গল্প : ঈর্ষা
আফরোজা নাজনীন
উইমেননিউজ২৪.কম
প্রকাশিত : ০২:২০ এএম, ১ জুন ২০১৮ শুক্রবার | আপডেট: ১২:১০ এএম, ২২ জুলাই ২০১৮ রবিবার
আজ শিল্পকলা একাডেমীতে দশ দিনব্যাপী চিত্রকলা উৎসব শেষ হলো। আমার আঁকা ঈর্ষা ছবিটি পুরস্কৃত হয়েছে। সাধারণ দর্শকদের মধ্যে ছবির নামকরণ নিয়ে মতোবিরোধ। এমন একটি হাস্যোজ্জ্বল মেয়ের ছবির ভেতরে ঈর্ষা কোথায়? বোদ্ধা দর্শকরা বুঝে নেয় চোখের দু’কোল বেয়ে ফেটে পড়ছে ঈর্ষার কালো নদী। অথচ এই ভঙ্গীতে আঁকা ছবিতে আমি কোনো ঈর্ষা ফোটাতে চাইনি। তবে কি আমার ভেতরের কালো সাপটাই জায়গা করে নিয়েছে আমার সৃষ্টির ভেতর? হবেও বা। তা-না হলে আহলাদে ঢলে পড়া এই সুখি মূর্তির চোখের ভাষা অমন কেনো? ঈর্ষায় কালো। যে ঈর্ষার কোনো কারণ নেই। কোনো ব্যাখ্যা নেই।
আমি বসে আছি মেয়েটার জন্য। যাকে নিয়ে আমার এই পঙ্গু জীবনে এমন স্বীকৃতি। শিকারী যেভাবে বসে থাকে মাচার উপর বাঘের আশায়, বক যেভাবে এক পায়ে একঠায় দাঁড়িয়ে থাকে লম্বা ঠোঁট বের করে মাছের আশায়, আমিও ঠিক তেমনি বসে থাকি কখন এগারোটা বাজবে, সকালের পড়ন্ত রোদ ওদের লাল সিরামিক ইটের বাড়িটায় তেরছা করে পড়বে। বারান্দার বরফিকাঁটা মোজাইকে নারকোলের চিরল পাতার সাথে লুকোচরি খেলবে রোদের হলুদ আভা। আর তখনি মেয়েটা এসে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়াবে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে পেয়ারাবাগের শেষ মাথা পর্যন্ত ছড়িয়ে দেবে দৃষ্টি। তারপর যতোই দেরি হবে ততোই অধৈর্য হয়ে পড়বে। রেলিং ধরে উঁকি দিয়ে দেখবে। ছিপছিপে শরীরের ভার রেলিং এর উপর রেখে, ঝুকে যতোদূর সম্ভব বেঁকে রাস্তার ও মাথা পর্যন্ত দেখার চেষ্টা করবে। পিঠের উপর থেকে আচঁল খসে পড়বে। ছোট ব্লাউজের নিচেই কোমড়ের নরম ভাঁজ। চকচকে চিতল মাছ যেনো। এই এক দৃশ্য দেখতে দেখতে আমার মধ্যে নেশা ধরে যায়। চোখের নেশা ক্রমে ক্রমে মনের খোরাক হয়ে গেছে। মেয়েটার এই প্রতীক্ষার মুহূর্তগুলো এখন আমার সময় কাটানোর খেলা। ওকে দেখি, সেই সাথে নিজের কাজ করি। এমনি ভাবে প্রচুর ছবি জমে গ্যালো। তেল রং-এ, সাদাকালোর মিশালে চমৎকার মোহনীয় ভঙ্গীর রমণীর মুগ্ধ অবয়ব। মেয়েটা আমার ছবির মডেল। বন্ধুরা অবাক। প্রশংসায় পঞ্চমুখ। খাসা মাল। ওদের জিজ্ঞাসা-বল শালা পেলি কোথায়?
আমি বলি কল্পনা। এই ভাবেই চলছিলো রং-এর খেলা। সেই সাথে মনের ভেতর মেয়েটার মূর্তি গড়ে ওঠে সম্পূর্ণ মানবী রূপে, তা টের পাইনা। হঠাৎ কোন কারণে জানিনা মেয়েটা বারান্দায় আসে না। আমি ছটফট করি যেনো ডাঙায় তোলা ইলিশ মাছ। তখনি নিজের ভেতর ধাক্কা খাই। বুঝতে পারি আমার এই পঙ্গু জীবনে মেয়েটা বড় দরকারি। নিত্য দিনের প্রয়োজনীয় জিনিসের মতো মেয়েটা আমার দৈনন্দিন জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে, হাতের কাছে দাড়ি কাঁটার রেজার না পেলে, বাথরুমে হাতের কাছে সাবান-তোয়ালে না পেলে যেমন চেঁচিয়ে উঠি, লাথি মেরে মানে ক্রাচের ধাক্কায় যেমন বালতি ফেলেদি, তেমনি যেদিন মেয়েটা বারান্দায় আসে না, রং তুলি নিয়ে আমি খেলায় মেতে উঠতে পারিনা-সেদিনও হাতের কাছে যা পাই ছুঁড়ে ফেলি। বিছানার চাদর তুলে বারান্দায় ছুঁড়ে ফেলি-সিগারেটের কাগজ খসিয়ে শলাগুলো দুমড়ে মুচড়ে ফেলি। মা, ছোটবোন দৌড়ে আসে-কি হয়েছে? কি চাই? বলে চেঁচায়। কিন্তু আমি কিছু বলতে পারি না। সবাই বুঝে নেয় এই পঙ্গু জীবনের ভার সইতে না পেরে, মাঝে মাঝে অধৈর্য হই। মা আচঁল চাপা দিয়ে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদেন। আর বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধকে অকারণে গাল দেন। আমি তখন ক্রাচে ভর করে উঠে যাই, সশব্দে জানালাটা বন্ধ করে দেই যাতে আর চোখের উপর ঐ লাল সিরামিকের বাড়িটার মোজাইক করা বারান্দাটা দেখতে না হয়। একা একা পেশেন্স খেলার পর মেয়েটা আমার অন্য নেশা।
কিছু দিন পরই অবশ্য বুঝতে পারলাম চিতল মাছের চকচকে শরীর বারান্দার উপর ছেড়ে দিয়ে মেয়েটা কার অপেক্ষায় রাস্তায় দিকে তাকিয়ে থাকে। ব্যাপারটা জানার পর আমার খুব হাসি পায়। প্রেমিকের জন্য উত্থাল-পাথাল অস্থিরতা নিয়ে মেয়েটা অপেক্ষা করে পিওনের জন্য। যেনো নদী অপেক্ষা করে জোয়ারের। আমি আনন্দ পাই এই ভেবে যে, আরবী ঘোড়ার মতো টগবগে স্বাস্থ্যবান, সুস্থ কোনো পুরুষের জন্য মেয়েটার অপেক্ষা নয়, অপেক্ষা পিওনের জন্য। চিঠির জন্য। একদিন দেখি মেয়েটা বারান্দায় মোড়া পেতে খুব আয়েশ করে চিঠি পড়ছে। আকাশে বিদ্যু ঝিলিক দেয়ার মতো, শান্ত পুকুরে ঢিল ছোঁড়ার মতো, নদীর বুকে শুশুক লাফ দিয়ে ওঠার মতো একটা চিন্তা বুকের নদীতে তোলপাড় তোলে। চিঠিটা নিশ্চয় ওরে প্রেমিক কিংবা স্বামীর। টগবগে আরবী ঘোড়ার। বুকের ভেতর ভারী মনে হয়। নিকোটিনে তামাটে হওয়া আঙুলে সিগারেট খুঁজি। মনে মনে কল্পনা করি বলিষ্ঠ যুবক, ছয়ফিট লম্বা প্রচন্ড সাহস বুকে এমন পুরুষ। নিজের ভেতর বেদনা বোধ উঁকি দেয়। আমিতো শালা নেংটি ইদুর। একটা টিকটিকির লেজও খসাতে পারিনা। তবুও এই খেলা আমার দৈনন্দিন কাজের মতো প্রথাসিদ্ধ। আমার নেশা। আমার পঙ্গু যৌবনে চরসের নেশা। আমার বেঁচে থাকা। এই ভাবেই ওকে ঐ চিতল মাছকে আর নিজের থেকে আলাদা মনে করতে পারি না। বহুদিনের প্রিয় গানের কলি ’ভাঙা পথের রাঙা ধুলায় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন’ গুনগুন করি। ইচ্ছে করে ধুলো পড়ে থাকা হারমোনিয়ামটা খাটের নিচ থেকে বের করে ওর ভাঙা রীডগুলোয় সুরের বাজনা তুলি।
একটা হিসেব করে দেখেছি সপ্তাহে দু’দিন মেয়েটার চিঠি আসে। তখন মেয়েটা পালক ঝাড়া দেয়া ঝকঝকে রাজহংসী। বারান্দায় দাঁড়িয়েই চিঠি পড়বে। হেসেই অস্থির। আবার ভ্রুকুটি। আচ্ছা কি লেখে সেই আরবী ঘোড়া? এমন চকচকে চিতল মাছের মতো মেয়েকে তো কতো কিছুই লেখা যায়।-লক্ষ্মী বউ কিংবা লক্ষ্মী মনি কিংবা বউমনি। এসব মনে হতেই নিজের ভেতর সেঁধিয়ে যাই। সিধকাঁটা চোরের মতো খুব সপ্তপর্ণে নিজের অতীতে ঢুকে যাই। শুকনো পাতার মচমচ শব্দ না হয় কেউ যেনো জানতে না পারে ঠিক এমনি ভাবে অভিসারিকার মতো পেছনের দিকে তাকাই। যখন ময়মনসিংহ মেডিকেলে পড়তাম-তখন প্রতি সপ্তাহে ঠিক এই আরবী ঘোড়ার মতো আমিও তো ঢাকার উদ্দেশ্যে এমন চকচকে সেই শ্যামলা দীর্ঘকায় রমনীকে লিখতাম-লক্ষী মিতি আমার। আমারও সময় কাটে না আর। দুকূল ছাপিয়ে আমাকে এভাবে গ্রাস করছে কেনো বিষাদ কন্যা। আমি এখন হাল ভাঙা নবিক দারুচিনি দ্বীপের সন্ধানে ঘুরছি শুধু।
পাঁচ বছরের শিশুর প্রিয় খেলনা অভিমান ভরে ছুঁড়ে ফেলার মতো আমিও তো মিতিকে ছুঁড়ে ফেলেছি জীবন থেকে। কারণ আমি জানতাম আমার এই পঙ্গু জীবনের সাথে ওর মতো যৌবনময়ী রমনীকে জড়ানোর আনন্দ আর সিনেমার প্রতিনায়কের নায়িকাকে অলিঙ্গনের আনন্দ এক। কারণ দুটোই সাময়িক। পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে কেমন অসুস্থ বোধ করি। ঘেমে উঠি। পাঞ্জাবী গায়ের সাথে লেপ্টে যায়। মুখ থেকে টক টক ঢেকুর ওঠে। মাথা ঝিমঝিম করে। বমি আসতে চায়। বালিশের নিচে রাখা লারগাকটিলের প্যাকেট খুঁজি। নিজেকে খিস্তি করি-শালা কুঁজো চায় চিৎ হয়ে শুতে।
মেয়েটা আজ পায়ে আলতা পড়েছে, বেশ নকসী কাঁটা। সবুজ শাড়ি। হাতে দু’গাছা করে সোনার চুড়ি। উল বুনছে। বেশ কয়েকদিন যাবৎ দেখছি ক্রীম কালারের পুলওভার বুন্ছে। আর ঘন ঘন রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। এখন এগারোটা দশ। আমি মনে মনে খুশি হই। অনেকক্ষণ তোমাকে বসতে হবে হে চিতল মাছ! কারণ পিওনের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। আমি রং তুলি নিয়ে বসি। মেয়েটা ধ্যানমগ্ন! শুধু হাতের ওঠা-নামা। মুখে মৃদু হাসি। এ হাসির কোন ব্যাখ্যা হয় না। সেই দা ভিঞ্চি’র মেয়েটার হাসির মতো। আমিও এঁকে যাই একের পর এক ছবি। হাস্যোজ্জ্বল, অভিমানী প্রিয়া। মেয়েটা উঠে দাঁড়ালো। ঝুকে পড়লো। ছিপছিপে শরীরের ভার ছেড়েদিলো রেলিং এর উপর। বুকের কাছ থেকে আঁচল সরে গ্যাছে। গলায় চিকন সোনর চেইন। মসৃণ বুকে কি নিটোল লাবন্য। আমি দেখি। আমার হাতের তুলি চলে না। নারী, তুমি শুধু মনে নয় দেহমন মিলিয়েই রহস্যময়ী। তোমাকেই ঈশ্বর নিজস্ব চিন্তা ভাবনায় সৃষ্টি করেছেন। যে জন্যই তুমি এতো অপরূপ হে নারী।
আজ যেনো মেয়েটা বড় বেশি ঝুকে পড়ছে-ইস্ পড়ে যাবে নাতো। বুকের ভেতর পঙ্গু হৃদপিন্ডটা ধক্ করে ওঠে। মেয়েটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে গ্যালো। আমি জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে দেখি পিওন দাঁড়ালো না। হনহন করে রাস্তা দিয়ে চলে গ্যালো। মেয়েটার মুখ এক নিমিষে ফটোর নেগেটিভের মতো কালো হয়ে গ্যালো। ধপ করে মোড়ায় বসে পড়লো। উল তুলে নিল হাতে। কিন্তু বুনলো না। ফরফর করে টেনে খুলে ফেলতে লাগলো। আমি বুঝলাম, যার চিঠি আসার কথা তিনিই এই পুলওভারের মালিক।
কয়েকদিন যাবৎ ঢাকায় আঝোয় ধারায় বৃষ্টি। জানালা খোলা যায় না। ঝাপটা এসে সব ভিজিয়ে দিয়ে যায়। তাছাড়া ডাক্তারের কড়া নিষেধ-জল হাওয়া থেকে দূর থাকুন। আমার ফুসফুসে দোষ আছে। ঠান্ডায় এবং দুঃশ্চিন্তায় তা মাঝে মাঝে প্রবলভাবে বেড়ে যায়। বৃষ্টির কয়েক দিন আমি ব্যাঙের মতো চিং হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকি। কাহাতক জানালা বন্ধ করে অন্ধকার ঘরে ফাঁসির আসামীর মতো থাকা যায়। হাতে ভর দিয়ে বুকে কাশি নিয়ে উঠে পড়ি। পা ঘষতে ঘষতে জানালার কাছে যাই যেভাবে শত্রু এলে ঝট করে রাইফেল তুলতাম, তেমনি ঝট করে জানালার দু’পাল্লা খুলে ফেলি। সামনের বাড়িতে এক বলিষ্ঠ পুরুষ, প্রায় ছয় ফুট, পুলওভারের মালিক। সকাল এগারোটা বেজে যায়, যাকে দেখার জন্য বসে থাকি সে আসে না।
ছিপছিপে চিতল মাছের মতো চমচকে শরীর নিয়ে মেয়েটা এখন আর কারো অপেক্ষা করে না। শুধু সকাল সাতটায় যখন ওর স্বামী অফিসে যায় তখন চোখে হাসি নিয়ে প্রথম ফোটা কদম ফুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ওর স্বামী ছয় ফুট লম্বা-সেই পুলওভারে মালিক। যে পুলওভারে মিশে আছে কতো অভিমান, প্রতীক্ষার কতো সপ্রাণ প্রহর। তিনি গাড়িতে উঠে পড়েন-মেয়েটির চোখে তখন কি অপার্থিব সুখ!
মেয়েটার অনেক ছবি এঁকেছি। কতো বিষন্ন প্রহর! কতো হাস্যোজ্জ্বল সময়ের সাক্ষী, আমার আঁকা ছবি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও এই মুহূর্তের কোনো ছবি আঁকতে পারি না। আমার তুলি তখন যেনো রাইফেল হয়ে ঐ ছয় ফুট লম্বা পুলওভারের মালিকের হৃদপিন্ড চিড়ে দিয়ে রক্তের ফিনকি বইয়ে দেয়। যে রক্তে ঐ ক্রীম কালার পুলওভার লাল হয়ে ফেটে পড়বে। যে পুলওভারে মিশে আছে কতো প্রহরের অভিমান, প্রতীক্ষার নিদারুণ বিষন্নতা।