লিঙ্গ সমতার ভাষা
সরকার আবদুল মান্নান
উইমেননিউজ২৪.কম
প্রকাশিত : ০২:১৪ পিএম, ৩০ মে ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ১০:৫১ পিএম, ১০ জুন ২০১৮ রবিবার
ব্যাকরণে লিঙ্গ (Gender) বলতে বোঝায় জৈব গড়নের নারী বা পুরুষকে কিংবা নারী-পুরুষ নয় এমন কোনো তৃতীয় ব্যক্তিকে। আর sex বলতে বোঝায় জৈব গড়নের মানুষকে। জৈব গড়নের এই বিষয়টি জন্মগত, যার উপর মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই; স্থান, সময় ও ঘটনার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু সমাজ বিজ্ঞানে লিঙ্গ বা জেন্ডার বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে জৈব গড়নের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় পটভূমিতে নারীও পুরুষের মধ্যে যে অসমতা ও বৈষম্য তৈরি হয় সেই বৈষম্যের পরিচয়ে পরিচিত ব্যক্তিকে বলে জেন্ডার বা লিঙ্গ। অর্থাৎ নারী ও পুরুষের মধ্যে মানুষ হিসেবে যে সমতা থাকা দরকার সেই সমতা না-থেকে জৈব গড়নে নারী বা পুরুষ বলে তাদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করার নামই হলো লিঙ্গভেদ বা (gender discrimination)।
সুপ্রাচীন কাল থেকে পৃথিবী শাসন করে আসছেন পুরুষগণ। এবং পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে তার প্রণেতাগণও পুরুষ। ফলে পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে যে-সব বিধিবিধান ও অনুশাসন তৈরি হয়েছে তার সর্বত্রই পুরুষ উত্তমর্ন আর নারী অধর্মন। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে নারীদের সম্পর্ক চিরকালই দ্বান্দ্বিক। ফলে অনিবার্যভাবে জীবন ও জগতের আর দশটি লিঙ্গ-বিভেদ বিষয়ের মতো ভাষার মধ্যে লিঙ্গ-বিভেদ প্রবল। নারী ও পুরুষের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজ তৈরি করার জন্য নারীবাচক শব্দ তৈরি করা হয়েছে এবং পুরুষবাচক শব্দ তৈরি করা হয়েছে। বিষয়টির সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক তাৎপর্যপূর্ণ। পুরুষের বীরত্ব বোঝাতে ‘পৌরুষ’ শব্দ সুপরিচিত। কিন্তু নারীর বীরত্ব বোঝাতে এ ধরনের কোনো শব্দ নেই। কারণ পুরুষ-শাসিত সমাজে নারী বীরত্বের অধিকারী হবেন এটা চিন্তাই করা যায় না। কিংবা তারা অসীম সাহসের পরিচয় রাখবেন তা ছিল কল্পনাতীত। ফলে ‘পৌরুষ’ একমাত্র পুরুষের অধিকার হয়ে দাঁড়ায়। ‘পৌরুষ’ যেমন পুরুষের জন্য নির্ধারিত অভিধা যা খুবই সম্মানজনক, ঠিক তার উলটো একটি শব্দ হলো ‘অবলা’। এই শব্দটি স্পষ্টভাবে নারীদের জন্য নির্ধারিত। অর্থাৎ নারীরা অসহায়, দুর্বল এবং অন্যের আশ্রয়ে লালিত। ‘বেশ্যা’-এই শব্দটির কোনো পুরুষবাচক রূপ নেই। বরং বিভিন্ন সময়ে পুরুষগণ নারীকে এই অসম্মানজনক অভিধায় চিহ্নিত করার জন্য নতুন নতুন শব্দ আবিষ্কার করেছেন। যেমন : বীরাঙ্গণা, বারনারী, বারবধূ, বারবণিতা, বারবিলাসিনী, গণিকা, খানকী, কসবী, কুলটা, দেহোপজীবিনী ইত্যাদি। আজো সমান তাৎপর্য নিয়ে এই সব শব্দ টিকে আছে।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে নারী প্রধানমন্ত্রীগণ দীর্ঘ সময় ধরে দেশ পরিচালনা করছেন। মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী লিঙ্গাভেদসম্পন্ন শব্দ নয় বলে এক্ষেত্রে লিঙ্গসমতার প্রশ্ন উঠেনি। কিন্তু এ যাবতকাল কোনো মহিলা রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ পায়নি বলে এতদিন ধরে ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দটি নিরাপদেই আছে। কিন্তু সুদূর অথবা অদূর ভবিষ্যতে যদি কোনো নারী ‘রাষ্ট্রপতি’ হন তখন তিনি কি রাষ্ট্রপতি হবেন নাকি রাষ্ট্রপ্রধান’ হবেন? কারণ ‘পতি’ পুরুষবাচক শব্দ। এর অর্থ হলো স্বামী, প্রভু, কর্তা, রক্ষক, রাজা, নেতা উত্যাদি। কিন্তু ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ লিঙ্গসমতার শব্দ। আবার ‘লক্ষপতি’, ‘কোটিপতি’ সম্পূর্ণ রূপেই পুরুষবাচক শব্দ। কেননা চিরকালই মেয়েরা অনুৎপাদনশীল কাজের সঙ্গে অর্থাৎ যে কাজের কোনো অর্থমূল্য। তাদের ‘লক্ষপতি’ বা ‘কোটিপতি’ হওয়র কথা নয়। সুতরাং এই শব্দগুলো একমাত্র পুরুষদের জন্য নির্ধারিত। আমাদের একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানে প্রধান বিখ্যাত একজন কথাসাহিত্যিক। তিনি মহিলা এবং নারীর ক্ষমতায়ন সমতার জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর নামের উপরে লেখা আছে ‘Chairman’ । লিঙ্গসমতা বিধানের জন্য বর্তমানে এক্ষেত্রে ‘Chair’ বা ‘Chairperson’ লেখার প্রচলন আছে। ‘কবিরাজ’ বা ‘পুরোহিত’ শব্দও পুরুষের জন্য নির্ধারিত। মেয়েরা চিকিৎসাশাস্ত্র পড়বেন এবং চিকিৎসা করবেন- এই ধারণা অতি সাম্প্রতিক কালের। এদেরকে মহিলা ডাক্তার বা ডাক্তারনী বলা হতো। বর্তমানে লিঙ্গসমতার নীতিতে ডাক্তার বলা হয়। কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষে আয়ুর্বেদ চিকিৎসার যে বিপুল ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে, সেখানে নারী চিকিৎসক নেই বললেই চলে। ফলে ‘কবিরাজ’ শব্দটির ধারণাগত অবয়বের সঙ্গে পুরুষ-প্রতিমা নিবিষ্ট হয়ে আছে।
আমরা লক্ষ করেছি যে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হতে পারেন, ‘কবিরাজ’ তার পুরুষবাচকতার খোলস উন্মোচন করে ডাক্তার হতে পারেন, সেখানে মহিলাদের ডাক্তার হতে কোনো বাধা নেই এবং তাকে ‘মহিলা ডাক্তার’ বলারও প্রয়োজন নেই। কিন্তু ‘পুরোহিত’ শব্দের সঙ্গে নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকভাবে যে পুরুষ-প্রতিমা জড়িত তার কোনো পরিবর্তন আজ অবদি লক্ষ করা যায়নি। কোনো ধর্মেই নারী ধর্মীয় নেতৃত্বে কখনই আসীন হতে পারেননি। ফলে এই শব্দটির লিঙ্গসমতা নির্ধারণ সুদূর পরাহত। সম্মান ও আধিপত্যের পটভূমিতে যেমন পুরুষবাচক শব্দগুলো তৈরি হয়েছে আবার বিরল ক্ষেত্রে অসম্মানজক পুরুষবাচক শব্দও বাংলা আছে। যেমন ‘স্ত্রৈণ’। স্ত্রীর প্রতি অশোভন আনুগত্যকে ‘স্ত্রৈণ’ বলে। এই শব্দটির কোনো স্ত্রীবাচক রূপ নেই। কারণ স্ত্রীগণ স্বামীর অনুগত হবেন-এমনটাই পুরুষশাসিত সমাজের অনুশাসন। এবং যে স্ত্রী যত বেশি অনুগত হবেন তিনি তত বেশি প্রশংসার দাবিদার।
‘যাত্রী’ শব্দটির কোনো স্ত্রীবাচক রূপ নেই। ব্যাকরণ গ্রন্থে যারা ‘মহিলা যাত্রী’ লিখেন সেটা ঠিক নয়। বরং ‘যাত্রিনী’ বলে একটি শব্দ অভিধানে পাওয়া যায়, যার পরিচয় আছে বৈদিক যুগে। কিন্তু মনুসংহিতা বাস্তবায়নের পরে মেয়েদের যে গৃহপ্রত্যাবর্তন ঘটে তার পরে মেয়েদের যাত্রার আর কোনো সুযোগ থাকে না। সুতরাং ‘যাত্রী’ মানেই পুরুষ। আধুনিক যুগে এসে ‘যাত্রী’ শব্দটি লিঙ্গসমতার একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রতিমা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। চৌধুরানী, খানম, ঘোষজায়া ইত্যাদি বংশ উপাধিবাচক স্ত্রী শব্দগুলোও লিঙ্গসমতা অর্জন করেছে। যেমন : এখন তাহমিনা চৌধুরানী, আমেনা খানম বা রেখা ঘোষজায়া লেখা হয় না। লিঙ্গসমতার নীতিতে এখন লেখা হয় তাহমিনা চৌধুরী, আমেনা খান, রেখাঘোষ ইত্যাদি।
‘ছাত্র’ পুরুষবাচক শব্দ। ‘ছাত্রী’ স্ত্রীবাচক। এখন ছাত্র-ছাত্রী না-বলে লিঙ্গসমতার দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয় শিক্ষার্থী। কিন্তু ‘ছাত্র-আন্দোলন’, ‘ছাত্র-বিক্ষোপ’, ছাত্র-সমাজ, ‘ছাত্রাবাস’ ইত্যাদি ক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা তৈরি হয়নি। ‘শিক্ষার্থী আন্দোলন’ শুনতে ভালো শোনায় না। ‘শিক্ষার্থী বিক্ষোপ’ও তথৈইবচ। ‘শিক্ষার্থী সমাজ’ কথাটি অনেক দিন বললে শ্রুতিকটূত্ব দূর হতে পারে। কিন্তু ‘ছাত্রাবাসে’র কিছু করার থাকে না। ‘ছাত্রীনিবাস’ পুরনো শব্দ। তবে চলছে এখনো।
ব্যাকরণের ক্ষেত্রে আমরা বলি ‘উত্তম পুরুষ’, ‘মধ্যম পুরুষ’ ও ‘নাম পুরুষ’। প্রশ্ন হলো ‘পুরুষ’ কেন? ব্যক্তি সম্পর্কীয় ধারণাকে পুরুষ বলে। কিন্তু পুরুষ না-বলে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ গ্রন্থের প্রথম খন্ডে বলা হয়েছে ‘বক্তাপক্ষ’, ‘শ্রোতাপক্ষ’ এবং ‘অন্যপক্ষ’। কিন্তু বিগত প্রজন্ম বোঝাতে ‘পূর্বপুরুষ’ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বোঝাতে ‘উত্তরপূরুষ’ শব্দের লিঙ্গ বৈষম্য বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। সংস্কৃত ভ্রাতা-ভগ্নি মানে ভাই-বোন। কিন্তু ‘ভ্রাতৃত্ব’ অর্থ ভায়ের মতো সম্পর্ক বা অধিকার। সাধারণ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বোঝাতে এই লিঙ্গবৈষম্যপূর্ণ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এর সঙ্গে নারী প্রতিমার কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ধারণা থেকে বৃহত্তর নারীসম্প্রদায়কে বাদ রাখা হয়েছে। এর কারণ হলো এই শব্দটির সঙ্গে সমাজ-সংগঠন ও রাজনৈতিক বিষয় জড়িত। কিন্তু নারীসম্প্রদায়কে যেহেতু সামাজিক সংগঠন ও রাজনৈতিক সম্প্রীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে দেওয়া হয়নি সেহেতু ‘ভ্রাতৃত্ব’ অভিধাটিতে এরা অন্তর্ভুক্ত নয়।
‘বাঘ’ এবং ‘সিংহ’ প্রাণি দুটি শক্তি ও ক্ষিপ্রতার প্রতীক। ফলে সাহসিকতা, বীরত্ব ও শক্তিমত্তার জন্য আমরা কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে ‘বাঘের বাচ্চা’, ‘বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদ’, ‘বাঘা বাঘা ব্যক্তি’, উপাধি হিসেবে ‘বিক্রম সিংহ’, শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি অর্থে ‘পুরুষ সিংহ’, প্রধান ফটক অর্থে ‘সিংহদ্বার’ বা ‘সিংহ দরজা’, বীরত্বসূচক হুংকার অর্থে ‘সিংহনাদ’, সিংহের মতো বীরত্ব অর্থে ‘সিংহ বিক্রম’, শ্রেষ্ঠ ভাগ অর্থে ‘সিংহভাগ’, রাজাসন অর্থে ‘সিংহাসন’ ইত্যাদি অভিধা ব্যবহার করি যার প্রত্যেকটির সঙ্গে পুরুষ প্রতিমা মূর্তমান।
কতকগুলো ধর্মীয় শব্দ বা উপাধি যেমন নবী, রাসুল, ইমাম ইত্যাদি। মুসলিম নারীগণ কোরআনে হাফেজ হতে পারেন। কিন্তু হাফেজ শব্দটি পুরুষপ্রতিমা তৈরি করে। গোস্বামী, গোঁসাই, সাঁই, গুরু, জগন্নাথ, জগবন্ধু, ঠাকুর, অবতার ইত্যাকার ধর্মবিষয়ক শব্দের মধ্যে পুরুষপ্রতিমা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘পোপ’, ‘বিশপ, ‘পাদ্রি, ‘ফাদার, ‘ভিক্ষু, ‘ফুঙ্গি, ‘লামা, ‘যতি’, ‘ভ্রমণ’, ইসাম’, ‘মৌলভী’, ‘মাওলানা’, ‘মোল্লা’, ‘মোয়াজ্জিন’, ‘কাজি’, ‘মুফতি’, ‘শেখ’, ‘মুর্শিদ’, ‘পীর’, ‘ফকির’, ‘দরবেশ’, ‘আউলিয়া’ ইত্যাদি শব্দের কোনো স্ত্রীবাচকতা নেই। ‘তালুকদার’, ‘জমিদার’, ‘বাদশাহ’, ‘বাহাদুর’-এই শব্দও পুরুষপ্রতিমার রূপাবয়ব। ‘নবাব’ শব্দটি পুরুষবাচকতার সাক্ষবাহি হলেও কুমিলার সমাজহিতৈষী ফয়জুননেস ‘নবাব’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তবে এই উপাধি লাভের অন্য এক ইতিহাস আছে।
অপরাধ জগতের সঙ্গে নারীদের চেয়ে পুরুষদের সংশ্লিষ্টতা চিরকালই বেশি। ফলে এই জগৎকে কেন্দ্র করে তৈরি ভাষার অধিকাংশই পুরুষকেন্দ্রিক। যেমন ‘মাস্তান’, ‘গুন্ডা’, ‘ডাকাত’, ‘জুয়ারি’, ‘ছিনতাইকারী’, ‘সন্ত্রাসী’, ‘পেশিশক্তি’, ‘নেশাখোর’ ইত্যাদি। সাম্প্রতিক কালে নেশার জগতে কিছু মেয়ের আবির্ভাব ঘটলেও এই সংক্রান্ত শব্দ বা শব্দবন্ধ পুরুষপ্রতিমাকেই ধারণ করে।
‘সধুড়ৎ’ শব্দের বাংলা করা হয়েছে ‘নগরপিতা’ বা ‘নগরপাল’। কোনো মহিলা মেয়র হলে তাকে কি ‘নগরমাতা’ বলা ঠিক হবে। আর ‘নগরপাল’ তো সম্পূর্ণরূপে লিঙ্গবৈষম্যমূলক শব্দ। সুতরাং ‘নগরপিতা’ বা ‘নগরপাল’ ব্যবহার না-করে বহুল প্রচলিত ইংরেজি ‘মেয়র’ শব্দটিই ব্যবহার করা যেতে পারে।
সামরিক বাহিনীতে কিছু শব্দ বহুল প্রচলিত। যেমন ‘সৈন্য’, ‘সেনাপতি’, ‘সর্বাধিনায়ক’, ইংরেজি ‘sentry’ থেকে আসা ‘সান্ত্রী’ ইত্যাদি শব্দও পুরুষদের প্রতিনিধিত্ব করে যদিও বর্তমানে মেয়েরা এই সব পদে চাকরি করেন।
একজন মেয়ের সঙ্গে অন্য কোনো মেয়ের সখ্য তৈরি হলে এক সময় একজন অন্য জনের ‘সখি’ হতো। পরে ‘বন্ধু’র স্ত্রীবাচক শব্দ ‘বান্ধবী’ প্রচলিত হয়। কিন্তু বর্তমানে মেয়েরা একজন অন্যজনকে ‘বন্ধু’, ‘দোস্ত’, ‘ফ্রেন্ড’ ইত্যাদি বলে সম্বোধন করে। অর্থাৎ ছেলে ও মেয়েদের সম্বোধনের স্বাতন্ত্র্য ক্রমেই দূরিভূত হয়ে একটি লিঙ্গসমতার ভাষা তৈরি হচ্ছে।
বাংলা ভাষায় এইসব লিঙ্গবৈষম্য থাকলেও বাংলা লিঙ্গসমতার ভাষা। বিশেষ করে ইংরেজি ভাষার সঙ্গে তুলনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমেই চারটি সর্বনামের উল্লেখ করা যায়। He, She, His, Her । এই চারটি সর্বনাম নারী ও পুরুষকে সম্পূর্ণ রূপে আলাদা করে দিয়েছে। এবং বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ইংরেজি ভাষাভাষী বিশ্বে ‘He’ এবং ‘His’ ইত্যাদি সর্বনাম একচেটিয়া সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল। ১৮৫৭ সালে বেলগাঁওয়ের পোস্টমাস্টার তাঁর মেয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার (বর্তমানে এসএসসি) অনুমতি চেয়ে মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে দরখাস্ত লিখেন। বিশ্ববিদ্যালয় কোডে প্রার্থী সম্পর্কে ‘He’, ‘His’, ‘Him’ ইত্যাদি পুরুষবাচক সর্বনাম থাকায় কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী মেয়েদের পরীক্ষার অনুমতি দেওয়ার কর্তৃব্য তাদের নেই। তার মানে ইংরেজি ভাষার লিঙ্গবৈষম্য শুধু ইংরেজি ভাষাভাষী মেয়েদেরই বঞ্চিত করেনি বরং ব্রিটিশ উপনিবেশভুক্ত সকল ভাষার মেয়েদেরই বঞ্চিত করেছে। ইংরেজি ভাষার এই লিঙ্গবৈষম্যের কিছু উদাহরণ দিই :
- The teacher is usually appointed on the basis of his training.
- The learner should not be cut off from his roots; his own culture and traditions should be respected.
প্রথমটিতে শিক্ষক (teacher) সবাই পুরুষ (his) এবং দ্বিতীয়টিতে শিক্ষার্থী (learner) সবাই ছেলে (his)। অথচ দুটি উদাহরণে his এর স্থলে their বসালেই লিঙ্গসমতার বিষয়টি নিশ্চিত হতো। অন্য একটি উদাহরণ দিই যেটি আরও ভয়াবহ। There were 16 girls and 16 boys in the class. Each child was to write an essay on his favorite hobby. ক্লাসে ১৬ জন করে ছেলে ও মেয়ে আছে। কিন্তু মজার বিষয় হলো তাদের সখের উপর রচনা লিখতে গিয়ে সবাই (his) ছেলে হয়ে গেল। অথচ his এর স্থলে his or her অথবা their লিখলেই মেয়েরা ছেলে হয়ে যেত না। সুতরাং লক্ষ করা যায় যে ইংরেজি ভাষায় ‘he’ এবং ‘she’ নিয়ে গোলযোগ আছে। এবং এই লিঙ্গবৈষম্যের সর্বনামগুলো ইংরেজি ভাষাকে শুধু নয় ভাষা সংশ্লিষ্ট জীবন ও জগৎকে উৎকট ঝামেলার মধ্যে ফেলেছে।
বাংলা ভাষায় ‘সে’, ‘তিনি’, ‘তার’ ইত্যাদি সর্বনাম লিঙ্গ-সুষম। অর্থাৎ ‘সে’, ‘তিনি’, ‘তার’ ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ উভয় জৈবগড়নের লোককেই বোঝায়। এই লিঙ্গ-সুষম সর্বনামগুলো বাংলা ভাষাকে বিস্ময়কর উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। লিঙ্গসমতার এই ভাষা-সংগঠন বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তি ও সৌন্দর্যের পরিচায়ক।
ইংরেজিতে ‘man’ মানে ‘মানুষ’ নয়- পুরুষ, পুরুষ জাতি। আর ‘human’ মানে হচ্ছে মানুষ বা মনুষ্যজাতি সম্বন্ধীয় বা মানবীয় ইত্যাদি। কিন্তু ইংরেজিতে কতটা নির্বিচারে ‘man’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা দেখুন : ‘businessman’, ‘mailman’, ‘camraman’, ‘newsman’, ‘policeman’, ‘salesman’, ‘freshman’, ‘middleman’, ‘craftsman’, ‘craftsmanship’, ‘draughtsman’, ‘fireman’, ‘layman’, ‘sportsman’, ‘mankind’, ‘manpower’ ইত্যাদি। অর্থাৎ লিঙ্গবৈষম্যের চরম অবস্থায় বিরাজ করছে ইংরেজি ভাষা। বাংলা ভাষায় এই ধরনের লিঙ্গবৈষম্যের কোনো সুযোগ নেই। লিঙ্গবৈষম্যমূলক ইংরেজি শব্দগুলোর পরিচিত বাংলা দেখে নেওয়া যায়। ‘ব্যবসায়ী’, ‘ডাকপিওন’ বা ‘ডাকহরকরা’, ‘চিত্রগ্রাহক’, ‘সংবাদকর্মী’, ‘পুলিশ’ বা ‘পুলিশের লোক’, ‘বিক্রেতা’, ‘শিক্ষানবিস’, ‘দালাল’ বা ‘মধ্যসত্বভোগী’, ‘কারিগর’, ‘কারিগরি দক্ষতা’, ‘নকশাকার’, ‘দমকল বাহিনী’, ‘অ-পেশাদার’, ‘খেলোয়ার’, ‘মানবজাতি’, ‘জনবল’ বা ‘জনশক্তি’ ইত্যাদি। লক্ষণীয় যে, লিঙ্গবৈষম্যপূর্ণ ইংরেজি পেশাবাচক শব্দগুলোর বাংলা লিঙ্গসমতায় অসাধারণ। বাংলা ভাষায় লিঙ্গসমতার যেটুকু অভাব আছে ভাষানীতি প্রণয়নের মাধ্যমে তা দূরিভূত করা সম্ভব।
লেখক : অধ্যাপক, গবষেক, প্রাবন্ধকি, শশিুসাহত্যিক।