প্রসঙ্গ সড়ক দুর্ঘটনা, ট্রাফিক আইন ও যানজট
ঈহিতা জলিল
উইমেননিউজ২৪.কম
প্রকাশিত : ০৪:৩৫ পিএম, ৪ মে ২০১৮ শুক্রবার | আপডেট: ০৩:৫৭ পিএম, ১৩ মে ২০১৮ রবিবার
গত ২রা মে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রেস ব্রিফিং এ সড়ক দুর্ঘটনা, ড্রাইভারের শাস্তি ও ট্রাফিক আইন মেনে চলার যে কথাগুলো বলেছেন আমি তাঁর সাথে সম্পূর্ণভাবে একমত। সেই একই কথাগুলো বেশ কিছুদিন ধরেই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কেনো ঘুরছিলো তার কথাও বলছি।
গত শুক্রবার ২৭ এপ্রিল দুপুরের পর আমি আমার গ্রামের বাড়ি কেরানীগঞ্জ যাচ্ছিলাম আমার স্বামীর মোটরসাইকেল করে। মোহাম্মদপুর নতুন রাস্তায় এক ব্যক্তি রাস্তা পার হচ্ছিলেন, আমার স্বামী তাঁকে হর্ন দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তিনি কচ্ছপ গতিতে হেঁটেই যাচ্ছেন, একসময় সে মোটরসাইকেল ব্রেক করে থামালেন উনি রাস্তা পার হলেন, আমি পিছন থেকে বললাম ভাই, এখন যদি আপনার গায়ে লেগে যেতো তাহলে তো বলতেন বাইক ইচ্ছা করে লাগিয়ে দিয়েছে। তাঁর উত্তর ছিলো, আপনি চালাচ্ছেন আপনি দেখবেন না! বলে তিনি চলে গেলেন। এখন আমার প্রশ্ন হলো রাস্তায় দেখে চলার দায়িত্ব কি শুধুই চালকদের! আমরা যারা পথচারী তাদের কি কোন দায়িত্ব নেই!
একই দিন আরো কিছুদূর যাওয়ার পর মাঝ রাস্তা দিয়ে একটা পুলিশের জীপ আর একজন মহিলা (হাতে ভাতের টিফিন ক্যারিয়ার ছিলো, সম্ভবত তিনি ভাত বিক্রি করেন) গল্প করতে করতে যাচ্ছিলেন। আপনারা হয়তো আন্দাজ করতে পারছেন, একজন মানুষ হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছেন রাস্তা দিয়ে তাঁর চলার গতির সাথে একটা জীপ গাড়ির গতি মেলাতে গেলে তার গতি কতটুকু হবে।
এবারে আমার স্বামী মোটরসাইকেলটি থামানোর পরও ঐ ভদ্রমহিলার পায়ের বৃদ্ধা আঙ্গুলে লেগে যায় এবং তাঁর নখের কোণা দিয়ে সামান্য রক্ত বের হয়। আমাদের মোটরসাইকেল তো থামানোই আছে পিছনে জ্যাম লেগে গেছে। আমরা সরি বলছি এবং তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইছি। ভদ্রমহিলা কিছুই বলছেন না। জীপের ভিতর থেকে পুলিশের একজন বেশ মারমুখী রূপ দেখাচ্ছেন। কিন্তু নামছেন না।
পিছন থেকে আরেক মোটরসাইকেল আরোহী বললেন, আপা ২০০/৩০০ টাকা দিয়ে দেন, সে ওষুধ লাগিয়ে নিবে এমন কোন ব্যাথা পায়নি। আমি তবুও তাকে বার বার বলেছি আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। সে কিন্তু রাজী হয়নি। পরে তাকে ৫০০ টাকা দিয়ে বলেছি আপনি তাহলে নিজেই ডাক্তার দেখিয়ে নিয়েন।
আমি আমার পরিচয় পুলিশের জীপে বসা ব্যক্তিটিকে দেইনি। অন্যরা আমাকে বলছিলো আমি কেনো ৫০০ টাকা দিলাম, ওর যা লেগেছে তাতে তো ১০০ টাকাও খরচ হবে না। আমি ভেবেছি অন্য বিষয়, বিষয়টা টাকার নয়। আহা বেচারী ব্যাথা পেলো। ওষুধ না হোক ভালো কিছু সে খাবে ওই টাকায়।
আর পুলিশকে পরিচয় দেইনি কারণ আমি একটা দাওয়াতে যাচ্ছিলাম অহেতুক ঝামেলা বাড়াতে চাইনি। কিন্তু এই যে পুরো ঘটনা এর মধ্যে কি আমাদের এতটুকু দোষ ছিলো! সেদিন যদি আমরা আমাদের মোটরসাইকেল ওভাবে ব্রেক করতে না পারতাম তাহলে কি হতো! রাস্তা কি গল্প করে করে যাওয়ার জায়গা? বাসচালক তো বেপরোয়া বাস চালায়ই। কিন্তু একটা ইঞ্জিনচালিত যান কি ইচ্ছা করলেই থেমে যেতে পারে!
আমি সাধারণত রিকশা, সিএনজি আর পায়ে হেঁটে চলি। আমার কাছে ঢাকার রাস্তার জমিদার কাদের মনে হয় জানেন? পথচারী আর রিকশাচালকদের। পল্টন সিগন্যাল পার হওয়ার সময় আমি রিকশাচালকদের অনুরোধের পর অনুরোধ করতে থাকি ভাই আস্তে যান, ওভারটেক করবেন না। কে শোনে কার কথা। প্রেসক্লাবের সামনে বাস দাঁড়ায় আধামিনিট থেকে সর্বোচ্চ এক মিনিট। ওইটুকু দেড়ি রিকশাচালকদের সহ্য হয় না। তারা বাসের আগে যাবেন। তখন কি হয় দাঁড়িয়ে থাকা বাসটি তো ছেঁড়ে দেয় আবার পিছন থেকেও বাস আসে রিকশাটা পড়ে দুই বাসের চিপায়। এখানে কার দোষ? আমি যে এতো বার বলছি আপনি পরে যান আমার কোন তাড়া নাই। সে তো আমার কথা শুনছে না।
আপনি রাস্তা পার হবেন? আপনি দেখছেন সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে তাও আপনি পার হচ্ছেন অথচ মাথার উপরই ওভার ব্রীজ আছে। ঐ দূর্ঘটনার জন্য কে দায়ী! একটি নামকরা স্কুলের সামনে কতগুলো এক্সিডেন্ট হলো অথচ আমি কিছুদিন আগেও দেখেছি অভিভাবকরা কিভাবে দৌঁড়ে এমনকি উল্টা দিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নির্বিকার ভঙ্গিতে। এসব কার দোষ? ছোট্ট শিশু যাকে কোলে নিয়ে রাস্তা পার হওয়া যায় তাকে যেদিকে গাড়ি চলে সেদিকে রেখে আমরা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকি। একটা গাড়ি বা কেনো সাইকেলের ধাক্কা লাগলেও তো সে মারাত্মক আহত হবে! আমি নিজে এমন অনেককে বলেছি ভাই/আপা বাচ্চাটাকে কোলে নেন, না হয় অন্য পাশে নেন। ছোট বাচ্চা রিকশায় কোলে বসানো ওর পা দুইটা বাইরে কখনো পিছন দিয়ে একটা হাত ঝুলছে, বাবা-মার খবর নাই!
আরেকটি জমিদার গোত্র সম্প্রতি রাস্তায় মাত্রাতিরিক্ত দেখতে পাচ্ছি। সেটি হলো ভ্যান গাড়ি। আমি তো জানতাম রাত আটটার আগে ভ্যান চলে না। এখন তো দেখি শুধু চলেই না হাওয়ার গতিতে চলে। একটা সিনেমা ছিলো নান্টু ঘটক। অঞ্জনা আর ওয়াসিম অভিনয় করেছিলেন। শাম্মী আখতার আর এন্ড্রু কিশোর কন্ঠ দিয়েছিলেন। গানটা হলো:
চলে আমার সাইকেল (পড়ুন ভ্যানগাড়ি/রিকশা)
হাওয়ার বেগে উইড়া উইড়া
ঢাকা শহর দেখমু
আজ দুইজনে (একলাই) ঘুইড়া ঘুইড়া
ও পাবলিক ভাই
সাইকেলের ব্রেক নাই
মইরোনা নিচে পইড়া।।
এতো গেলো দুর্ঘটনার কথা। এবার আসি যানজট প্রসঙ্গ। যে কাজটি সবাই করে থাকে, রিকশা, প্রাইভেট কার, বাস, মোটরসাইকেল, সিএনজি সবাই, তারা হয়তো সোজা বা ডানে যাবেন বায়ের রাস্তা বন্ধ করে রাখেন। যেদিকে যাবেন সেদিকে না থেকে উল্টা পাশে থাকেন। আবার রাস্তার মোড়ে এসে চিন্তা করতে থাকে আসলে সে কোথায় যাবে! মোটরসাইকেল/বাইসাইকেল তো ফুটপাথ দখল করে রাখে। আবার বাসগুলো যাত্রী ওঠা-নামা করে প্রতিটা মোড়ে মোড়ে।
যেখানে ইচ্ছা আমরা গাড়ি পার্ক করে রাখি। অনেক জায়গায় প্রস্তত রাস্তা থাকা সত্বেও যানজট থাকে।কেনো? কারণ রাস্তার দুই পাশেই গাড়ি পার্ক করা। পাশাপাশি বাসগুলো এমন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে আর কোন যানবাহন চলার উপযোগী থাকে না। এসব কাজে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে পরিবহন মালিক-শ্রমিক-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী-সাধারন পথচারীসহ সবাইকে। না হয় এভাবেই আমরা মরতে থাকবো। সঠিক আইন প্রণয়নই শুধু নয় আইনের সঠিক প্রয়োগ হতে হবে সর্বত্র।
এই যে এতোগুলো কথা বললাম, এগুলো কিন্তু আমার প্রতিদিনের জীবন থেকে নেয়া। কোন দুর্ঘটনাই কাম্য নয়। কোন মৃত্যুও কাম্য না। বাসচালকরা বেপরোয়া কিন্তু আমরা কি পরোয়া করছি? আল্লাহ তো আমাদের সাবধান হতে বলেছেন। কিন্তু আমরা কতটুকু সাবধাণ হয়ে চলি কখনও ভেবেছেন কি!? আমার নানু বলেন, আল্লায় কইসে, " হুশ কইরো বান্দা, খ্যার করুম আমি"। আমরা হুশে আছি তো?
ঈহিতা জলিল-সাংবাদিক