ঢাকা, রবিবার ২৪, নভেম্বর ২০২৪ ৮:১২:১৭ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

চীনের চিঠি: সিনচিয়াং থেকে ইয়ুননান

আইরীন নিয়াজী মান্না

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১০:৪৫ পিএম, ৮ জানুয়ারি ২০২৩ রবিবার

সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সাথে লেখক।

সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সাথে লেখক।

নবী করিম হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছিলেন, শিক্ষা গ্রহণ করতে প্রয়োজনে সুদূর চীনদেশে যাও। হ্যাঁ, সেই সুপ্রাচীন চীনদেশ কত যে বিচিত্র; কত যে মনোরম। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
বেশ কয়েক বছর আগের কথা বলছি। তখন আমি চাকরি সূত্রে বেইজিংয়ে থাকি। আমার চাকরিস্থল চীন আন্তর্জাতিক বেতারের (সিআরআই) পক্ষে গত বছর অগাস্টে নয়া চীনের স্থপতি কমরেড মাও সে তুংয়ের জন্মভূমি হুনান প্রদেশ ঘুরে এলাম।
তারপরই সেপ্টেম্বর মাসে গেলাম মুসলমান অধ্যষিত সিনচিয়াং প্রদেশ ও ইয়ুননান প্রদেশে। এবারের ট্যুর ছিলো ছয় দিনের। ১৭ সেপ্টেম্বর’ ২০১৫ আমরা রাজধানী বেইজিং ছাড়ি। ফিরে আসি ২২ সেপ্টেম্বর। সে এক প্রাণবন্ত অভিজ্ঞতা।
চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্পর্কের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের একটি সাংবাদিক প্রতিনিধি দল চীন সফর করে। বেইজিং ছাড়াও সিনচিয়াং স্বায়ত্বশাষিত অঞ্চলের রাজধানী উরুমচি এবং ইয়ুননান প্রদেশের রাজধানী খুনমিং সফর করেন তারা।
বাংলাদেশ কূটনৈতিক সংবাদদাতা সমিতি (ডিকাব) ও যুগান্তরের কূটনৈতিক প্রতিবেদক মাসুদ করিমের নেতৃত্বে আট সদস্যের সাংবাদিক প্রতিনিধি দলে ছিলেন, দেশ টিভির সম্পাদক (বার্তা ও চলতি প্রসঙ্গ) সুকান্ত গুপ্ত অলক, এটিএন বাংলার প্রধান বার্তা সম্পাদক রুমি নোমান, ইংরেজি দৈনিক দ্যা ইনডিপেন্ডেন্টের কূটনৈতিক প্রতিবেদক হুমায়ুন কবীর ভূইয়া, দৈনিক ভোরের কাগজের কূটনৈতিক প্রতিবেদক ও ডিকাব সহ-সভাপতি আঙ্গুর নাহার মন্টি, দৈনিক কালের কণ্ঠের কূটনৈতিক প্রতিবেদক মেহেদি হাসান, দৈনিক ইত্তেফাকের স্টাফ রিপোর্টার তালেব রানা এবং গবেষক ও লেখক গোলাম মোস্তফা। প্রতিনিধি দলটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা বিভাগের (সিআরআই) পক্ষে ছিলাম আমরা দুজন। আমি এবং আমার চীনা সহকর্মী শিয়েনেন আকাশ। 
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে এই সাংবাদিকদের অধিকাংশই এক সময় দেশে বিভিন্ন পত্রিকায় আমার সহকর্মী ছিলেন। আমাদের রয়েছে অনেক সোনালি স্মৃতি, অনেক মজার মজার গল্প। সুতরাং তারা আসছে জানতে পেরে সেই প্রথম দিন থেকেই আমার যেন আর সময় কাটছিলো না। তারপর এলো সেই মহামিলনের মূহুর্ত। ১৫ সেপ্টেম্বর বেইজিং এলেও তাদের সাথে আমার দেখা হলো ১৮ সেপ্টেম্বর। এদিন তারা সকলে ঘুরতে এলেন আমাদের অফিসে। কি যে এক অদ্ভূত ভালো লাগায় ভরে উঠলো হৃদয় সেই প্রিয় মুখগুলোকে দেখে।

বেইজিং থেকে উরুমচি, ১৮ সেপ্টেম্বর:
১৮ সেপ্টেম্বর দুপুর সোয়া ২টায় বেইজিং থেকে উরুমচির পথে বিমানটি আকাশের ঠিকানায় উড়াল দিলো। জানালা দিয়ে ব্যস্ত শহর, ব্যস্ত মানুষগুলোকে খুব নস্যি মনে হচ্ছিলো। ভয় ও আনন্দ দুটোই সমান তালে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।
দেখতে দেখতে চীনের স্থানীয় সময় সাড়ে ৬টায় আমরা পৌঁছালাম উরুমচি বিমান বন্দরে সেই কাংখিত স্বপ্নের রাজ্যে। কি এক অপরূপ বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো আমাদের জন্য।
সেখানে আগে থেকেই গাইড আলিজান মোহাম্মদ আমিন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো নির্ধারিত হোটেলে। বেইজিংয়ে থাকতেই উরুমচির তাপমাত্রা সম্পর্কে আমাদের ধারনা দেওয়া হয়েছিলো। গরম-ঠান্ডার মাঝামাঝি।
উরুমচি শহরের প্রবেশ করেই যেন আরবিয় ধারা চোখে পড়লো। প্রধান প্রধান অফিস ইমারতে আরব্য স্থাপত্য রীতির প্রধান্য নজর কাড়লো। বিমান বন্দর, শহরের অফিসগুলো, দোকান-পশার, হোটেল ও নাট্যশালা সব জায়গাতেই দেয়ালে দেয়ালে নাম ফলক চীনা ভাষায় এবং আমাদের অতিচেনা আরবি হরফে লেখা। একটি হোটেলে দেখলাম লেখা রয়েছে ‘মেহমান খানাসি’। 
লক্ষ্য করলাম আমাদের ব্যবহৃত ও পরিচিত অসংখ্য শব্দ এখানে প্রচলিত রয়েছে। পিয়াজকে তারাও পিয়াজ বলছে; এমনকি খাসি শব্দটিও একই উচ্চারণে ব্যবহার করা হচ্ছে। খাওয়ার টেবিলে দেখলাম এদের রান্নার স্টাইলের সাথে আমাদের কত মিল! এমন কি খাবারের স্বাদেও অসম্ভব মিল রয়েছে। আর কাবাবের কথা না বললেই নয়। খাসির মাংসের শিক কাবার, বটি কাবার, সূতি কাবাব মনের মধ্যে দেশের ফেরার তাগাদি দিয়ে যাচ্ছিল বার বার। আসলে আগে মোটেও জানা ছিলো না, মহাপ্রাচীরের এই অঞ্চলের সাথে আমরা সাংস্কৃতিক সূত্রে কতটা আবদ্ধ! শহরে জীবনে এত সরলতার সাক্ষাত পাবো এই নৃত্যগীতির দেশে তা তো আগে ভুলেও ভাবতে পারিনি।
উরুমচির প্রকৃতিক দৃশ্য মনোরম। মানব প্রচেষ্টায় ভূপ্রকৃতিতে কতটা যে পরিবর্তন আনা সম্ভব তা এখানে না এলে বোঝা যাবে না। উরুমচি শহরের পত্তন হয়েছে ১৭৬৫ সালে। ১৮৮২ সালে প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা লাভ করলেও ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত এখানে মাত্র কয়েক হাজার লোকের বসতি ছিলো। 
উঁচু পর্বতমালা ও বিস্তৃত মরুভূমি কোনোটাই আর সিনচিয়াংয়ের বিভিন্ন অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারেনি। ১ দশমিক ৬ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল আয়তনের এই স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলে আজ উন্নয়নের ছোঁয়া স্পষ্ট।
এশিয় সীমান্ত সমাজে জল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কি ভাবে সমাজের বিকাশধারা নিয়ন্ত্রণ করা হয় মার্কসীয় সমাজতত্ত্বের এ সূত্রটি এই নগরীতে দাড়িয়ে প্রত্যক্ষ করা যায়। এ নগরের জল সরবরাহ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, শিল্পচাতুর্য এর উজ্জ্বল অতীতের নিদর্শন।
এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর সযত্ন রক্ষনাবেক্ষণ এবং সব জায়গায় ঐতিহাসিক, প্রকৃতিক বিজ্ঞান ও জাতিসত্তাগুলোর জাদুঘরে পুরাকীর্তির সংরক্ষনের বিপুল আয়োজন চীনা জাতির ঐতিহ্যপ্রীতি ও উচুমানের ঐতিহাসিক চেতনার সাক্ষি হয়ে আছে। উরুমচিতে অসংখ্য বিদেশী পর্যটকের দেখে মেলে আমাদের সাথে।
গাইড আলি জানালেন, সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলকে সংক্ষেপে সিনচিয়াং বলা হয়। সিনচিয়াং চীনের উত্তর পশ্চিম এবং ইউরোপ-এশিয়া মহাদেশের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। সিনচিয়াংয়ের আয়তন ১৬ হাজার ৬৪৯ লাখ বর্গকিলোমিটার। আয়তনের দিক থেকে সিনচিয়াং চীনের বৃহত্তম প্রদেশ পর্যায়ের প্রশাসনিক এলাকা। এই সিনচিয়াংয়ের বৃহৎ শহর ও রাজধানী হলো উরুমচি।
সিনচিয়াংয়ের ৮ টি দেশের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত যথাক্রমে মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, কাজাকস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারত। সীমান্তের দিক থেকে এই প্রদেশ চীনের দীর্ঘতম প্রদেশ হিসেবে বিবেচিত। প্রদেশটি সবচেয়ে বেশি দেশের সঙ্গে সংলগ্ন এবং সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক বন্দর সম্পন্ন একটি প্রদেশ। 
চীনের পাঁচটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের একটি হিসেবে সিংচিয়াংয়ে ৫৫টি জাতি বসবাস করে। এর মধ্যে উইগুর, হান, কাজাখ, হুই, কিরগিজ এবং মঙ্গোলিয়সহ ১৩টি সংখ্যালঘুজাতি যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলে বসবাস করছে।
সিনচিয়াংয়ের মোট লোকসংখ্যা প্রায় ২ কোটির বেশি। মোট লোকসংখ্যার মধ্যে সংখ্যালঘু জাতির লোকসংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ। পুরুষ ও নারীর অনুপাত সমান।
প্রাচীনকালে সিনচিয়াংকে সি ইউয়ু অর্থাত পশ্চিম অঞ্চল বলে ডাকা হতো। ২ হাজার বছর আগে সিনচিয়াং চীনের ঐক্যবদ্ধ বহুজাতিক দেশের একটি অংশ ছিলো। খৃষ্টপূর্ব ৬০ সালে হান রাজবংশ সেখানে পশ্চিম অঞ্চলের রাজধানী স্থাপন করে। আজকের বাস্কা হ্রদ ও পামির এলাকাসহ সিনচিয়াং সরাসরি সিহান রাজবংশের রাজনৈতিক ক্ষমতার নেতৃত্বাধীন। ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিনচিয়াং শান্তিপূর্ণভাবে মুক্তির কথা ঘোষণা করে। একই সালের পয়লা অক্টোবর চীন গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যান্য প্রদেশের মতো সিনচিয়াং চীনের স্বায়ত্তশাসিত ক্ষমতা সম্পন্ন প্রদেশ পর্যায়ের এক প্রশাসনিক এলাকায় পরিণত হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিনচিয়াংয়ের অর্থনীতিতে দ্রুতবেগে বৃদ্ধি প্রবণতা রক্ষ্য করা যায়। ২০১০ সালে সিনচিয়াং অঞ্চলের জিডিপি ৫০ হাজার কোটি রেনমিপি ছাড়িয়ে গেছে। যা এর আগের বছরের চেয়ে ১০.৬ শতাংশ বেশি। ২০১১ সালে জিডিপি ৬০ হাজার কোটি ইউয়ান ছাড়িয়েছে।

স্বর্গীয় হ্রদ : শনিবার সকালে আমরা সদলবলে স্বর্গীয় হ্রদ বা হেভেনলি লেক দেখতে বেড়িয়ে পরি। পিচঢালা পথে চাকা ঘষে এগিয়ে চলে আমাদের গাড়ি। চলছে তুমুল আড্ডা। গাড়ি চলতে শুরু করল পাহাড়ি রাস্তার আঁকাবাঁকা ঢাল দিয়ে শহরের দিকে। শহর ছেড়ে গাড়ি যখন গ্রামের পাহাড়ি রাস্তা ধরে যাচ্ছে তখন দেখি রাস্তার ধারে বিশাল বিশাল পাইন গাছের সমাহার। তার পিছনে সূর্য পাইন গাছ গাছের মাঝখান থেকে উঁকি দিচ্ছে। আমরা যেই পাহাড়ের উপর দিয়ে যাচ্ছি সেখানে পাইন গাছ বেশি। পাইন গাছ দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছালাম একটা রাস্তার বাঁকে। এখান থেকে দূরে বিভিন্ন ধরনের পাহাড় দেখা যায়। সবচাইতে কাছের গুলি সবুজ, তার পরের সারি নীল এবং তার পরের সারি কালো। পাথুরে পাহাড়ের সৌন্দর্য যে কতটা নান্দনিক তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না। 
প্রায় এক ঘন্টা চলার পর আমরা স্বর্গীয় হ্রদের কাছে চলে এলাম। এই হেভেনলি লেক চীনের সিনচিয়াং প্রদেশের একটি আলপাইন হ্রদ। এর প্রকৃত নাম থিয়ানচি হলেও এর সৌন্দর্য বিবেচনা করে চীনারা এর নাম দিয়েছে স্বর্গীয় হ্রদ বা হ্যাভেনলি লেক। তিয়েনশান পর্বতমালার নিচে এই হ্রদ সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে থেকে ৬ হাজার ফুট উপরে। স্বর্গীয় হ্রদের চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে তুষার আবৃত পাহাড়ের শৃঙ্গ। সেখানে গেলে আর ফিরে আসতে মন চায় না। আমারো হলো তাই। দূরে কাজাক সীমান্ত পেরিয়ে মঙ্গলিয়া।
হ্রদের চারদিকজুড়ে শুধু বিশাল বিশাল পাহাড় আর গাঢ় সবুজ গাছের হাতছানি। পাহাড়গুলো যেন আকাশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। গ্রীষ্মের আকাশে শরতের মেঘের খেলা। আকাশজোড়া পেজা তুলোর মত সাদা মেঘ আর পাহাড়ের ছায়া এসে মিশেছে কাচের মত স্বচ্ছ নীল পানিতে। যতই রোদের তীব্রতা বাড়ে ততই বাড়ে পাহাড়ের চূড়ায় ররফের রূপ। এত সুন্দর চারদিক! নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছি না।
একটু পর পর গাইড আলিজান আমাদের স্বর্গীয় হ্রদ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করছেন।
তিনি জানালেন, স্বর্গীয় হ্রদ রাজধানী থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে। স্বর্গীয় হ্রদ আলতা পাহাড়ের গভীর বনে অবস্থিত এক পাহাড়ী হ্রদ। এ হ্রদের গভীরতা ১৮৮.৫ মিটার এবং আয়তন ৪৫.৭৩ বর্গকিলোমিটার।
এই জায়গাটি চীনের একমাত্র জায়গা যেখানে দক্ষিণ সাইবেরিয়ার আঞ্চলিক প্রাণী ও উদ্ভিদের চমত্কার বিন্যাস ঘটেছে। লার্চ, কোরিয় পাইন, ড্রাগন স্প্রস ও ফার প্রভৃতি মূল্যবান গাছ এবং বহু বার্চ এখানে উত্পন্ন হয়।
এ অঞ্চলে প্রায় ৮০০ ধরনের গাছ, ৩৯ ধরনের পশু, ১১৭ ধরনের পাখি, ৪ ধরনের উভয়চর সরীসৃপ, ৭ ধরনের মাছ এবং ৩০০ ধরনের কীটপতঙ্গ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অনেক ধরনের প্রাণী বা উদ্ভিদ সিনচিয়াং অথবা গোটা চীনেও বিরল। 
এখানে বন ও তৃণভূমি পালাক্রমিকভাবে বিন্যাস্ত এবং নদনদী ও হ্রদ বহুল এলাকা এটি। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য অত্যন্ত মনোরম বলে এই অঞ্চলের পর্যটন, সুরক্ষা, বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও ঐতিহাসিক সংস্কৃতির উচ্চ-মূল্য আছে।

উরুমচি জাদুঘর ও প্রাচীন লৌলান নগর রহস্য : শুধু মিশর বা দোজলা ফোরাত নয়; চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সিনচায়াং প্রদেশেও যে পাঁচ হাজার বছর আগে সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিলো সিনচিয়াংয় জাদুঘরে না গেলে অজানাই থেকে যেত ইতিহাসের এই বিরল খবর। 
সিনচিয়াংয় জাদুঘর ঘুরে দেখার সময় দায়িত্বরত গাইড আলি জানান, দক্ষিণ সিনচিয়াংয়ের লোবুপো এলাকার উত্তর পশ্চিম দিকে অবস্থিত প্রাচীনতম লৌলান নগর রেশমী পথের প্রবেশ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ ছিলো। লৌলান জনশুণ্য জায়গা। চারদিকে মরুভূমি, ইয়াতান-ল্যান্ডফোর্মস ও শক্ত লবনের খোল দ্বারা পরিবেষ্টিত বলে তার পরিবেশ অত্যন্ত খারাপ।
খ্রীষ্টপূর্ব ২ শতাব্দীতে লৌলান পশ্চিমাঞ্চলের এক সমৃদ্ধতম এলাকা ছিলো। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো, নামকরা লৌলান রাজ্য সমৃদ্ধশালী হওয়ার পাঁচ-ছয় শত বছর পর হঠাত অদৃশ্য হয়ে যায়। প্রাচীনতম লৌলান নগর কিভাবে অদৃশ্য হলো? বিষয়টি দীর্ঘকাল ধরে দেশীবিদেশী প্রত্নতত্ত্ববিদ আর বৈজ্ঞানিকদের আকৃষ্ট করে ছিলো। লৌলান দেশীবিদেশী পর্যটকদের জন্য এক রহস্যপূর্ণ এলাকা।
প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম নানা ধরনের জটিল কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যায় এবং বাতাস ও বালির আক্রমনে লৌলান নগর মরুভূমিতে অদৃশ্য হয়ে যায়। পরে আবিস্কার করা হয়, প্রাচীনতম লৌলান নগরের আয়তন ছিলো এক লাখ ২০ হাজার বর্গমিটার। এর দেয়াল মাটি, খাগড়া আর গাছের ডাল দিয়ে তৈরি করা হয়। উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিক পর্যন্ত প্রাচীন এক নদী নগরটির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিলো।
লৌলানে এখন শুধু বৌদ্ধ মন্দির এবং তার আশেপাশে স্থাপত্যগুলো রয়েছে। এ ছাড়া এ নগর ও তার আশেপাশে আছে প্রাচীনকালের আলোক সংকেত টাওয়ার, খাদ্যশস্যের গুদাম এবং প্রাচীনকালের কবরস্থান।
লৌলানের প্রাচীনকালের কবরস্থান থেকে ৩ হাজার ৮০০ বছর আগের শুকনো মৃতদেহ ‘লৌলান সুন্দরী’ কে উদ্ধার করা হয়েছিলো। প্রাচীন লৌলান নগরে এখনো ভাঙ্গা মৃত্পাত্রে টুকরা, পশমী কাপড়ের টুকরা, তামার মুদ্রা, অস্ত্রশস্ত্র, রেশমী কাপড়ের টুকরা প্রভৃতি ইতিহাসের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এই জাদুঘরেই রয়েছে ‘লৌলান সুন্দরী’ মমি। 
জাদুঘরের পরিচিতি ফলকে লেখা রয়েছে, ১৯৮০ সালে সিনচিয়াংয়ের রাজধানী উরুমচি থেকে ১২০ মাইল দূরে শুকনো লবণ হ্রদের পাশে সিল্ক রোড বা রেশম পথ নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরির সময় লৌলান সুন্দরীর মমির সন্ধান পান চীনা প্রত্নতাত্ত্বিকরা।
প্রাচীনকালে চীন ও এশিয়া অঞ্চলের সঙ্গে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পথ ‘সিল্ক রোড’ বা রেশম পথ ওই এলাকা দিয়েই গিয়েছিল। কোনো একসময় ওই এলাকা লৌলান রাজ্য নামে পরিচিত ছিল। এ কারণেই ওই অঞ্চলের সুন্দরী নারীর মমির নাম ‘লৌলান সুন্দরী'দেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়। চরম শুষ্কতা ও লবণের সংরক্ষণক্ষমতার কল্যাণে লৌলান সুন্দরীর চোখের পাপড়ি,চামড়া উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অক্ষত আছে। এমনকি তার গায়ের চামড়ার ভাঁজগুলোও দৃশ্যমান। লৌলান সুন্দরীকে সাধারণ পশম কাপড়ে মুড়িয়ে প্রায় তিন ফুট মাটির গভীরে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। তার পরনে ছিল চামড়ার তৈরি পোশাক,পায়ে চামড়ার জুতো,মাথায় হ্যাট,চুলগুলোও ফিতা দিয়ে বাঁধা।
মৃত্যুর চার হাজার বছর পরও অনন্য লৌলান সুন্দরী। সিনচিয়াংয়ের মরুভূমিতে সন্ধান মেলা ব্রোঞ্জ যুগের শতাধিক মমির অন্যতম এটি। এই জাদুঘরে লৌলান সুন্দরী দেশি-বিদেশি পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। তার কিছুটা বাঁকা,উঁচু-নিচু নাকের গড়নও নজর কাড়ে পর্যটকদের। 
প্রাচীন মিশরের মমিগুলোর সঙ্গে চীনা এই মমিগুলোর পার্থক্য স্পষ্ট। মিশরীয় মমিগুলোর মতো চীনা মমিগুলোতে কোনো প্রলেপ নেই। মমিগুলো তৈরি করা হয়েছে প্রাকৃতিক উপায়ে। এ কারণে চীনা মমিগুলো অনেকের কাছে বেশি আকর্ষণীয়। খ্রিস্টপূর্ব ১৮ শতকের ইতিহাসের সাক্ষী এই মমিগুলোর কেউ ছিলেন রাজা,কেউ যোদ্ধা,আবার কেউ গৃহিণী বা কৃষক।
লৌলান সুন্দরীর চেহারার সঙ্গে ককেশীয়দের সাদৃশ্য রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করেন,মৃত্যুর সময় লৌলান সুন্দরীর বয়স ছিল ৪০ থেকে ৪৫ বছর। তিনি সম্ভবত ফুসফুসের কোনো সমস্যায় মারা গেছেন। পরিবেশদূষণও এর কারণ হতে পারে।
সিনচিয়াংয়ের ওই জাদুঘরে আরো কয়েকটি মমি আছে। তৃতীয় বা চতুর্থ শতকের ছয় ফুট ছয় ইঞ্চি দীর্ঘ এক ব্যক্তির পরনে লাল ও সোনালি রঙের কাজ করা পোশাক। অষ্টম শতাব্দীর তিন মাস বয়সী এক শিশুর মাথায় টুপি,ছোট চোখ দুটি পূর্ণ করেছে নীল দুই খণ্ড পাথর। একাধিক পুরুষের মুখে লাল রঙে রাঙানো গোঁফ,মেয়েদের দীর্ঘ সোনালি চুল। অনেকের শরীরে ট্যাটু। একেকটি মমির গল্প একেক রকম।
সিল্ক রোডের পাশের ওই জনবসতি পূর্ব ও পশ্চিমের বণিকদের সম্মিলন স্থান হয়ে উঠেছিল বলে মনে করা হয়। এশিয়া ও ইউরোপের যোগাযোগের ওই পথে বিভিন্ন সময়ে ইউরোপীয়,সাইবেরীয়,মঙ্গোলীয় ও চীনা হান সাম্রাজ্যের বণিকরা যাতায়াত করেছে। চার হাজার বছর আগেও যে বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন গোত্রের মানুষ তাদের ব্যবসা ও সাংস্কৃতিকচর্চা প্রসারে দূরদূরান্তে যাতায়াত করেছে তার জীবন্ত প্রমাণ সিনচিয়াংয়ের ওই মমিগুলো। এই জাদুঘরে রয়েছে হেনান প্রদেশের সেনা নায়ক হুয়ানের মমি (৫৮৩-৬৩৩ এডি)। আছে বিশাল সাইজের চেঙ্গিস খাঁনের ব্রোঞ্জ মূর্তি।
ফার্সী ভাষায় আরব্য রজনীর অরিজিনাল কপি রয়েছে এখানে। ১৬১৬ সালে চীনের ছিংবংশের রাজত্বকালে এই কপিটি পাওয়া যায়। এই জাদুঘরে হাজার বছরের মানব সভ্যতার বিকাশের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। প্রদর্শিত হচ্ছে বিভিন্ন শতকের রেশম ও লেখনীসহ অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। ওই জাদুঘরেই এক হাজার ২০০ বছর আগের তাং সাম্রাজ্যের শুকনো খাবার রয়েছে। রয়েছে সিল্ক বা রেশমি, পশমি ও সুতি  এমনকি খাদি কাপরের তৈরি সে সময়ে ব্যবহার করা নানা ডিজাইনের নারী-পুরুষের পোশাক। 
এখানে আরো আছে প্রাচীন থেকে শুরু করে এসময়ের শিল্পীদের আঁকা শিল্পকর্ম। তেলরং, জলরং অ্যাক্রেলিক মাধ্যমে আঁকা এসব শিল্পকর্মে উঠে এসেছে এ অঞ্চলের গত পাঁচ হাজার বছরের দৈনন্দিন জীবনের রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠানসহ জীবনের নানা দিক। রয়েছে বেদুইন জীবনের নানা অবস্থার চিত্র।

স্থানীয় সরকারের ধর্ম বিষয়ক পরিচালকের সঙ্গে বৈঠক : রোববার সিনচিয়াংয়ের স্থানীয় সরকারের ধর্মবিষয়ক পরিচালক চাও চাংয়ের সাথে আমাদের বৈঠক হয়। শান্ত-সৌম্য ভদ্রলোক চাও চাং। সাংবাদিকদের সকল প্রশ্নের নির্ভেজাল উত্তর দিয়ে সকলের মন জয় করে নেন তিনি। 
বৈঠকে তিনি জানান, সিনচিয়াং সরকার ইতিহাসে পরপর বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিষ্ট ধর্মের একটি শাখা চিং ধর্ম, মোনি ধর্ম এবং ইসলাম ধর্ম সিনচিয়াংয়ে প্রচলন ছিলো বলে সিনচিয়াং বিশ্বে একমাত্র জায়গা যেখানে চারটি বড় ধর্ম এক সাথে পালণ করা হয়।
তিনি জানান, সিনচিয়াংয়ে বিভিন্ন জাতির ধর্মাবলম্বী ও ধর্মীয় মহলের ব্যক্তিরা পুরোপুরিভাবে ধর্মবিশ্বাসের অধিকার স্বাধীনভাবে ভোগ করেন। সারা সিনচিয়াংয়ে উইগুর জাতি, কাজাক জাতি ও হুই জাতিসহ মোট ১০টি জাতি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি। যা সিনচিয়াংয়ের মোট লোকসংখ্যার প্রায় ৫৬ শতাংশ। 
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পরিচালক বললেন, অজ্ঞতার কারণেই আজ আপনাদের মনে এমন প্রশ্ন। দেখুন, প্রথমত ধর্মীয় স্বাধীনতা, ছোট-বড় জাতিসত্তার ভাষা ও সংস্কৃতির রক্ষনাবেক্ষন হলো চীনা জনগনের সাংবিধানিক অধিকার। চীনে এ ধরনের মৌলিক অধিকারে কেউ কোনো দিন হস্তক্ষপ করতে পারে না। তাছাড়া ইসলামের মূল ভাবধারার সাথে সমাজতন্ত্রের কোনো বিরোধ নেই। শোষনমূলক ব্যক্তিমালিকানা ইসলাম বরদাস্ত করে না। ইসলাম ব্যক্তি মালিকানাকে আমানত বলে। কেউ এ ধরনের আমানতের খেয়ানত করলে তাকে সমাজের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।
তিনি আরো বলেন, ইসলাম ও সমাজতান্ত্রিক জীবনধারায় বিশেষ পার্থক্য নেই। বরং ইসলামের মূল বোধ সমাজতন্ত্রের জন্য সহায়ক হবে পারে। সমাজতান্ত্রিক জীবন ধারায় মানুষে মানুষে শোষন না থাকায় মিথ্যা ও প্রতারণা এড়িয়ে চলা যায় বলেই প্রকৃত ধর্মীয় অনুশাসন সহজ হয়।
তিনি জানান, সরকার আইন অনুযায়ী ধর্ম বিশ্বাসের স্বাধীনতা রক্ষা করে। সারা সিনচিয়াংয়ে ৮৮টি বিভিন্ন পর্যায়ের ধর্মীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ ছাড়াও উইগুর ভাষা, কাজাক ভাষা এবং হান ভাষাসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় নানা সংস্করণে কোরআনসহ নানা ধর্মীয় গ্রন্থ প্রকাশ করছে।
বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে আজ পর্যন্ত সিনচিয়াংয়ে মোট ৫০ হাজার মুসলমান মক্কায় হজ করেছেন। সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো হজযাত্রীদের জন্য চিকিত্সাসহ অন্যান্য সহযোগিতার নিশ্চয়তা দিয়েছে।
তিনি আরো জানান, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের রাষ্ট্রীয় বিষয়াদিতে অংশ নেওয়ার অধিকার রয়েছে। কিছু দেশপ্রেমিক ধর্মীয় ব্যক্তি জাতীয় ও নানা পর্যায়ের স্থানীয় রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলন এবং জাতীয় ও নানা পর্যায়ের স্থানীয় গণকংগ্রেসে নেতৃপদে কাজ করেন বা বিভিন্ন পর্যায়ের গণকংগ্রেসের প্রতিনিধে বা রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের সদস্য নিবাচিত হন। যে ধর্মীয় ব্যক্তিদের আর্থিক অবস্থা ভাল না সরকার তাদের ভর্তুকিও দেয়।
পরিচালকের সাথে বৈঠক শেষে আমরা যাই ঐতিহ্যবাহী উরুমচি লিওদা ওয়ান মসজিদ পরিদর্শনে। তিনিও যান আমাদের সাথে। 
এই মসজিদের অসাধারণ স্থাপত্য রীতির দিকে আমার দৃষ্টি আটকে যায়। আবর দেশের ইসলামি স্টাইল চীনা বাস্তবাতার সাথে কি এক সমন্বিত উপায়ে রূপ লাভ করেছে। সারা শহরজুড়ে সব স্থাপত্যেই এই একই রীতি লক্ষ্য করলাম।
পরিচয় হলো মসজিদের প্রধান ইমাম মোহাম্মদ আমিনের সাথে। মাত্র ৩৪ বছর বয়সী এই ইমাম বয়সে তরুণ সাদা-সিধা একজন মানুষ। 
তিনি জানান, উরুমচি লিওদা ওয়ান মসজিদটি চীনের প্রধানতম প্রাচীন মসজিদগুলোর অন্যতম। এ মসজিদ ৯৯৬ খৃষ্টাব্দে সুঙ বংশের রাজত্বকালে স্থাপন করা হয়। ছয় হাজার বর্গমিটার আয়তন এর। এর বিশাল চত্বরে রয়েছে ইমামের বাসা, মক্তব, পাঠাগার, বিশাল ফলের বাগান। সব মিলিয়ে এই এলাকায় মুসলিমদের আধ্যাত্নক প্রাণকেন্দ্র এই সমজিদ।
ইমাম আমিন আমাদের জানালেন চীনে ইমলাম প্রবেশের ইতিহাস। তাও রাজ বংশের রাজা কাও জোং-এর রাজত্বকালে ৬৫১ সালে চীনে সর্ব প্রথম ইসলাম ধর্ম প্রবেশ করে। ধাঙ ও সুঙ বংশের রাজত্বকালে আরব বনিকরা জল ও স্থল উভয়পথে চীনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। স্থল পথে বিখ্যাত রেশম সড়ক দিয়ে উত্তর-পশ্চিম চীনে তারা বানিজ্যিক-রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন। জল পথে আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর এবং মালাক্কা প্রাণালী পেরিয়ে চীনের গোয়াংচৌ, ছুয়াংচৌ, হ্যংচৌ এবং ইয়াংচৌ নগরীতে গমনাগমন করতেন তারা। তাদের অনেকই চীনে বসবাস করতে শুরু করেন। এমন কি অনেকে হান কন্যাদের বিয়ে করে স্থায়ীভাবে থেকে যান এদেশে। এভাবেই চীনের রক্তধারার সাথে আরব রক্তধারার সংমিশ্রণ ঘটে। তাদের বংশধররাই চীনের প্রথম চীনা মুসলিম। অবশ্য চীনে ইসলাম ধর্মের দ্রুত বিকাশ ঘটে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। এ সময় চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মঙ্গল জাতির অভ্যূদয় ঘটে। চেঙ্গিস খান বেইজিং পদানিত করে মধ্য এশিয়ায় বিজয় অভিযান পরিচালনা করেন। মধ্য এশিয়া থেকে ফিরে যাওয়ার সময় অসংখ্য মুসলমানদের সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। মধ্য এশিয়া হতে আসা মুসলমানদের একটি বড় অংশ এ সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। এদের অনেকে শিল্পকর্মে যোগ দেন। অনেকে সরকারি দফতরে চাকরি করেন। এদের হুই বলে ডাকা হতো। হুই সৈনিকরাই পরে চেঙ্গিস খানের পৌত্র কুবলাই খানের চীন পূন:একত্রিকরণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। হুই মুসলিমরাই মূলত চীনে ইসলাম প্রচারে বড় অবদান রাখেন। তারা নিংসিয়ায় অধিক পরিমানে কেন্দ্রিভূত হয়েছিলেন। তাদের অনেকে চীনা বিপ্লবেও অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সাল হতে নিংসায় হুই স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়। বর্তমানে হুইরা চীনের বহু অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

ইয়ুননানের পথে : সিনচিয়াং ভ্রমণ শেষে ২০ সেপ্টেম্বর রাতে আমরা পৌঁছালাম ইয়ুননানের রাজধানী খুনমিং। খুনমিং আধুনিক শহর। চির বসন্তের শহর এটি। রাস্তার দুই পাশে সবুজ গাছের সারি। চার দিকজুড়ে হাজার রকম ফুল গাছের সমাহার। রাতের বেলা রাস্তার দুপাশে আকাশছোঁয়া আলোঝলমলে ইমারতগুলো সত্যিই নয়নাভিরাম। প্রাচীনকালে মানুষ জ্ঞান অর্জনের জন্য চীন দেশে যেত। আর এখন যায় ব্যবসা বানিজ্যের জন্য।
এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে ফিরতে ফিরতে পথে দেখছিলাম খুনমিংয়ের রূপ ও সৌন্দর্য। চীনের অন্যান্য অঞ্চলের মত ইয়ুনানও পাহাড়ী এলাকা। চীনের একটি অন্যতম পর্যটন এলাকা এটি। বিশাল বিশাল পাহাড় কেটে কেটে শহর গড়ে তোলা হয়েছে। রাস্তার দু’ধার ধরে নানা রকম সবুজায়ন দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। কত নানা রংবেরংয়ের ফুলের গাছে ফুল ফুঁটে আছে। চকচকে আলো ঝলমলে শহরটি দেখে মনে হলো ঐতিহ্যকে লালন করছে আজও।
ডিনার শেষে নিজের রুমের দিকে গেলাম। বন্ধু আঙ্গুর নাহার মন্টি আর আমার জন্য হোটেলে একটি রুম বরাদ্দ ছিলো। আর তাই সারা রাতই প্রায় গল্প করে কাটলো। রাত শেষ হয়ে যায় কিন্তু আমাদের গল্প যেন শেষ হতে চায় না। সকালে ঘুম থেকে উঠতেই আকাশ ভাই জানালো নাস্তা শেষ করে আমরা যাবো ফ্লাওয়ার সিটিতে। গত বছর ডিসেম্বরে উদ্বোধন করা হয়েছে এই ফুলের রাজ্য। 
সকালে হোটেল থেকে গাড়িতে মাত্র আধা ঘন্টায় আমরা পৌঁছে গেলাম সেখানে। কি নেই এখানে! ফ্লাওয়ার সিটিতে ঢুকতেই ডিজিটাল অ্যাফেক্টের মাধ্যমে প্রায় দশ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি দেখানো হলো। তাতে তুলে ধরা হলো সভ্যতার ক্রমবিকাশের প্রথম ধাপ থেকে ফুল নিয়ে পৃথিবীর আবিস্কার, ভাবনাসহ বিচিত্র সব তথ্য। তারপরই আমরা প্রবেশ করলাম এক চোখ ধাঁধানো ফুলের রাজ্যে। 
ফুল নিয়েও এত্ত কিছু হতে পারে! চোখ যেন বিশ্বাসই করতে চায় না। কোনটা রেখে কোনটা দেখি এই ফুলের জাদুঘরে ঢুকে আমাদের যেন সেই অবস্থা। 
এই জাদুঘরে রয়েছে ফুলের ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি সেক্টর। আছে ফুলের বাগান। আরো আছে ফুলজাত দ্রব্য দিয়ে চীনাদের পারফিউম তৈরির ইতিহাস, আছে ফরাসীসহ বিভিন্ন বনিক শ্রেণীর চীনে অবস্থানের ইতিহাস। আছে ফুল দিয়ে তৈরি বিভিন্ন কসমিটিকসের জন্য একটি আলাদা কক্ষ। এ কক্ষে ফুলজাত বিভিন্ন কসমিটিকস বিকিকিনিও হচ্ছে অহরহ। 
ফরাসী কক্ষে প্রবেশ করলেই দেখা মিলবে ফরাসি সৌরভ আর ফ্যাশনের। এ সব প্রাচীন নিদর্শন-এক সময় ফরাসিরা এদেশে ছিলো তা বহন করছে। তাদের ব্যবহার করা নানা জিনিস এখানে শোভা পাচ্ছে। 
এক জায়গায় গুহার মত একটি স্পট তৈরি করা হয়েছে। সেখানে আলোক সজ্জার মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে কৃত্রিম পাহাড়-আকাশ আর সবুজ বন। পায়ের নিচেই মোটা কাঁচের স্তরের নিচে রয়েছে ঝরণার স্রোতধারা। মনে হবে যেন ঝরণার পানির ওপরে দাড়িয়ে আছি। সে এক অপূর্ব অনুভূতি।
ফ্লাওয়ার সিটি পরিদর্শন শেষে আমরা খেতে যাই একটি মুসলিম হোটেলে। আকাশ ভাই নানা রকম সুস্বাদু খাবার অর্ডার দিয়েছেন এরই মধ্যে। মৃদু লয়ে বাজছে না লোক সঙ্গীতের সুর। খাবার খেতে খেতে জমে উঠেছে আমাদের আড্ডা।
খুনমিংয়ের সেই সাংস্কৃতিক বিকেল আমার স্মৃতিতে জ্বল জ্বল করছে। বিদেশী পর্যটকদের এখানে বিচিত্রানুষ্ঠানের মাধ্যমে আপ্যায়ন করা হয়। এ এক বিশাল মিলনায়তন। এ বিস্তৃত হলরুম। দর্শকদের জন্য কয়েক শ চেয়ার সাজানো লাইন করে। সামনে রয়েছে বিরাটাকৃতির মঞ্চ। দর্শকদের মাথার ওপর ঝুলছে রঙবেরঙের আলো ঝলমলে লাইট। আদিবাসী শিল্পীরা রং ঝলমলে পোশাকে এ মঞ্চে নৃত্যগীতি পরিবেশন করেন। লোকশিল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেন তাদের দৈনন্দিন জীবনালেখ্য। এ যেন উত্পাদন ও সংস্কৃতির এক অপূর্ব মিলন। এই তারুণ্য ভরপুর শিল্পীদের অপরূপ নৈপুণ্যে আমরা সবাই মুগ্ধ। তাই তো বার বার কড়তালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে বিশাল হলরুম।
হলরুম থেকে বেড়িয়ে আমরা চলে যাই একই ক্যাম্পাসে কৃত্রিমভাবে নির্মিত আদিবাসীদের গ্রামে। এখানে তারা কি ভাবে থাকেন, তাদের পেশা, কাজ ও দৈনন্দিন জীবন-যাপন প্রণালী উপস্থাপন করা হয়েছে বাস্তবতার আদলে।

এবার বিদায় : আনন্দময় ছয়টি দিন যেন কি এক মহাঘোরে কেটে গেলো। এবার বিদায়ের পালা। অলক দা বললেন, মন খারাপ করবেন না। আনন্দে থাকবেন, ভালো থাকবেন।
মন্টি জড়িয়ে ধরে বললো : তুই মন খারাপ করবি না। তোর চোখে পানি দেখতে চাই না।
আমি মনে মনে বললাম, নাহ্। আমি কাঁদবো না। সাংবাদিকদের আবেগ থাকা মানায় না।
তারপর আমাদের দুটি পথ দুদিকে চলে গেলো। দেশি সাংবাদিকদের দলটি চলে গেলো আন্তর্জাতিক টার্মিনালের দিকে। আকাশ ভাই এবং আমি চলে এলাম অভ্যন্তরিন টার্মিনালে। পেছনে পরে রইলো কিছু স্মৃতি, কিছু কথা আর দেশের প্রতি ভালোবাসা। 

লেখক: সাবেক ফরেন এক্সপার্ট, বাংলা বিভাগ, চীন আন্তর্জাতিক বেতার (সিআরআই), বেইজিং, চীন। সম্পাদক-উইমেননিউজ২৪.কম।