টুঙ্গিপাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসের মানচিত্র
নিজস্ব প্রতিবেদক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১০:১৪ এএম, ১৫ আগস্ট ২০২৩ মঙ্গলবার
সংগৃহীত ছবি
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,যার জন্ম না হলে দেশ স্বাধীন হতো না। বাঙালী পেতোনা স্বাধীন পতাকা,মানচিত্র একটি ভুখন্ড। তিনি চীরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন, জন্মধন্য গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় প্রিয় মা ও বাবার পাশেই। পরপর তিনটি কবরকে ঘিরে নির্মাণ করা হয়েছে একটি সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স। আর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বঙ্গবন্ধুর সমাধীসৌধটি ইতিহাসের এক স্বাক্ষি হয়ে আছে নিরবনিস্তব্দ হলেও প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়ে দেশ-মাতৃকা স্পন্দন হয়ে পাল্টে দিয়েছে টুঙ্গি পাড়াসহ সমগ্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিত্র।
এখানে প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানাতে আসেন মানুষেরা। আজ (১৫ আগষ্ট) মঙ্গলবার আজও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি। রাজনীতিবিদসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ দেশ-বিদেশেরা এখানে এসেছেন প্রিয়নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং দর্শনার্থীদের ভিড়ে মুখর থাকে টুঙ্গিপাড়ার।
সমাধিসৌধ, শেখ রাসেল শিশু পার্কসহ বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো ঘিরে গড়ে উঠেছে এখানে ইতিহাসের যাদু ঘরে। বাইগার নদীর তীরে টুঙ্গিপাড়া গ্রামটি এখন ইতিহাসের একটি পথপ্রর্দশক বাঙালী জাতির নিকট। এই গ্রামেই জন্মেছিলেন, ইতিহাসের শ্রেষ্ট পুরুষ বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। এই বাড়িতেই সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স। স্মৃতি সৌধটি ৩৮ দশমিক ৩০ একর সম্পত্তির ওপর নির্মিত। এর স্থাপত্যশৈলী লাল সিরামিক ইট আর সাদা-কালো টাইলস দিয়ে গ্রীক স্থাপত্যশিল্পের আদলে নির্মিত। সমাধীসৌধটি কারুকার্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বেদনার তুলিতে পরতে পরতে চিত্রসব।
গত ৬ আগষ্ট বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সফরসঙ্গী হয়ে ঘুরে দেখা স্মৃতি আমার, সাদা পাথরে নির্মিত গোলাকার একটি গম্বুজবিশিষ্ট সমাধিসৌধের ওপর দেয়ালে জাফরি কাটা। জাফরি কাটা দিয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ করে। ওপরে কাচের কারুকাজ বিভিন্ন আঙ্গিকে বাইরের আলো ছড়িয়ে পড়ে কবরস্থানের। এর চারিপাশে কালো টাইলসসহ মাঝে শ্বেতপাথরের শুভ্র সৌন্দর্যে বাধাঁনো জাতির পিতার সমাধী বা কবর, সেই সঙ্গে মা ও বাবার কবর রেলিং দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।
কমপ্লেক্স এলাকায় বঙ্গবন্ধুর আদি পৈতৃক বাড়ি, ছেলেবেলার খেলার মাঠ, প্রিয় বালিশা আম গাছ, বড়তালাব (পুকুর) শেখবাড়ি জামে মসজিদ (স্থাপিত ১৮৫৪ সালে) ইত্যাদি। রয়েছে হিজলতলা ঘাট, যেখানে সাঁতার কাটতেন ছোটবেলায় জাতির পিতা সেই ছোট বেলার নানা স্মৃতি মাখা স্থানগুলো। স্মৃতিসৌধের দক্ষিণে মুল প্রবেশপথে রয়েছে একটি পাঠাগার ও যাদুঘর।
এই পাঠাগারটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা বইসহ প্রায় আট হাজার বই রয়েছে। রয়েছে নামাজের জন্য একটি মসজিদ, গবেষণাকেন্দ্র, প্রদর্শনীকেন্দ্র, উন্মুক্ত মঞ্চ, পাবলিক প্লাজা, প্রশাসনিক ভবন, ক্যাফেটেরিয়া, বকুলতলা চত্বর ও স্যুভেনির কর্নার। সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স থেকে ৩০০ মিটার দূরে সাবেক খাদ্যগুদামের পাশে বাইগার নদীর তীরে ও দুই কিলোমিটার দূরে পাটগাতী বাজার সংলগ্ন মধুমতী নদীর তীরে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত দৃষ্টিনন্দন দুটি লঞ্চঘাট। সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সের পাশেই টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার উদ্যোগে নির্মিত শেখ রাসেল শিশু পার্ক। রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের আলোকচিত্র প্রদর্শনীকেন্দ্রে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা শিল্পকর্ম, বাঙালীর মুক্তিসংগ্রামের নানা পর্যায়ের দেশ-বিদেশ থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র।
আরো রয়েছে বঙ্গবন্ধুকে যে কফিনে করে ঢাকা থেকে সামরিক হেলিকপ্টারে নিয়ে আসা হয়েছিল, সেটিও সংরক্ষিত এখানে। টুঙ্গিপাড়ার কমপ্লেক্স এলাকায় দর্শনার্থীরা বঙ্গবন্ধুর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি, আন্দোলন-সংগ্রাম, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ও ত্যাগ সম্পর্কে জানতে পারে।
দর্শননার্থীদের স্মৃতিসৌধটি দেখার সময়: প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স এবং সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পাঠাগার খোলা থাকে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে প্রতিদিন এখানে ১০ হাজারের অধিক দর্শনার্থী আসে। শীতকালে এই সংখ্যা আরো বেশি হয়। এখানে দর্শনার্থীদের খাওয়া ও থাকার জন্য আশেপাশে গড়ে উঠেছে, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও দোকানে বেচাকেনাও বেড়েছে। ভ্যান, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন পরিবহনের চালকদের আয় বেড়েছে। এতে টুঙ্গিপাড়ার অর্থনীতি চাকা ঘুড়ে যাচ্ছে বলে স্থানীয়দের দাবি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে পদ্মা সেতু হওয়াতে মানুষ আসছে, আমাদের কেনাবেচা অনেক বেড়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজির্ষ্ট্রাট ডা. মির্জা নাহিদা হোসেন বন্যা বঙ্গবন্ধু স্মৃতিসৌধে জহুরের নামাজ আদায় করে বলেন, নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এখানে শিক্ষা সফরে এসে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারছে। মহান নেতার নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন তাঁকে এবং তাঁর স্মৃতিকে যুগে যুগে বুকে ধারন করে নতুন প্রজন্ম দেশকে ভালবাসবে এবং অপশক্তির হাত থেকে দেশকে রক্ষা করবে সেই মহান নেতা ঘুমিয়ে আছে টঙঙ্গি পাড়াতেই শুধু নয়, প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়ে তিনি ঘুমিয়ে আছেন।
মির্জা নাহিদা হেসেন বন্যা আরো বলেন,দেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষক অধ্যক্ষকের প্রতি অনুরোধ করছি আপনার বিদ্যালয়ের কলেজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি বছর শিক্ষাসফরে নিয়ে আসুন টুঙ্গিপাড়ায়। তাদের জানতে দিন দেশের ইতিহাস। সৃম্মিসৌধে আমাদের কমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ বারবে দেশ-মাতৃকাকে ভালোবাসতে। অনেকের পাঠ্য বইয়ের সুবাদে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে পারছে এখানে আসলে তারা পাঠ্য পস্তুকের পাশাপাশি বাস্তবে অনেকে কিছুই শিখতে পারবে বলে জানান তিনি। এখানে এসে তাদের জানা সম্পূর্ণ হবে, ছোট-বড় সবার প্রিয় বঙ্গবন্ধকে।
স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা হলে , জেলা প্রশাসক কাজী মাহবুবুল আলম বলেন, জাতির জনকের সমাধিকে ঘিরে প্রতিদিন দেশী-বিদেশীসহ সকল বয়সের মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। পদ্মা সেতু হওয়ার পর এই সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে।তিনি আরও বলেন, যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হওয়ায় বেশি দর্শনার্থী আসছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে একসময় টুঙ্গিপাড়া গ্রামটি পাটগাতী ইউনিয়ন পরিষদের আওতাধীন ছিল। এখন টুঙ্গিপাড়া পৌরসভা ও উপজেলা সদর।
উল্লেখ্য: টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নিজ বাসভণে ঘাতকের বুলেটে তিনি সপরিবারে শহীদ হন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বঙ্গবন্ধুর কবরকে ঘিরে সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। তখনকার রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৯৯ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধের নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ৩৮ দশমিক ৩০ একর জমির ওপর ১৭ কোটি ১১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ব্যয়ে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সহযোগিতায় এবং প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ সমাধিসৌধের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে।