প্রকৃতির রাজপুত্র শিশুসাহিত্যিক ফারুক নওয়াজ
আহমাদ স্বাধীন
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১০:৪৭ এএম, ১৮ জানুয়ারি ২০২৩ বুধবার
ভক্তদের সাথে শিশুসাহিত্যিক ফারুক নওয়াজ।
তাকে প্রকৃত অর্থেই প্রকৃতির রাজপুত্র বললে বেশি বলা হবে না। কারণ এই লেখকের লেখায় প্রকৃতি-নিসর্গ এমনভাবে উঠে আসে, যেমন করে একজন শিশু তার মায়ের সাথে কথা বলে। অথবা মা কথা বলে তার সন্তানের সাথে। অসম্ভব গভীর মমতাবোধ ও সারল্য রেখে তিনি রচনা করেন তার ছড়া ও ছোটদের কবিতা।
তার জন্ম সৃষ্টিশীল শিল্প ও সাংস্কৃতি ঘরানার এক গুনী পরিবারে। ফারুক নওয়াজের চাচা বিখ্যাত ‘শিক্ষা গুরুর মর্যাদা’ কবিতার কবি কাজী কাদের নওয়াজ।
ফুল, পাখি, লতা, গ্রাম, নদী, মাঠ ও দুরন্ত শৈশবকে কেন্দ্র করেই তিনি তৈরি করেছেন অসংখ্য রচনা। তার জাদুকরী মোহনীয় বর্ণনায় মোহাবিষ্ট হন প্রতিটি পাঠক। এ ছাড়াও আমাদের দেশের স্বকীয় একটা সাহিত্য শাখা মহান মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সাহিত্যে তার আছে ব্যাপক অবদান।
ছড়াকার ও শিশুসাহিত্যিক ফারুক নওয়াজের প্রথম বই আগুনের বৃষ্টি (১৯৭৭)। বড়োদের কবিতা। দ্বিতীয় বই ও শ্রেষ্ঠ বিবেচিত গ্রন্থ কিশোরকাব্য আমার একটা আকাশ ছিলো (১৯৮৮)। এরপর গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস-প্রবন্ধ, ছড়া-কবিতা এবং বড়োদের সাহিত্য মিলিয়ে বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১৫০ টি।
শিশুসাহিত্যিক ফারুক নওয়াজ এর জন্ম ১লা নভেম্বর ১৯৫৮, খুলনা শহরে মাতুলালয়ে। তার বাবা কাজী মাবুদ নওয়াজ প্রয়াত। মা কাজী জাহানারা। পৈতৃকবাস মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলাধীন মুজদিয়া। মা-বাবার চতুর্থ সন্তান। সৃষ্টিশীল সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্ম; তাই ছোটবেলাতেই লেখালেখির হাতেখড়ি। পড়াশুনা করেছেন খুলনা, মাগুড়া, যশোর ও ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ইসলামের ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। প্রাকমুক্তিযুদ্ধ সময়ে পত্রপত্রিকায় কবিতা ছাপার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু। সেই থেকে বিরতিহীনভাবে লিখছেন তিনি।
তার লেখা বইয়ের মধ্যে আমার পাঠ তালিকায় অনেক বই আছে, সেসব নিয়ে অল্প কথায় বলা সহজ না। আমি কয়েকটি বইয়ের কথা এখানে উল্লেখ করবো তার মধ্যে-‘নাম লিখেছি পাতায় পাতায়’ একটি কিশোর কবিতার বই। বাক্যে বাক্যে কিংবা বলা যায় শব্দে শব্দে নিখাদ মুগ্ধতার বুনন কবিতাগুলোতে। এই বইয়ের প্রায় প্রতিটি কবিতা আবৃত্তি যোগ্য। ‘ঝিলমিলানো ইমলিপাতা ইপিল-ইপিল, আম সব পাতাতে আমি আমার নাম লিখে রাখলাম ঝাবুক পাতায় চিবুক রেখে তাকিয়ে দেখো ঠিক দেখবে আমার নামটি কেমন করছে ঝিকমিক’
...(নাম লিখেছি পাতায় পাতায়ম)
ওই মাঠ, নদী- তোমাদের ছেড়ে
চাই না কোথাও যেতে
ওই বন আমি চাই চিরদিন
তোমাদের ছায়া পেতে।
এত ছায়ামায়া এত ভালোবাসা
এত স্নেহছোঁয়া মেখে
কখনোই আমি বলতে পারি কি
যাবো তোমাদের রেখে?
(কখনো বলিনি, যাবো।)
এরকম অনেক বই ও লেখা আছে যা ধরে ধরে বলতে গেলে শেষ হবে না। শিশুসাহিত্যিক ফারুক নওয়াজ একজন বহুমাত্রিক লেখক। তিনি কেবল ছড়া কবিতা ও গল্প উপন্যাস রচনা করেননি। নবীন লেখক বা তরুণদের জন্য লিখেছেন লেখালেখির ব্যাকরণ। যা প্রতিটা নবীন লিখিয়ের জন্য একটা গাইড বই। লেখালেখির ব্যাকরণ’ তার ভাবনা বৈচিত্রের একটি উল্লেখ যোগ্য সংযোজন। বইটি অন্যান্য গবেষণা ধর্মী কোন বইয়ের মতো করে তিনি লেখেননি। লেখালেখি শেখানোর কোনো জটিল নিয়ম নেই এতে। নবীন লেখকদের জন্য কিছু সহজ নির্দেশনা আছে। তাঁর ভাষায় এটা নতুন লেখদের জন্য একটা গাইড বই। ছড়া ও পদ্যে ছন্দ অনিবার্য একটা বিষয়। সেই ছন্দের সহজ ধারণাটা তিনি দিতে চেয়েছেন। অক্ষর, মাত্রা আর স্বরবৃত্ত ছাড়াও বিদেশি নানা ছন্দ সম্পর্কেও এখানো আলোকপাত করেছেন সাবলীলতার সাথে। সাহিত্যের প্রতিটি শাখা নিয়েও সাবলীল-সহজ বর্ণনা রয়েছে। কোনটা কিভাবে লিখতে হয়, এবং শুধু লিখলেই লেখা হয় না, এজন্য চাই স্পষ্ট ধারণা। সেই ধারণাটি লেখক স্পষ্ট করেছেন মাত্র।
শিশুসাহিত্যক ফারুক নওয়াজ এখন পর্যন্ত অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, এম. নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার, মধুসূদন একাডেমী পুরস্কার, ড. শহীদুল্লাহ পাঠাগার সম্মাননা, পূরবী সম্মাননা, প্রিয়জন অ্যাওয়ার্ড, পালক অ্যাওয়ার্ড, ছোটদের মেলা সম্মাননা, নজরুল সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার।
ভাবনাটা থাকে যদি শুদ্ধ তোমার...
তাহলে তোমাকে বলো ঠেকাবে কে আর!
আগে চাই পড়াশোনা তারপর সব-
দেখো আহা বৃষ্টির কত কলরব।
...(একদিন তোমাকেও চিনবে সবাই)
এই বইয়ের সবগুলো লেখায় এমন প্রকৃতির মতো মুগ্ধতা। তার আর একটি মনোমুগ্ধকর কিশোর কবিতার বইয়ের নাম- ‘আমি একদিন গল্প হয়ে যাবো’।
তোমরা করছ সারিসারি ঐ মেঘছোঁয়া-ছোঁয়া বাড়ি...
তোমাদের এই গৃহযজ্ঞকে বলব না বাড়াবাড়ি!...
শুধু অনুরোধ এটুকু আমার
এর বেশি কিছু নেইতো চাওয়ার
একটু সুযোগ রেখো,
যাতে নীল আকাশ দেখতে পারি।
আমি লিখি নদী, ঢেউয়ের কাহিনী, বৃষ্টির কাহিনিকা
আমার আকাশ না-ঢেকে বানাও সাধের অট্টালিকা।
(আমার আকাশ ঢেকো না তোমরা)
আমি কি কখনো বলেছি বৃক্ষ
তোমাদের ছেড়ে যাবো?
অরণ্য আমি সে কথা কখনো
ভুলেও আনিনি মুখে;
বিভিন্ন সাংগঠনিক প্রতীকী সম্মাননার সংখ্যাও অনেক। তিনি পেশায় সরকারি চাকরিজীবি। বর্তমানে বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর প্রোগ্রাম অফিসার। এবং একই সাথে মাসিক শিশু পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক পদে কর্মরত আছেন।
লেখালেখির এতো বছর পরেও তিনি এখোনো দুরন্ত গতিতে লিখে চলছেন রোজ। এ ছাড়াও তার পাঠের তালিকা আরো অনেক বেশি সমৃদ্ধ। দেশি বেদেশী নানা বিষয়ে বিস্তর পাঠ ও পাঠ পরবর্তী গবেষণায় থাকার পাশাপাশি এ সময়ের নতুনরা কী লিখছে, তরুণরা সাহিত্যে কী করছে, তা জানতেও তিনি সচেষ্ট। নিয়মিত তরুণদের পাঠ করেন তিনি। কেবল পাঠ না, তার কর্মস্থল শিশু পত্রিকার কার্যালয়ে একই সাথে চলে কাজ ও তরুনদের সাথে আড্ডা। যেসব আড্ডায় তিনি তরুণদের সাহিত্যে টিকে থাকা ও স্বকীয় ভাবনার নিজেকে তুলে ধরার পথ সুগম করার রাস্তা বাতলে দেন। ধরিয়ে দেন লেখালেখির নানা প্রকার ভুল। সদা হাস্যউজ্জল এই কবি প্রকৃতি ও নিসর্গ পাঠ এক অনাবিল আনন্দের অনুভূতি জুড়ে দেয় তার রচনায়। তাই তিনি ঘুরে ফিরে প্রকৃতির মাঝেই থাকেন।