বাড়ছে মিথ্যে বলার প্রবণতা
আহমেদ মুশফিকা নাজনীন
উইমেননিউজ২৪.কম
প্রকাশিত : ১২:৪৩ এএম, ২৩ মে ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ০২:১৫ পিএম, ৩০ মে ২০১৮ বুধবার
দিনদিন মানুষের মধ্যে যেন মিথ্যে কথা বলার প্রবণতা বাড়ছে। রাস্তা ঘাটে পথে বাসে অনবরত শোনা যায় মানুষের মিথ্যে কথা। ক’দিন আগে বাসে করে রামপুরা যাচ্ছি। পাশে বসা এক তরুণ মোবাইলে ফোনে বলছে ‘দোস্ত আমি এখন চিটাগাংয়ে, ফিরে এসে তোর সাথে কথা বলবো।’ কথা শুনে কয়েকজন বাস যাত্রী হেসে উঠল। আমি অবাক হয়ে তরুণটির দিকে তাকালাম। তরুণটি নির্বিকার।
বাসের হেলপার বলে উঠল ‘এই মোবাইল ফোন এক আজব চীজ। বাড়ীত ঘুমাইয়া থাকলেও কই আমি এহন ফার্মেেগটে। বাসে বইসা কই বন্ধুর বাড়ী। এইটার কারণে ইচ্ছেমত যা খুশী কওন যায়। কেউ কিছু টের পায়না।’ ছেলেটির কথা শুনে ভাবতে বসলাম আমরা কি আসলেই মিথ্যের অন্ধকারে ডুবতে বসেছি?
মোবাইল ফোনে মিথ্যে কথা শোনা এবং বলার অভিজ্ঞতা আমাদের কমবেশি সবার হচ্ছে। প্রতিদিনের জীবনে আমরা অনেকেই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মিথ্যে বলছি ফোনে, মোবাইলে। ঘরে থেকেও বলছি ঘরে নেই, বাসায় বসে বলছি ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছি। যা শুনে উৎসাহিত হচ্ছে ঘরের শিশুটি। উঠতি বয়সের কিশোররা। তারা ভাবছে এটা একটা মজার খেলা। সবাই তো বলছে। দোষের কিছু নেই। ফলে তাদের চিন্তা চেতনায় ঢুকে যাচ্ছে মিথ্যে বলার প্রবণতা।
সবার হাতে হাতেই এখন মোবাইল ফোন। সবাই কথা বলছে। তবে জরুরী কথার চেয়ে এনটারটেইন্টমেন্ট হিসেবেই একে যেন ব্যবহার করা হচ্ছে বেশি। প্রেমের গল্প, অফিসের গল্প, দাম্পত্য কলহ, ভালবাসা, পরকীয়া, টাকা পয়সার লেনদেন, বাড়িভাড়া, ছেলে-মেয়ের পড়াশুনা, রাজনীতি, ছিনতাই, নিত্যনতুন বয়ফেন্ড্র, গার্লফেন্ড্র পরিবর্তন মোটামুটি সব গল্পই শোনা যায় পথে ঘাটে রাস্তায় বাসে। মোবাইলের কল্যাণে প্রাইভেসি বলে যেন আর কিছু থাকছে না। শুনতে না চাইলেও ব্যবহারকারীদের উচ্চ স্বরে বলার কারণে কর্ণকুহরে তা ঢুকে যায় অনায়াসে।
আমি মোবাইল ফোন ব্যবহারের বিরুদ্ধে নই, বিরুদ্ধে এর অপব্যবহারের। একটা জাতির তরুণ প্রজন্মরা যদি অনবরত কথা বলে তাহলে জ্ঞান বিজ্ঞান, গবেষণা সাহিত্য নিয়ে তারা চিন্তা করবে কখন? আমাদের ভরসা তো নতুন প্রজন্মই। অথচ এই প্রজন্ম নিত্য নতুন প্যাকেজে আকৃষ্ট হয়ে ব্যবহার করছে দামি মোবাইল ফোন। আর বাবা মায়েরাও তা কিনে দিচ্ছেন অনায়াসে, কখনওবা অনেকটা কষ্টেই। কিন্তু এই ফোনটি দিয়ে তাদের সন্তানটি কি করছে তার খোঁজ হয়ত অনেক অভিভাবকই রাখেন না। আর এ সুযোগটি নিচ্ছে অনেকেই।
কিছু কিশোরের সাথে কথা বলে জানা যায় তারা এনটারটেইন্টমেন্ট হিসেবেই একে ব্যবহার করছে বেশি। না ঘুমিয়ে সারা রাত জেগে বন্ধুদের সাথে কথা বলা, ফান করা, মিথ্যে করে ভয় দেখানো, গান শোনা, গেম খেলা, মিসকল দেয়া, ফোনে অন্যকে বিরক্ত করা, রিং টোন নিয়ে খেলা, মজা করার জন্য কুরুচিপূর্ণ ম্যাস্যাজ পাঠানোসহ বিভিন্ন ছবি তোলার কাজে তারা ফোনটিকে ব্যবহার করছে। অদ্ভূত বিষয় এ নিয়ে তাদের কোন অপরাধবোধ নেই। এটাকে তারা নিছক মজা হিসেবেই দেখছে। অথচ কে বোঝাবে ফোন ব্যবহার করা উচিত শুধু প্রয়োজনে।
আমরা বড়রাই তো এ বিষয়টি বুঝছি না। আমাদের আবেগকে পুজি করে বিজ্ঞাপনে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে বেশি বেশি কথা বলার জন্য। টিভি নাটক কিংবা সিনেমায় দেখা যাচ্ছে অভিনেতারা অবলিলাক্রমে মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছে মোবাইলে যা দেখে উৎসাহিত হচ্ছে অনেকেই। আমাদের সামনে যেন আজ আর কোন আদর্শ নেই। আমাদের কিছু বিজ্ঞ রাজনীতিবিদরা নানা মিথ্যে কথার ফুলঝুরি সাজিয়ে অতীতে নানান স্বপ্ন দেখিয়েছেন আমাদের। পথভ্রষ্ট আমরা মিথ্যের বেড়াজালে পড়ে ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি নৈতিকতা, মুল্যবোধ, আদর্শ।
মিথ্যে কথা বললে আজকাল আর কেউ মনে হয় অনুশোচনা করে না, উদ্বিগ্ন হয়না। বরং বন্ধু মহলে খুব গর্বের সাথে বলে বেড়ায় মিথ্যের কাহিনী। ভয় হয়। এই অবস্থা একদিন কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে? একটা মিথ্যে ঢাকতে যেয়ে যে আরও সাতটা মিথ্যে বলতে হয়। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে হয়ত অনেক কিছুই পাল্টায়। কিন্তু কিছু কিছু চিরন্তণ মূল্যবোধ যেমন ’মিথ্যে বলা মহাপাপ’, ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ এই নীতি বাক্যগুলো যদি সমাজ থেকে হারিয়ে যায় তাহলে আমাদের অবস্থানটা কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে! একবার ভাবুন তো পাঠক! আমরা কি পারি না এই মিথ্যাচর্চা থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে?
আহমেদ মুশফিকা নাজনীন : সিনিয়র নিউজ রুম এডিটর, একুশে টেলিভিশন