলাদেশী বাইশ বছর বয়সী শিল্পী শাপলা বললো, আপু আমার কষ্ট হচ্ছে মায়ের জন্য। ওর চোখে জল। নিজের আবেগ লুকিয়ে রেখে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, তোমার মা ভাল আছেন। কদিন পরেই তো ফিরে যাবে। মন খারাপ করো না। শাপলা বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বাইরের দিকে। 
শহর ছেড়ে গাড়ি যখন গ্রামের পাহাড়ি রাস্তা ধরে যাচ্ছে তখন দেখি রাস্তার ধারে টেবিলের উপর বিভিন্ন প্রকার ফল সাজিয়ে বসে আছে নারীরা। তার পিছনে জলজলে সূর্যটা পাইন গাছ আর শুকিয়ে যাওয়া আপেল গাছের মাঝখান থেকে উঁকি দিচ্ছে। আমরা যেই পাহাড়ের উপর দিয়ে যাচ্ছি সেটাতে ব্লু পাইন গাছ বেশি। কিন্তু দূরে পাহাড়ের উপরে যে পাইন গাছ দেখা যাছে তার জাতটা আবার ভিন্ন। 
পাইন গাছ দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছালাম একটা রাস্তার বাঁকে। এখান থেকে দূরে বিভিন্ন ধরনের পাহাড় দেখা যায়। সবচাইতে কাছেরগুলি সবুজ আর বাদামি,তার পরের সারি নীল এবং তার পরের সারি কালো। নাম না জানা সেই সব পাহাড়ের চূড়ার মাথায় প্রখর সূর্য স্থির দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের চোখ চলে যায় সেইসব অজানা সবুজ পাহাড়ের দিকে। বান্দরবান এবং দার্জিলিংয়ে এরকম সারি সারি পাহাড়ের দৃশ্য দেখা যায়।এইসব দৃশ্য আমাদের এত টানে কেন?এই সব দৃশ্য কেন এত রহস্যে ঢাকা?এর মধ্যে কি লুকিয়ে আছে আমাদের জন্ম মৃত্যু,আমাদের আগের ও পরের জন্ম?
প্রায় দুই ঘন্টা চলার পর আমরা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে পৌঁছালাম। আরেকটা সুন্দর শহর চোখের সামনে হাজির হলো তার প্রাণ নিয়ে। এই প্রাণটি হলো এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া নীল রঙের নদী। উপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে একটা নীল সাপ এঁকেবেঁকে হেঁটে যাচ্ছে। এই নদী যেন এই সবগুলি পাহাড়ের প্রাণ।
একটি বিশাল হল রুম যেন মিনি সংসদ। হল রুমের মাঝখানে বৃত্তাকৃতির বড় টেবিল বিছানো। দুই দল নেতাসহ শিল্পীদের নিয়ে জেলা প্রশাসক উইলুং ও তার সঙ্গীরা বসলেন সেখানে। আমরা অন্য সব অতিথিরা গিয়ে বসলাম গ্যালারীতে। সংক্ষিপ্ত আলোচনা হলো। বাংলাদেশের পক্ষে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) তাওহীদ এবং শিল্পী শাপলা সিংহ বক্তব্য রাখলেন।জেলা প্রশাসক মিসেস উইলুংবার বার আমাদের ধন্যবাদ জানালেন সেখানে যাওয়ার জন্য। দুপুরে সেখানে সুস্বাদু অনেক পদের খাবার দিয়ে আমরা লাঞ্চ করলাম। তারপর আবার শুরু হলো পথচলা।

থাও ইউয়ান থেকে ই ওয়াং , ৩০ জুলাই: আবার শুরু হল আমাদের যাত্রা পাহাড়ি রাস্তায়। আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করলো ই ওয়াংয়ের উদ্দ্যেশে। পাহাড়ি পথ, চিকন একটা নদী সুতার মত পাহাড়গুলিকে যেন এক সাথে বেঁধে রেখেছে। 
আজকের দিনটা বেশ উজ্জ্বল। গরমে বেশ আজ। পাহাড়ের কাঁধ ঘেঁষে রোদ এসে চিকচিক করছে নদীর পানি। দূরে দেখা যায় পাহাড়ের চূড়া। এর মধ্যে ঘর বেঁধে বসে আছে গাঁয়ের মানুষ। এরা এখানে বেশির ভাগ কৃষি কাজ করে। ধান এবং চা এদের প্রধান উত্পাদিত পণ্য। এখন কোনো আবাদী ক্ষেত দেখা যাচ্ছে না সেরকম। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে এখানের মানুষের প্রধান কাজ কৃষিকাজ, পশুপালন আর সব্জিবাগান করা। আমরা একটি ছোট্ট গ্রামে প্রবেশ করলাম।  নাম ই ওয়াং। গাড়ি গিয়ে থামল একটা রিসোর্টের সামনে। নাম ‘ই ওয়াং রিসোর্ট’। রিসোর্টের সামনে খোলা জায়গায় রোদ খেলা করছে। কাঠের তৈরি একটি দোতলা বাংলো বাড়ি এক পাশে। রিসোর্টের পাশ দিয়েই দূরে নদী চলে গেছে। আর ওই পাড়ে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। নদীর নাম জানা নেই। পাহাড়ের নামও জানা নেই। 
এই রিসোর্টেই থাকবেন বাংলাদেশী অতিথিরা। আমার জন্য চীনাদের সাথে পাশেই দু কদম দূরে একটি হোটেলে রুম ঠিক করা হয়েছে। আমি অন্য জায়গায় থাকবো শুনে ছেলে-মেয়েগুলোর মন খারাপ হয়ে গেলো। বিশেষ করে কিরণ আর শাপলা হতাশ হয়ে পড়লো। শিশির বললো : হতাশ হবার কিছুই নেই। আমরা পাশেই আছি। মান্না সব সময় আপনাদের সাথেই থাকবে।
ওদের অনেক করে বুঝিয়ে আমরা আমাদের হোটেলে এলাম। কিন্তু ছেলেমেয়েগুলোর জন্য সত্যি মন যেন কেমন করছিলো।
হোটেলে আমার জন্য নির্দিষ্ট করা রুমের ভিতরে গিয়ে দেখি একটা দেয়াল জুড়ে বিশাল জানালা। আর জানালা দিয়ে দেখা যাছে সেই নদী। তাকিয়ে দেখি সূর্যের কিরণে নদীর পানি চিকচিক করছে। আর তার আভা যখন ঝির ঝির বাতাসে দুলে দুলে গাছের পাতায় খেলছিল তখন আমার মন চাচ্ছিল শুধুই তাকিয়ে থাকি।  করলামও তাই। বেশ কিছুক্ষণ বসে বসে তাকিয়ে রইলাম যেন কোথাও এই চোখ স্থির নয়, যেন কোথাও এই বাতাস স্থির নয়, যেন কোথাও এই পাহাড় স্থির নয়। 
সবাইকে ফ্রেস হতে আধঘন্টা সময় দিলো ন্যান্সি। তার পরই আমাদের যেতে হবেই ওয়াং হ্রদে নৌভ্রমণে।
ঘড়িতে দুপুর আড়াইটা বাজে। আমি ঘরের সব পর্দা সরিয়ে দিলাম।  দূরে পাহাড়ের উপর ঘন সবুজ আর সাদা মেঘ একাকার হয়ে আছে। নিচে নদীর নীল পানি দুই ধারের সাদা পাথরের বুক চিড়ে বয়ে চলছে অবিরাম। সাদা পাথরগুলি দেখে মনে হয় মেঘের ডিম।  যেন ভোর রাতে এই ডিম থেকে বাষ্প বের হয়ে মেঘেদের জন্ম হয়। জানালা দিয়ে দূরে পাহাড়ের উপর গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম বিরামহীনভাবে। 

ই ওয়াং হ্রদে নৌভ্রমণ, ৩০ জুলাই: বেলা তিনটায় মাথার ওপর খরতাপ নিয়ে আমরা বেড়িয়ে পরলাম নৌভ্রমণের উদ্দেশ্যে। প্রায় বিশ মিনিট বাস চলার পর একটি জায়গায় এসে থামলো। সামনেই বিশাল ই ওয়াং হ্রদ বুকে নীল পানি ধারণ করে বয়ে চলেছে নিজ গন্তব্যে। হ্রদের কোলজুড়ে বিশাল শান বাধানো ঘাট। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে একটি বড় লঞ্চ। হ্রদের চারদিকের মনোরম পরিবেশ আর পাহাড়ের বুকে সবুজের হাতছানি দেখে আমাদের পথের ক্লান্তি কেটে গেলো মুহূর্তেই।
হ্রদের নীল পানির বুক ছিড়ে আমাদের নৌবহর চলতে শুরু করলো। হ্রদের চারদিকজুড়ে শুধু বিশালবিশাল পাহাড় আর গাঢ় সবুজ গাছের হাতছানি।পাহাড়গুলো যেন আকাশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। গ্রীষ্মের আকাশে শরতের মেঘের খেলা।আকাশজোড়া পেজা তুলোর মত সাদা মেঘ আর পাহাড়ের ছায়া এসে মিশেছে কাচের মত স্বচ্ছ নীল পানিতে।এত সুন্দর চারদিক! নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছি না।
কখনো লঞ্চের প্রথমতলায় কখনো আবার ছাদহীন দোতলায় ছুটে যাচ্ছি আমরা। ছবি তোলায় মগ্ন সবাই। চীনা সঙ্গীতের হালকা সুর বাজছে মৃদু তালে। সেই সাথে চলছে গল্প আর আড্ডা।
এক সময় লঞ্চ এসে থামলো একটি বিশাল পাহাড়ের পাদদেশে। 
ন্যান্সি জানালো এই পাহাড়ের চূড়ায় একটি প্রাচীনকালের বৌদ্ধ মন্দির আছে।আমরা বেশ কয়েকজন নেমে পড়লাম লঞ্চ থেকে।
পাহাড়ের পাথুরে উঁচু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। কিছু দূর যেতেই একটি বিল্ডিংয়ের মূল দরজা, বিশাল বড়-কাঠের খোদাই করা। ভিতরে ঢোকার পর ন্যান্সি ইশারা করে আমাকে বললো সামনের পাথরের সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের আরো উপরে উঠতে। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। আমার পিছনে কয়েকজন চাইনিজ শিল্পী উঠে আসছে। পাথর কেটে কেটে সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। সিঁড়িগুলো খুব খাড়া এবং সরু। সারাক্ষণ মনোযোগ দিতে হয়। ন্যান্সি উঠছে, আমি তার পিছনে উঠছি। আমাকে অনুসরণ করছে বাংলাদেশী শিল্পী কিরণ, শাপলা, আনিস আর সজল। একটার পর একটা সিঁড়ি। উপরে ওঠা আর শেষ হয় না যেন। মনে হল পাঁচতলা পর্যন্ত উঠলাম। উঠে দেখি একটি খোলা জায়গায় বৌদ্ধের একটি মূর্তি স্থাপন করা। তার সামনে আগরবাতি জ্বলছে। আমরা এখানে দাড়িয়ে কিছুকক্ষণ রেস্ট নিলাম।  ন্যন্সি বললো, তোমারা যাও ওপরে। আমি আর উঠতে পারছি না।আমি এখানে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করি।
অগত্যা, আমরা আবার সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করলাম। প্রায় তিনশ সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে গেছি আমরা। উঠে দেখি আমাদের আগেই আমাদের গ্রুপের অনেকই পৌঁছে গেছে সেখানে।এ চূড়ায় দাড়িয়ে চারদিকে সব দেখা যাচ্ছে। চারদিকে শুধু জল, পাহাড় আর সবুজের খেলা। মনে মনে ভাবলাম এই কি তবে স্বর্গ! 
পাহাড়ের চূড়ায় চিরদিক খোলা দুটি ঘর। দুইটি ঘরে বৌদ্ধের দুইটি মূর্তি পাশাপাশি। তফাৎ হচ্ছে একটা মূর্তির মুখের মধ্যে উদ্বেগের ছায়া। অন্য মূর্তির মুখটা একটু কাত করা,প্রসন্ন ভাব। এই পার্থক্যটা আমাকে ভাবিয়ে তুললো। আমি কাঠের জানালার পাশে দাড়িয়ে বৌদ্ধের মুখভঙ্গি দেখছি। ঠিক এ সময় হঠাৎ কি যেন এক শূন্যতা বোধ করলাম আমি।  এই উন্মুক্ত পরিবেশ, এই অবয়ব, এই গন্ধ, এই প্রাচীন কাঠ মনে হল আমার অতি পরিচিত। 
আমার সামনে বসে কয়েকজন নারী-পুরুষ প্রার্থণা করছেন। তাদের দিকে তাকিয়ে আমি যেন কোথায় হারিয়ে গেলাম। এখন পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা সাদা মেঘ দেখে ভাবছি, সারাদিন ধরে দৃশ্যপটের এই পরিবর্তন কয়েকদিন একটানা দেখতে থাকলে হয়ত কখনো বুঝতে পারবো পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসের সাথে বৌদ্ধ ধর্মের কোনো সম্পর্ক আছে কি না। মনে পড়ল মহেশখালিতে পাহাড়ের উপর বৌদ্ধ মন্দির দেখেছি, মনে পড়ল চট্টগ্রামে, বান্দরবান, রাঙামাটিতে রয়েছে বৌদ্ধ মন্দির। তাহলে কি পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে পাহাড়ি অঞ্চলগুলিতেই বৌদ্ধ ধর্মীয় মানুষ বেশি থাকে?
হঠাৎ কানে ভেসে এলো কে যেন নিচে নেমে যেতে ডাকছে।
তারপর আমরা আবারো খাড়া সেই তিনশ সিঁড়ি বেয়ে ঠিক নিচে নেমে এলাম।  লঞ্চটি আবারো চলতে শুরু করেছে।
ন্যান্সি জানালো সামনেই একটি ছোট্ট গ্রাম রয়েছে। সেখানে আছে প্রায় এ হাজার বছর আগের একটি অতি প্রাচীন বৃক্ষ।  আমরা সে গ্রামে কাটাবো কিছুটা সময়।
প্রায় দশ মিনিট পর আমরা সেই গ্রামে এসে নামলাম।এক দিকে হ্রদ আর তিন দিকে পাহাড়বেষ্টিত একখন্ড সমতল ভূমি এই গ্রামটি। ঠিক যেন ছবির মতো। দূর থেকে দূরে বিচ্ছিন্নভাবে ছোট ছোট ঘর-বাড়ি দেখা যাচ্ছে। একটু দূরে সেই প্রাচীন বৃক্ষটি দেখতে পেলাম। মাটির পথ মারিয়ে আমরা সেদিকে হাঁটছি। পথের পাশেই বা দিকে একটি গ্রামীণ খোলা বাড়ি চোখে পড়লো। বাড়িটির সামনের উন্মুক্ত উঠোনে গাছের ডালপালা কেটে শুকাতে দেয়া হয়েছে। বাড়িটির এক পাশে একটি বেশ বড় দোকান। দোকানের সামনে অনেক মানুষের জটলা। তারা আমাদের দেখছেন। দোকানের সামনে একজন বৃদ্ধ নারীকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম। ভাবলাম ফেরার পথে তার ছবি তুলবো। 
আমরা এগিয়ে গিয়ে দাড়ালাম সেই প্রাচীন বৃক্ষের নিচে। বিশাল ডালাপালা ছড়িয়ে সে দাড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের বট-পাকুর গাছের মত বিশাল তার আকৃতি। লক্ষ্য করলামা গাছের ডালে ডালে শত শত লাল রঙের ফিতা বাধা। দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে লাল ফুল ফুঁটে আছে। এই ফিতা বাধার কারণ জানতে চাইলে গাইড ন্যান্সি জানালো, অনেক মানুষ তাদের মনের ইচ্ছে পূর্ণ হওয়ার আশায় লাল ফিতার মত কাপড়ের ওপর নিজের ইচ্ছের কথা লিখে এই গাছে বেধে যায়। তাদের বিশ্বাস এতে তাদের মনের আশা পূর্ণ হয়।
ন্যান্সি আরো জানালো, প্রায় হাজার বছর আগে এ অঞ্চলে একজন পূর্ণবতি নারী বাস করতেন। তিনি সমাজের সবার কল্যাণ করতেন, উপকার করতেন। তার কাছে সাহায্য চেয়ে কেউ কখনো খালি হাতে ফিরে যেতো না। হঠাৎ একদিন সেই নারী অদৃশ্য হয়ে যান। গ্রামবাসী পাগলের মত তাকে খুঁজলেও তার আর দেখা মেলেনি। পরে তিনি এ গ্রামের বেশ ক’জন প্রবীণ ব্যক্তিকে স্বপ্নে দেখা দেন এবং জানান তিনি একটি গাছে পরিণত হয়েছেন। গাছটি গ্রামের এদিকটাতে রয়েছে। এ গাছের কাছে এসে যে কেউ তার প্রার্থণা জানালে তা পূর্ণ হবে। গ্রামবাসী যথারীতি দেখলেন সত্যি গ্রামের এদিকটায় একটি বিশাল গাছ রয়েছে। সেই থেকে এ অঞ্চলের লোকজন এই গাছটিকে পবিত্র হিসেবে গন্য করেন এবং তারা মনের আশা পূরণের জন্য গাছে লাল ফিতা বেধে যান।
এ কাহিনী শোনার পর চীনা ও বাঙালিরা মনের আশা লিখে লিখে ফিতা বাধতে শুরু করলো গাছের ডালে ডালে। আমিও আমার পরিবারের সদস্যদের মঙ্গল কামনা করে একটি ফিতা বেধে আসলাম সেই পবিত্র গাছে।
ফিরতি পথে সেই দোকানের সামনে এসে দাড়ালাম আমি। সেই বৃদ্ধা তখনো দাড়িয়ে আছেন। দেখছেন বিদেশীদের। আমি তার কাছে যেয়ে ছবি তোলার অনুমতি চাইলাম। তিনি স্নিগ্ধ হেসে রাজি হলেন। আমার ক্যামেরা ক্লিক করে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে। তার মেয়ে পাশে দাড়িয়ে ছিলো সন্তান কোলে নিয়ে। তাদেরও ছবি তুললাম। তাদের সকলের পাশে দাড়িয়ে আমি নিজেও ছবি তুললাম। তারা খুব আনন্দিত হলেন; সন্মানবোধ করলেন। তারপর আমি প্রচন্ড গরমের কারণে অরেঞ্জ জুস কিনতে চাইলাম। বৃদ্ধা আমাকে হাত ইশারায় দোকানের ভেতরে ফ্রিজ দেখিয়ে দিয়ে পছন্দ মত নিতে বললেন। আমি একটি মিডিয়াম সাইজের অরেঞ্জ জুসের বোতল হাতে নিয়ে তার দিকে টাকা বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু কি অবাক ব্যাপার! তিনি টাকা নেবেন না।ভাষা আমাদের জন্য কোনো সমস্যাই সৃষ্টি করলো না। দূর চীনের এক অজপাড়া গাঁয়ের এই বৃদ্ধার ভাষা আমি বুঝলাম। আর এক বঙ্গসন্তানের ভাষাও বুঝলেন চীনা এক গ্রাম্য মা। আমার হাত চেপে ধরলেন তিনি। মাথা নেড়ে শুধু না, না করছেন। আমি অরেঞ্জ জুসের বোতলটি ফিরিয়ে দিতে চাইলাম। কিন্তু তিনি হেসে আমাকে বুঝাতে চাইলেন আমি তার অতিথি। এটি আমার জন্য তার উপহার। আমি তা-ও শুনতে রাজি না দেখে তিনি তার মেয়েটিক দেখিয়ে ইশারায় আমাকে বোঝালেন আমি তার মেয়ের মতো। এবার আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লাম। ওদিকে সঙ্গিরা আমাকে ডাকাডাকি করছে তাড়াড়াতি ফিরে যেতে। এদিকে গ্রামের সরল মানুষগুলো তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
বৃদ্ধা, তার স্বামী-কন্যা সকলেই আমাকে অনুরোধ করছেন। কি করি! বৃদ্ধা আমার হাত চেপে ধরে আছেন। আমার মনে পড়ে গেলো আমার সদ্য প্রয়াত মায়ের মুখখানা। মনে হলো এই অচেনা মায়ের স্নেহের সন্মান করা উচিত আমার। আমি টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। তার দিকে তাকিয়ে আমার চোখ জলে ভরে উঠলো। তার আন্তরিকতা ও মহানুভবতায় ভরে উঠলো আমার হৃদয়। তার হাঁটুতে স্পর্শ করে সালাম করলাম তাকে। তিনি আমার মাথায় আলতো ছুঁয়ে দোয়া করে দিলেন যেন। আমি দ্রুত গতিতে ফিরতি পথে হাঁটতে শুরু করলাম। পেছন দিক থেকে ওই বৃদ্ধা মা এবং তার প্রতিবেশীরা তাকিয়ে রইলেন আমার ফিরে যাওয়া পথের দিকে।
সূর্য ডুববে ডুববে করছে। আমরা রুমে ফিরে এলাম। আজকে ই ওয়াং গ্রামে আমাদের শেষ দিন। আমরা কাল সকালে রওয়ানা হবো উ ইউয়ুন চিয়ের দিকে। সন্ধ্যায় ই ওয়াং লেকের ধারে রিসোর্টের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে বসে আমরা ডিনার শেষ করলাম।
হঠাৎ করে অনুভব করলাম বেশ গাঢ় হয়ে সন্ধ্যা নামছে।এ এক অদ্ভুত সন্ধ্যা নামা।চারদিকে কোনো সারা-শব্দ নেই।  শুধু ঝিঁঝিঁ পোকারা একটানা ডেকে চলেছে অবিরাম। তীব্র সে শব্দ।মনে হয় যেন শত শত ঝুনঝুনি কেউ এক সাথে বাজাচ্ছে। নীরবে অন্ধকার নামে পাহাড়ের গায়ে, মনে হয় যেন বিশালাকৃতি পাহাড়গুলো ধীরে ধীরে সূর্যকে গ্রাস করে এই সময়। আর সন্ধ্যা নেমে গেলে গ্রাস করে অন্ধকার। পাহাড়গুলি সর্বভূক। 

উ ইউয়ুন চিয়ের পথে, ৩১ জুলাই: সকালে নাস্তা শেষ করেই আমরা চড়ে বসলাম গাড়িতে। পাহাড়ী আঁকাবাঁকা পথে চাকা ঘষে গাড়ি ছুটে চললো সামনের দিক। আজ আমাদের গন্তব্য উ ইউয়ুন চিয়ে অঞ্চল।
প্রায় এক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে আমাদের নিয়ে গেল একটা ব্রিজের কাছে।এখান থেকে আর গাড়ি যাবে না। অন্য পথে সামনে নির্দিষ্ট করা জায়গায় গিয়ে গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। আমরা এ পথে পাহাড়ী ঝরণা, পদ্মফুল আর গোলাপের বাগান দেখবো। এখান থেকে ঠিক কতদূর হাঁটতে হবে জানি না। হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ী পানির প্রবাহ লক্ষ্য করলাম। ছলছল শব্দে পানি বয়ে চলেছে। একটু সামনে যেতেই সেই উত্তাল ঝরণা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো। পাহাড়ী খাদের কোল ঘেষে পথ ধরে আমরা হাঁটছি। দুই পাশের পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে সফেদ সাদা পানি বুকে নিয়ে পাথরের বুক কেটে কেটে উচ্ছল গতিতে বয়ে চলেছে এই ঝরণা। কাঠ আর দড়ি দিয়ে তৈরি একটি ছোট্ট ব্রিজ পাহাড়ের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের সংযোগ তৈরি করেছে। আমরা ব্রিজ পার হয়ে পাহাড়ের ওপারে যেতে শুরু করলাম। এখানের দৃশ্যটা খুবই মনোরম। ছোট একটা ঝুলন্ত ব্রিজ। এর উপরে উঠে দাঁড়ালে দুই ধারে পায়ের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝরণার পানি সারাক্ষণ পাথরের গায়ে বাধা পেয়ে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করছে। এই শব্দ আবার পাহাড়ের গায়ে বারি খেয়ে ফিরে আসছে শো শো করে। পাহাড় আর ঝরণার এই সহাবস্থান এই জায়গাটিকে একটি বিশেষ পরিবেশ দিয়েছে। দূরে দেখা যাচ্ছে গ্রামগুলোকে। কিছু দূর যেতেই চোখ রাঙ্গিয়ে দিলো একরে একরে জমির বুকে ফুঁটে থাকা পদ্মফুলের রঙ।  গোলাপ বাগানে ফুঁটে আছে নানা রংয়ের বাহারী গোলাপ। চারদিকে পাহাড়বেষ্টিত এক খন্ড সমতল ভূমি এই এলাকাটি।
আশেপাশে একটা জীর্ণ দোকান আর দুই একটা বাড়ি। 
ক্ষেতগুলোর চারদিকে ও মাঝখানে পাঁকা রাস্তা করা। আমরা এ রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলাম। মাথার ওপর সূর্যের প্রখর তাপ।  তারপরও পদ্মফুলে সাথে সকলের চলছে অবিরাম ছবি তোলা।
বেলা সাড়ে এগারোটা হবে তখন। ফুল বাগানের এক প্রান্তে একটি দোকান।  তার সামনেই আমাদের গাড়ি অপেক্ষা করছে। দোকান আবার রেস্টুরেন্টের মতো। আমরা ভেতরে ঢুকলাম।  মতিন স্যার বললেন সবাইকে একটু পানি ও কোল্ড ড্রিং খেয়ে ঠান্ডা হয়ে নিতে।
চীনা কাস্টমাররা ঘরোয়া পরিবেশে চা খাচ্ছে আর টিভি দেখছে। কাউকে দেখে বোঝার উপায় নেই কে কাস্টমার আর কে রেস্টুরেন্টের লোক। পানি খেতে খেতে দোকানের ভিতরটা ভালমত লক্ষ্য করলাম। রেস্টুরেন্টের ঠিক মাঝখান দিয়ে একটা হিটার, সেটা থেকে একটা পাইপ ছাঁদ পর্যন্ত উঠে গেছে।  নিচের অংশটা গোল একটা ড্রামের মত। এর ভিতরে লাকড়ি দিয়ে আগুন জলছে আর পাইপ দিয়ে ধোয়া উঠে যাচ্ছে ছাদে।  নিচের ড্রামের মত অংশটা দেখে বোঝা যায় এটা অনেক পুরানো পদ্ধতির হিটার।  শহরে এ ধরনের হিটার দেখা যায় না। রুমের মধ্যে হিটারের পর সবচাইতে বেশি চোখে পড়ে কাঁচের শোকেস। কাঁচের শোকেসে একটা অদ্ভুত ধরনের খাবার দেখা যাচ্ছে। কাছে গিয়ে বুঝলাম শুকরের মাংস মশলা মাখিয়ে ড্রাই করে রাখা। এখানকার খুব প্রচলিত খাবারের একটি এটি। 
আবার শুরু হলো আমাদের পথ চলা। কিছু দূর যেতেই এক বিশাল হ্রদের পাশে বাস থামলো। ন্যান্সি আমাদের দশ মিনিট সময় দিলো এখানে নেমে ছবি তুলতে। আমরা একটা পাহাড়ের কোলে দাড়িয়ে আছি। সামনে যত দূর দৃষ্টি চলে যায় শুধু পানি আর পানি।বা দিকে দূরে পাহাড়ের উপতক্যায় একটি গ্রাম। দূরে হ্রদের পানিতে পাহাড় আর আকাশ যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আমাদের ঠিক সামনে দিয়ে বা দিকের গ্রাম আর ডান দিকের নীল পানিকে ভাগ করে দিয়ে একটি পিচঢালা পথ চলে গেছে আজানার পথে। সময় নেই তাই আমাদের আর সেদিকে যাওয়া হবে না।
মিনিট দশেক পর বাস আবার চলতে শুরু করলো। প্রায় সাড়ে এগারোটার দিকে আমরা উ ইউয়ুন চিয়ের একটি উচু পাহাড়ের রিসোর্টে এসে নামলাম। এতো উচু পাহাড় যে চারদিকের সব নজরে পরে। দূরে সরু সুতোর মত নদী বয়ে যাচ্ছে। পাশেই পাহাড়ের পেছনে যেন নেমে এসেছে নীল আকাশ।  কসমস, চেরি আর গাদাফুলে গাছ বাতাস গায়ে মেখে খেলা করছে চারদিকজুড়ে। এখানে আমরা ঘন্টা তিনেক থাকবো। শিল্পীরা ছবি আঁকবে, স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে কথা বলবে।  লাঞ্চ করে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়ে আবার পথচলা শুরু হবে।
রিসোর্টের একটি ছোট্ট দোকান থেকে টুকটাক কেনাকাটা করলাম। দোকানী মেয়েটি সব জিনিসের দাম বেশ কমিয়েই রাখলো। তারা খুব আন্তরিকভাবে আমাদের লাঞ্চ করালো। এখানে-সেখানে বসে শিল্পীরা পেন্সিল স্কেচে প্রকৃতির রূপ তুলে ধরছেন। রোদের প্রখরতা ক্লান্তি এনে দিচ্ছে দেহে। কেউ কেউ একটি এসি রুমে বিশ্রাম নিচ্ছেন। ন্যান্সি সে রুমে মিনিট বিশেক ঘুমিয়ে নিলো বেশ। গত ক’দিন বেশ খাটনি যাচ্ছে বেচারার। আরো অনেক দিন বাকী। পনেরো দিনের প্রোগ্রাম তাদের। তবে আমাদের তিনজনকে ফিরে যেতে হবে আজই।
আজ আমি তাদের ছেড়ে যাবো জানাতেই সকলে যেন আঁতকে উঠলো। এতো আনন্দের মধ্যেও মন খারাপ হয়ে গেলে তাদের। 
মতিন স্যার বললেন, তোমাকে পেয়ে আমাদের ভ্রমণ আনন্দময় হয়ে উঠেছিলো। বাকী দিনগুলো আমরা তোমাকে মিস করবো।
ছেলেমেয়েগুলোর চোখ কাঁন্নায় চিকচিক করে উঠলো। তারা সকলেই আমার বাংলাদেশের ঠিকানা, ফোন নম্বর রেখে দিলো। আবারো দেখা হওয়ার নিশ্চয়তা চাইলো। আমি তাদের বললাম তাদের সাথে আমার আবারো যোগাযোগ হবে।
বিকেল চারটা নাগাদ আমরা সকলেই উ ইউয়ুন চিয়ে ছেড়ে পথচলা শুরু করলাম।  দলটি শা পিং শহর হয়ে গোয়াং চোর দিকে চলে যাবে। আমি, শিশির আর জিনিয়া নেমে পড়বো শা পিং শহরে। সেখান থেকে ছাংশাগামী বাস ধরবো আমরা। ন্যান্সিকে সে রকমই বলা আছে। আজ রাত এবং আগামীকাল পহেলা আগস্ট আমরা ছাংশায় থাকবো। অফিসিয়াল কিছু কাজ শেষে দুই আগস্ট দুপুরের ফ্লাইটে আমরা ফিরে যাবো বেইজিং।

এবার বিদায়ের পালা, ৩১ জুলাই: কালো পিচঢালা পথে চাকা ঘষে বাসটা এগিয়ে চলেছে নিজ গন্তব্যে। আমরা সকলে বেশ ক্লান্ত। বিচ্ছেদের সুর বাজায় কিছুটা যেন বিষন্ন সবাই। প্রায় এক ঘন্টা পর শা পিং শহরে এসে থামলো বাস। ন্যান্সি জানালো এবার আমাদের নামতে হবে।  রাস্তার ওপারেই স্টেশন। শিশির আর জিনিয়া নেমে গেছে বাস থেকে।  ওরা লাগেজ নামাতে ব্যস্ত। আমি একে একে আমার স্বদেশী ভাই-বোনদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ওরা সকলে বিষন্ন হৃদয়ে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। শাপলা ডাগোর ডাগোর চোখে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। ওর চোখ গড়িয়ে ঝরে পড়লো অশ্রু। আনিস বললো, আমি ঢাকায় ফিরেই আপনার বাসায় যোগাযোগ করবো। সজল বললো, আপু আপনাকে ভুলবো না। ফোন করবো। কিরণ বললো, ধুমকেতুর মত এলেন, আবার ধুমকেতুর মতই যেন মিলিয়ে গেলেন। ওদের কথা শুনে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। আমি আমার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। স্বদেশ থেকে দূরে থাকার ব্যথা আমার বুকে বাজে সারাক্ষণ। তবে সাংবাদিকদের আবেগ সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। নিশ্চয় আবার দেখা হবে- এ কথা দিয়ে আমি নেমে পড়লাম বাস থেকে। তৃষ্ণার্ত সাত জোড়া চোখ তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। আমি একবার মাত্র পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম ওদের। তারপর রাস্তা পেড়িয়ে সোজা চলে গেলাম স্টেশনের দিকে।
আমি হয়তো মিথ্যে বলেছি ওদের। জীবনের প্রয়োজনে আমি আবার ব্যস্ত হয়ে পড়বো। ওরাও দেশে ফিরে গিয়ে নিজ নিজ জেলায় চলে যাবে। ব্যস্ত হয়ে যাবে শিল্পচর্চা আর পড়ালেখা নিয়ে। হয়তো আর কোনো দিনও দেখা হবে না ওদের সাথে। তবে সারা জীবন চীন দেশে ভ্রমণের এক টুকরো ভালো লাগার সোনালী স্মৃতি হৃদয়ে ধারণ করে রাখবো আমরা সকলেই। 
লেখক: সাবেক ফরেন এক্সপার্ট, বাংলা বিভাগে, চীন আন্তর্জাতিক বেতার (সিআরআই)। সম্পাদক-উইমেননিউজ২৪.কম।