প্রতিভা বসুর কাজের মূল্যায়ন এখনও হয়নি: দময়ন্তী বসু
অনলাইন ডেস্ক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৮:৪৭ পিএম, ১০ নভেম্বর ২০২৩ শুক্রবার
সাহিত্যিক প্রতিভা বসু।
প্রতিভা বসু; একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক, ছোটো গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। তিনি প্রখ্যাত লেখক বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী। তার সম্পর্কে বলেছেন তারই কন্যা দময়ন্তী বসু সিং। একটি বিদেশী পত্রিকায় দেওয়া এই বিশেষ সাক্ষাৎকারটি উইমেননিউজ২৪.কম-এর পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায়।
ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রতিভা বসু নজরুলের কাছে নজরুলগীতি, দিলীপ রায়ের কাছে দ্বিজেন্দ্রগীতি-অতুলপ্রসাদী এবং পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছেন, তিনি গান ছাড়লেন কেন?
দময়ন্তী বসু সিং: বাড়িতে সর্বদাই গান হত৷ আমার ছোটবেলায়, মা গাইছেন, আমি নাচছি, এ তো নিত্যকার ঘটনা৷ উনি ‘চাইল্ড প্রডিজি’ ছিলেন৷ তবে, ছোট থেকে গান খুব যে সচেতন ভাবে ভালোবেসে করতেন, তা হয়তো নয়৷ আমার দিদিমা-দাদু মেয়ের প্রতিভা বিকাশের জন্য অনেক কিছু করেছেন৷ তারা যদি মেয়ের গুণ যত্ন করে নার্চার না করতেন, তা হলে সে সময়ে তার প্রতিভা বিকশিত হত না৷ সে কালে রীতি বহির্ভূত ভাবে মেয়েকে ছোটবেলাতেই মুসলিম উস্তাদের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিখিয়েছেন৷ ক্রমশ ঢাকা এবং কলকাতায় রানু সোমের গান বিশেষ সমাদৃত হয়৷ এর মধ্যে চিত্তরঞ্জন দাশ, দিলীপ রায়, সত্যেন বসুর পরিবারও তার গানের প্রতিভার জন্য রানুকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন৷ আর নজরুলের গল্প তো সবাই জানেন৷ ঢাকায় মা-দের বাড়িতে বসে অনেক গান লিখেছিলেন৷ উনি গান লিখতেন, সুর করতেন এবং রানুকে শিখিয়ে বলতেন গানটা করতে৷ সেই গানের খাতা আমার কাছে এখনও রয়েছে৷ পরে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যও পেয়েছেন৷ এত সব সত্ত্বেও আমরা মায়ের রেকর্ড আমাদের বাড়িতে দেখিনি৷ হতে পারে, দেশভাগের সময়ে অনেক কিছুর সঙ্গে রেকর্ডগুলো হারিয়ে গিয়েছিল৷ উনি বলতেন, ‘আমার গান শোনার যোগ্য নয়৷ আজকালকার মেয়েরা কী সুন্দর গান করে…৷’ অনেকে মনে করেন, বুদ্ধদেব বসু চাইতেন না বলেই প্রতিভা বসু গান করলেন না৷ এ কথাও ভীষণ অসত্য৷ তবে, বুদ্ধদেব তো সে অর্থে গানের কনেসর (Connoisseur) নন, কথার কনেসর৷ যে ভাবে রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী তাকে ছুঁয়ে যেত, নজরুল বা দ্বিজেন্দ্রগীতি তাকে হয়তো সে ভাবে স্পর্শ করত না৷ আরও একটা কথা, বিয়ের পর প্রতিভা এবং বুদ্ধদেব বহুকাল পর্যন্ত দু’কামরার বাড়িতে থাকতেন৷ এক ঘরে লেখকের আড্ডা, পাশাপাশি অন্য ঘরে তানপুরা-তবলা নিয়ে গান হয়তো সম্ভবও হত না বলেই প্রতিভা মনে করেছেন৷ তা ছাড়া সন্তানদের মানুষ করা এবং সংসার তো পাশাপাশি চলেছে৷ তবে বুদ্ধদেব চাইতেন, তাদের কবি-সাহিত্যিকের আড্ডায় স্ত্রীও থাকুন৷ বিয়ের পরে একবার, হিমাংশু দত্তের গান রেকর্ড করেছিলেন যা, ‘প্রতিভা বসু’ নামে প্রকাশিত হয়, রানু সোম নয়৷ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিভা বসুর সম্ভাবনা বুদ্ধদেব টের পেয়েছিলেন এবং তার আরও বিকাশ চেয়েছিলেন৷ স্বাভাবিকভাবেই গান আর সামনে আসেনি৷
ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায়: ‘গায়িকা’ রানু সোম থেকে ‘সাহিত্যিক’ প্রতিভা বসু-এই রূপান্তর তো আপনার জন্মের সময়…৷
দময়ন্তী বসু সিং: কথাটা এক অর্থে ঠিক আবার এক অর্থে ঠিক নয়ও৷ কারণ, মা নিজে ছোট থেকে লিখতেন, পত্রিকায় লেখা পাঠাতেন৷ বেশিরভাগই কবিতা৷ বুদ্ধদেবের একটা লেখা নাট্যরূপ দিয়ে একবার ঢাকায় মঞ্চস্থও করেছিলেন৷ কিন্তু, বিয়ের পর যে আবহে এলেন, সেখানে কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা৷ এক সময় জ্যোতিকাকা (জ্যোতির্ময় রায়) মজা করে বললেন, ‘ছোট গল্পের প্রতিযোগিতা হচ্ছে, আপনিও লিখবেন নাকি?’ মা তখনি লিখতে বসে গেলেন৷ ‘মাধবীর জন্য’৷ তখন পুরস্কার পেয়েছিলেন, পরবর্তীকালে সিনেমাও হয়৷ প্রথম উপন্যাস ‘মনোলীনা’ (১৯৪৪) কবিতা ভবন থেকে প্রকাশিত হয়৷
আমার জন্মের পরবর্তী কালে অর্থাৎ চারের দশকে এসে সাহিত্যিক হিসেবে কলকাতায় মায়ের আত্মপ্রকাশ৷ উপন্যাসটির বিষয় এবং ভাষার আধুনিকতা লক্ষ করার মতো৷ বাবা বলতেন, ‘তোর মায়ের মতো সংলাপ বাংলা সাহিত্যে কেউ লিখতে পারে না৷’ সুধীন দত্তকেও এ কথা বলতে শুনেছি৷ কিন্তু, সেই ভাবে দেখতে গেলে তেমন পুরস্কার তো পাননি৷
এ-কথা ঠিক যে, পুরস্কার হয়তো সব নয়৷ তবে, একটা স্বীকৃতি তো বটেই৷ নারীরা মায়ের লেখার অন্ধ ভক্ত হলেও অনেকে বলতেন, পুরুষ সমাজের কাছে প্রতিভা বসু খুব গ্রহণযোগ্য নন৷ আমার মনে হয়, যখন প্রতিভা বসুর একের পর এক উপন্যাস এবং অন্য লেখা প্রকাশিত হচ্ছে, তারই সঙ্গে পরপর তাঁর কাহিনি চলচ্চিত্রায়িত হচ্ছে, তখন তার স্বীকৃতি অন্যভাবে পেলেন৷ সাগরময় ঘোষ, সন্তোষকুমার ঘোষ, গৌরকিশোর ঘোষ বা অম্লান দত্তের মতো ব্যক্তিত্ব তার লেখার অনুরাগী ছিলেন৷ একটা কথা কী জানো তো, ছোটগল্প আসলে খণ্ডকাব্য, তার শুরু এবং শেষটা খুব ক্রিটিক্যাল৷ প্রতিভা বসুর যে কোনও গল্পেই শুরু এবং শেষ ভীষণ অভিনব৷ উদাহরণ হিসেবে, ‘সুমিত্রার অপমৃত্যু’ ও ‘বিচিত্র হৃদয়’ গল্প দু’টো ধরা যাক৷ আজও পড়লে মনে হয় কত আধুনিক- প্রথম গল্পে হিন্দু-মুসলমানের প্রেম এবং দ্বিতীয় গল্পে দেখি মা এবং মেয়ে একই ব্যক্তির প্রেমে পড়ছে৷ এই রকম থিম তখন কোথায় ছিল? প্রতিভা বসু এই গল্প লিখছেন চারের দশকে৷ এই দশকের শেষে তাঁকে বাইরের জগৎ স্বীকৃতি দিল, যখন বসুমতী থেকে উপন্যাস লিখতে বলা হল৷ সেই উপন্যাস ‘মনের ময়ূর’৷ প্রকাশিত হল ‘নাভানা’ থেকে৷ সে সময় বুদ্ধদেব ‘কবিতা ভবন’ প্রকাশনা ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিলেন৷ মাকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটা তিনি তত দিনে সম্পন্ন করে ফেলেছেন৷
ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায়: ৮২ বছর বয়সে লিখলেন ‘মহাভারতের মহারণ্যে’৷ কিছু বিতর্ক হল৷ শোনা যায়, এই বই হয়ে ওঠার পিছনে আপনার নাকি অবদান ছিল?
দময়ন্তী বসু সিং: হ্যাঁ, ওই লেখার সঙ্গে আমি ভীষণ ভাবে জড়িত৷ শেষের দিকে মা ‘কমিশনড’ না হলে লিখতেন না৷ হয়তো তখন কল্পনার জগতে যেতে পারছেন না, বা নতুন কোনও আইডিয়া আসছে না৷ সেই সময়টায় প্রচুর পড়তেন৷ আমি তখন কানপুর আইআইটিতে৷ শিবনারায়ণ রায়ের ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকার ‘লাইফ মেম্বার’ ছিলাম৷ সেই পত্রিকার একটা সংখ্যায় দেখলাম মায়ের প্রবন্ধ, ‘নায়িকা সত্যবতী’৷ সেটা পড়ে আই ওয়াজ সো এক্সাইটেড অ্যান্ড সো মুভড! দেখলাম, প্রতিভা বসু ভীষণ নতুন কথা বলছেন৷ আমি কলকাতা এসে মাকে বললাম, তুমি অসাধারণ প্রবন্ধ লিখেছ৷ কিন্তু তোমার বক্তব্য এত অল্প কথায় বললে হবে না৷ ২০০০ টাকা মাকে দিয়ে বললাম এটা অগ্রিম, এই বইটি দিয়ে আমি প্রকাশনা শুরু করব৷ তখনও জানি না, আমি আদৌ কখনও কলকাতা ফিরতে পারব কি না, প্রকাশনা করা তো দূরস্থান৷ মা তো তখন হাসলেন, কিন্তু অচিরেই লিখতেও শুরু করলেন৷ বেশ কিছু মাস পর বললেন, ‘আমি তো অনেক পাতা লিখে ফেলেছি, তোকে এডিট করতে হবে৷’ এডিটিং শুরু করলাম৷ বইটা আমাকেই মা উত্সর্গ করেন৷ সত্যিই এই বই দিয়ে আমার প্রকাশনা সংস্থা ‘বিকল্প’ শুরু৷ বই নিয়ে অনেক বিতর্কও আছে৷ তেমনই আবার অম্লান দত্ত, সাগরময় ঘোষ, শিবনারায়ণের মতো মানুষেরা মুগ্ধও হয়েছেন৷
ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায়: তার লেখায় চরিত্র হিসেবে মেয়েরা অনেক বেশি শক্তিশালী৷ এই সব কাহিনি যখন তিনি লিখছেন, তখন এখানে ‘মানবীবিদ্যা চর্চা’ বলে কোনও শাখা আসেনি৷ প্রতিভা বসুকে নারীবাদী লেখক বলা চলে?
দময়ন্তী বসু সিং: এ কথা সত্যি যে, প্রতিভা বসু যে সময় লেখা শুরু করেছেন, তখন পড়াশোনার বিষয় হিসেবে আলাদা করে ‘ফেমিনিজম’ বা ‘উওমেন স্টাডিজ’ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সে ভাবে আসেনি৷ পরবর্তী কালে আমাদেরও মাকে ‘নারীবাদী’ বলেই মনে হয়েছে৷ মজা করে মাকে বলতাম, ‘তোমার মতো ফেমিনিস্ট খুব কম দেখা যায়!’ আসলে, জীবনটাও তো একটা আয়না৷ প্রতিভা বসুর লেখা পড়লে দেখা যায়, তিনি নারীদের সব সময় জিতিয়ে দিয়েছেন৷ তার মানে পুরুষকে তিনি হেয় করেননি৷ তাঁর মেয়ে চরিত্ররা উদ্ধত নয়৷ ‘ফেমিনিজম’ বা ‘নারীবাদ’ কথাটার মধ্যে যে ‘ঔদ্ধত্য’ রয়েছে, সেই বিষয়টা মায়ের লেখা বা স্বভাবের মধ্যে ছিল না৷ ঔদ্ধত্য বলতে আমি বোঝাতে চাইছি, এমন কথা- ‘আমি নারী, আমি জন্ম দিতে পারি৷ সুতরাং আমার আর কারওকে দরকার নেই… ইত্যাদি৷’ এ সব তিনি বিশ্বাসও করতেন না৷ ব্যক্তি জীবনে ছিলেন খুবই স্নেহশীল৷ সংসারের সব দায়িত্ব তার৷ সে গয়না বিক্রি করে আমাদের স্কুলে ভর্তি করা হোক বা দোকানের দেনা মেটানো৷ আমার মনে হয়, প্রতিভা বসুর প্রথম দিকের উপন্যাস, ছোটগল্প খুব উচ্চতারে বাঁধা৷ প্রতিভা বসু নারীবাদী কি না, তার থেকেও তাই আমার কাছে বড় কথা, তার গল্প বলার ক্ষমতা, ভাষার ব্যবহার, সংলাপ লেখার দক্ষতা এবং থিম্যাটিক ভ্যারিয়েশন৷ তাঁর গল্প-উপন্যাসে ‘মহিলা’ ব্যাপারটা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা বিষয়৷ আশপূর্ণা দেবীর পর প্রতিভা বসুর উত্থানটা ‘উত্থান’ হিসেবে দেখা উচিত ছিল৷ প্রতিভা বসুর প্রতি যে অবিচার হয়েছে, তা তো আর ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না৷ বুদ্ধদেবকে যে ভাবে বারবার আঘাত করা হয়েছে, তা এখন মনে পড়লে যেমন কষ্ট পাই, তেমন সাহিত্যের বৃহত্ পরিসর থেকে প্রতিভা বসুকে সরিয়ে রাখা হয়েছিল ভাবলেও খারাপ লাগে৷ মনে হয়, তাঁর অনেক বেশি প্রাপ্য ছিল৷ প্রতিভা বসুর কাজের বিচক্ষণ মূল্যায়ন এখনও হয়নি৷