আত্মহত্যা প্রবণতা এবং লেখক মনস্তত্ব
জাহানারা পারভীন
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৮:৪৮ এএম, ২৫ নভেম্বর ২০২৩ শনিবার
কবি জাহানারা পারভীন
সিলভিয়া প্লাথ পড়তে গিয়ে মনে পড়ে তার মনস্তাস্তিক সংকট, আত্মহত্যা প্রবণ মানসিকতার কথা। এরিয়েলের কবিতা, মাকে লেখা চিঠি, আত্মজৈবনিক উপন্যাস বেলজার পড়তে গিয়েও খুঁজেছি বিষন্নতার সূত্র। কেন তিনি মনের মতো একটা পদ্ধতি খুঁজতে চেয়েছেন বারবার? আত্মহত্যার? স্লিপিং পিল, ব্লেড, শেষ পর্যন্ত সাফল্য আসে গ্যাসের চুলায়। অথচ তখন বাড়িতে দুই শিশু সন্তান।
মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতার অসহায়ত্ব, বধূ ছিলো শিশুটিও ছিলো, তবু মরিবার হলো তার স্বাধ। এই মরবার স্বাধ নিয়েই জীবন কাটিয়েছেন সিলভিয়া। তার জীবন তাই বলে।
আত্মঘাতি লেখকদের পড়তে গিয়ে, তাদের জীবনীর সঙ্গে সংযোগ খুঁজেছি, কিছু একটা বোঝার ইচ্ছে, কোনও একটা সূত্র খোঁজার চেষ্টা। রিভলভারের গুলিতে আত্মহত্যা করা মায়কোভস্কি, হেমিংওয়ে, ওভারকোটে ভারী পাথর নিয়ে নদীতে ডুবে যাওয়া ভার্জিনিয়া উলফ, মানসিক বিষন্নতা থেকে আত্মহত্যা করা এডগার অ্যালান পো, গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করা কথাসাহিত্যিক ফোস্টার ওয়ালেস।
এই তালিকা অনেক দীর্ঘ। এই তালিকার আরেক নাম মুনীরা চৌধুরী। বাংলা ভাষার কবি। এই মৃত্যু আকস্মিক। দু:খজনক। কার্ডিফের সমুদ্র উপকূলে পাওয়া গেছে তাকে। মৃত। সমুদ্রের ধারে পাওয়া মৃতদেহ, রহস্যজনক মৃত্যুর অভিঘাত আমাদের মনে তৈরি করেছে নানা অভিঘাত। তিনি নিজেই মৃত্যু নিয়ে বলেছেন।
কষ্ট, একজন মৃত মুনিরা চৌধুরীর গোপন নাম! এই কষ্টই তার অবলম্বন। আশ্রয়। অথচ এই কষ্ট থেকে বাঁচতেই কি বেছে নিয়েছেন স্বেচ্ছামৃত্যু? প্রশ্ন ওঠে। কেন তার কবিতায় বারবার এসেছে মৃতু্র প্রসঙ্গ। পৃথিবীর আর সব আত্মঘাতি কবিদের মতো তিনিও কি মৃতু্র কথা ভেবেছেন বারবার? অথচ জীবনের সকল বিষাদ, অবসাদ, কষ্ট ভুলতে কবিতাতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। তুমুল বাঁচার মাঝে নিজের মৃতু্র নির্দেশনাও দিয়ে গেছেন। প্রিয় বন্ধুর সঙ্গেই মৃত্যু হবে তার। এরকম প্রস্থানের ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন বেঁচে থাকতেই। তাই তার মৃত্যু প্রস্তুতি নিয়ে বিস্মিত হওয়ার সুযোগ নেই।
পৃথিবীর কোথাও কি রোদ উঠেছে?
আমার মৃত শরীর শুকাতে দেব।
কেন যে বার বার মৃত্যুর কথা বলো?
হঠাৎ মরে গিয়ে আমায় দুঃখ দিয়ো না..
ঈশ্বর দুঃখ পাবেন
পৃথিবীর প্রাচীন কবরে যখন, দু’চোখের পাথর ছিদ্র করে গড়িয়ে পড়ে জল, আর কবি মুনিরা চৌধুরী জেনে যান বর্ষা এসেছে। বর্ষা তার কাছে বিষাদে সমার্থক। নিজে কষ্টের প্রতিনিধি।
তিনি দেখতে পান আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামছে, বৃষ্টির মধ্যে ঘুড়ি উড়ছে, আর চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছে তার প্রিয়জন। সেই প্রিয়জনকে তিনি তুমি বলে সম্বোধন করেছেন। তখন পৃথিবীর সব চায়ের পেয়ালা ভেঙ্গে যাচ্ছে, ভেঙ্গে যাচ্ছে। এরপরই কবির কল্পনাশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। কবি দেখেন, পৃথিবীতে নতুন এক পরিবর্তন। এখানেই তার কবিতার শক্তি। তার চিন্তার নতুনত্ব।
মুনিরা চৌধুরীর সঙ্গে আমার কখনও পরিচয় হয়নি। তার কথা জেনেছি তার মৃত্যুর পর। এ এক নতুন আবিস্কার। তার কবিতার আধুনিকতা, নতুন চিন্তা, ভাষা পড়ে মনেই হয়নি তার জন্ম লন্ডনে। বড় হয়েছেন সেখানে। জন্মসূত্রে ব্রিটিশ বাঙালি কবি মুনিরা। জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের বাইরে। বাংলাভাষাকে জানতে তিনি দীর্ঘ দিনের জন্যে বাংলাদেশে এসে থেকেছেন। শিখেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। বাংলা কবিতা ও গদ্য রচনার কলাকৌশল। লন্ডনে ফিরেও পড়ে থেকেছেন বাংলা ভাষা নিয়ে। লন্ডনের কার্ডিফে বাংলাভাষা,সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলা একাডেমি ইন্টারন্যাশনাল। অনেক পরে বাংলা শেখা এই কবির ভাষা, শব্দ ব্যবহার, পরিমিতিবোধে অদ্ভুত এক ঘোর। মনে শুধুই জন্ম নেয় মুগ্ধতা। তার নি:সঙ্গতার স্বরূপ পাওয়া যায় তার কবিতায়।
একদা জানতাম
কার্ডিফের ঐ একটা মাত্র ডানা-ভাঙ্গা কালো কবুতরই আত্নিয় আমার
আত্নিয়টি উড়ে গেছে দূরে, তারপর পুড়ে গেছে
তারপর থেকে
একা বসে আছি
এক শত বছর ধরে
কবি মুনীরা চৌধুরীর সঙ্গে কখনও পরিচয় না থাকার আফসোস কাটাতে তার কবিতার কাছে আসি। তার মনোজগৎ বোঝার চেষ্টা করি। আর বিস্মিত হই। আমাদের চারপাশের সাহিত্যের কোলাহলের বাইরে দূরদেশে থেকে কবিতার কি এক আশ্বর্য, বিস্ময়কর জগৎ তৈরি করে নিয়েছিলের তিনি। যে জগতে বাস করলে আর সব কিছু তুচ্ছ করা যায়। এমনকি চারপাশের সমাজ বাস্তবতা, ঘর সংসার সন্তানকেও পেছনে ফেলে নিজের সব বিষাদ, বিষন্নতা নিয়ে চলে যাওয় যায় রহস্যজনক এক জগতে। যেখানে জেগে থাকা যায় সারারাত। নিজের সব বেদনা নিয়ে। ঘুমের ঘোরেও যেখানে জেগে থাকা যায়।
আমি জেগে থাকি
কাটা হাতখানা অন্য হাতে নিয়ে সারারাত জাগি
অনন্ত ভোরের দিকে হাতের গহীনে জ্বলে ওঠে হাতের চিতা
হাড়-গলা গরম ঘন হয়ে এলে কেবল শীত শীত লাগে…ঘুম লাগে
এইসব মুনিরা ঘুমের ঘোরে কোথাও কোনো জানালা নেই; সই নয় দরজার বাতাস।
লেখক পরিচিতি:
জাহানারা পারভীন। কবি, অনুবাদক ও সাংবাদিক। জন্ম ৩০ মে ১৯৭৫, বাংলাদেশ।
পেশাগত জীবনে তিনি একজন সাংবাদিক। লেখাপড়া করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনে বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
প্রকাশিত বই: 'নোঙরের গল্প বাচাচ্ছি' (২০০২ কাব্যগ্রন্থ), 'নিদ্রা সমগ্র' (২০০৫ কাব্যগ্রন্থ), 'মা হাওয়ার সন্তান' (২০০৯ কাব্যগ্রন্থ), 'জলবৈঠক' (২০১০ কাব্যগ্রন্থ ), 'স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি' (কাব্যগ্রন্থ), 'রিলকে নৈঃশব্দে ও নি:সঙ্গতায় (প্রবন্ধ), 'এবং এলিয়ট' (প্রবন্ধ)।
তিনি কবিতার জন্য পেয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের 'কৃত্তিবাস পুরস্কার' ২০১১, জাতীয় কবিতা পরিষদের 'শামসুর রাহমান সম্মাননা' (২০০৭) 'শব্দগুচ্ছ পুরস্কার' (২০১২), ছোটকাগজ 'চৈত্রসংক্রান্তি সম্মাননা' (২০০৭)।