নারী আন্দোলনের সেই সম্মিলিত কণ্ঠ কোথায়?
লীনা পারভীন
উইমেননিউজ২৪.কম
প্রকাশিত : ১২:০৪ এএম, ১৯ জুলাই ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১১:১৬ পিএম, ৮ আগস্ট ২০১৮ বুধবার
বাঙালী নারীদের অধিকার নিয়ে প্রথম কারা লড়াই শুরু করেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে অবশ্যই আসবে বেগম রোকেয়া, নবাব ফয়জুন্নেসাসহ আরও দুয়েকজনের নাম। তারা শুরু করেছিলেন বলেই আজকে আমরা এগুতে পারছি। পরবর্তীতে নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য সংগঠিত আকারে প্রকাশ ঘটে কিছু নারী সংগঠনের, যারা মূলত সমাজে নারীদের বিষয়ে সচেতনতা জাগাতে কাজ করতো। পাশাপাশি ছিলো রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাও। নারীবিষয়ক যে কোনো ইস্যুতে আগেই মাঠে দেখা যেতো প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে। দলীয় এজেন্ডার একটি অন্যতম পার্ট ছিলো নারীর স্বাধীনতা অর্জনে তাদের সক্ষম করে গড়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরিতে কাজ করা।
ধীরে ধীরে আমাদের দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো হয়ে পড়লো মাইনর। তারা হারিয়ে ফেলছে তাদের সামাজিক ভিত্তিকেও। রাজনৈতিক ইস্যুতেই তাদের কোনো সাংগঠনিক প্রভাব খুব একটা দেখা যায় না। নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়ে ভূমিকা রাখা বা সরকারের সাথে বার্গেইনিং এজেন্ট হিসাবে কাজ করার জায়গাটিও আজকাল আর নেই বললেই চলে।
সারাবিশ্বেই নারী অধিকার, নারীবাদ ইত্যাদি বিষয়ে নানা ধরণের তত্ত্ব ও তথ্যগত পরিবর্তন এসেছে। সামনে আরও আসবে। কিন্তু সেসব ধারার সাথে আমাদের বাঙালী সমাজের নারীমুক্তির বিষয়টির মনে হয় একটু পার্থক্য আছে। এ পার্থক্য তৈরি হয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে। মূলত অর্থনৈতিক কাঠামোই নির্ধারণ করে দেয় কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র কার প্রতি কেমন আচরণ করবে। আমাদের দেশে এখনও পুঁজিবাদের ধারাই পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখানে আধা সামন্তীয় সমাজবাস্তবতা এখনও বিদ্যমান। তাই মানসিকতারও রয়েছে এক ব্যাপক পার্থক্য। পাশ্চাত্য কোন দেশের একজন নারীর বাস্তবতা বা তার সাথে ঘটে যাওয়া বৈষম্যের সাথে আমাদের দেশের নারীদের বৈষম্যের রয়েছে অনেক পার্থক্য। হয়তো মোটাদাগে বা সাদা চোখে দেখতে একরকম মনে হলেও প্রকৃতিগত দিক থেকে রয়েছে বিশাল পার্থক্য।
সেজন্যই কেবল অন্যদেশে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজেদেরও সেই লেভেলে ভাবাটাই বোকামি। বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ইতিহাস খুব পুরনো না হলেও ধরে নেয়া যায় বেশ অনেক বছর পার হয়েছে। আর বেগম রোকেয়াদের সময়কে হিসাব করলেতো সে কয়েকশো বছরের কথা। সে তুলনায় আমরা কতটা এগিয়েছি আর বর্তমানে কোন অবস্থানে আছি? এ চিত্রের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ কী কখনও আমরা যারা নারী অধিকার বাস্তবায়নের জন্য সোচ্চার তারা ভেবেছি? মনে হয় না। আমার ব্যক্তিগত হিসাব হচ্ছে আমরা বেগম রোকেয়ার আমল থেকে খুব বেশি আগাতে পারিনি। যেটুকু এগিয়েছি সেটুকু বিশ্ববাস্তবতায় হতেই হবে বলে হয়েছে বলেও চালিয়ে দেয়া যায়। আমাদের দেশ এখন গ্লোবালি কানেক্টেড। গোটা বিশ্বের সাথে যুক্ত থাকার শপথ নিয়ে এগুচ্ছি আমরা। আর সেখানে রয়েছে নারীর উন্নয়ন নামক একটি শপথও।
একবার ধরে নেয়া যাক, আমাদের এই বাংলাদেশ জাতিসংঘের কোনো প্রকার চুক্তির সাথে আবদ্ধ নয়। এমডিজি, এসডিজি বা সিডও নামক কোন কিছুতেই তারা সই করেনি। তাহলে বাস্তবতা কল্পনা করা যায়? এ কথা অস্বীকার কে করবে যে, প্রশাসনিক সহায়তা বা কোনো রাষ্ট্র যদি নিজে মনে না করে কোথাও কাজ করার আছে তাহলে সাধারণ জনগণের কী ক্ষমতা আছে সে বিষয়ে নীতিমালা তৈরির জন্য কাজ করা? হ্যাঁ, জনগণ চাপ তৈরি করতে পারে, আন্দোলন-সংগ্রাম করতে পারে, কিন্তু আমাদের দেশে নারী ইস্যুতে কবে এত বড় আন্দোলন হয়েছে যেখানে সরকার বাধ্য হয়েছিলো নীতিমালা বানাতে? খুব একটা ইতিহাস নেই। বিষয়টা বরাবরি এমন ছিলো যে বৈশ্বিক কোনো একটা বিষয় সামনে এসেছে আর আমাদের দেশের যারা নারী ইস্যুতে কাজ করেছেন তারা সে বিষয়টাকে হাইলাইট করে সরকারের সাথে বার্গেইন করেছেন। রাস্তায় নেমেছে বা আলোচনার টেবিলে বসেছে। কিন্তু হোমগ্রোওন কোন আন্দোলন মনে হয় না বেগম রোকেয়ার পরে আর কেউ করতে পেরেছে, যা একেবারে সমাজের তৃনমূল পর্যন্ত আমূল পরিবর্তন এনেছে। সামাজিক সচেতনতার জায়গায় আঘাত হেনেছে। অনেকেই আমার সাথে দ্বি-মত পোষণ করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এখনও নারীর সম্পত্তিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কণ্ঠের সংখ্যা একেবারে মাইক্রোস্কপিক।
প্রপগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো নারী মুক্তিকে সমাজমুক্তির অংশ হিসাবে গণ্য করেছে। আর তাই তাদের ফোকাস ছিলো গোটা সমাজে কবে বৈপ্লবিল পরিবর্তন আসবে সেদিকে। বিচ্ছিন্নভাবে যেসব সামাজিক নারী সংগঠনগুলো কাজ করেছে তারা সবাই বিষয়ভিত্তিক কাজ করেছে। সেখানে ফান্ড থেকে শুরু করে ছিলো অনেক হিসাব। বেসরকারী সংস্থাগুলোতো পুরোটাই ফান্ডভিত্তিক কাজ করেছে বা করছে। ডোনারদের তালিকা অনুযায়ী চলতো তাদের কাজের তালিকা। তাই সেখানে নারীদের নিয়ে যা কাজ হয়েছে সেটা কেবলি এজেন্ডা বাস্তবায়নভিত্তিক। তারপরও সেগুলো কিছুটা হলেও ভূমিকা রেখেছিলো। কিন্তু বর্তমানে তাদের ফান্ডও পাল্টেছে, এজেন্ডাও পাল্টেছে। প্রকৃত নারীমুক্তির জন্য কাজ করছে এমন কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
এমন বাস্তবতায় নারীদের সমস্যা কী থেমে আছে? না, আরও দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে। বলতে গেলে ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। নারীরা সংখ্যায় এগুচ্ছে কিন্তু গুণগত দিকে পিছিয়ে পড়ছে। আমাদের নারীরা এখন অধিকার সম্পর্কে সচেতন সেটা বলা যায়। কিন্তু সে তুলনায় তাদের জন্য কাজ করার জায়গাটি হারিয়ে গেছে। নারীরা বেরিয়ে আসছে প্রচুর কিন্তু ধরে রাখার মত জায়গাটি তলিয়ে যাচ্ছে। এই সাংঘর্ষিক একটি বাস্তবতায় সামনের দিনে নারীদের জন্য আরও ভয়াবহ সময় অপেক্ষা করছে। একদিকে সমাজে মৌলবাদী ধ্যানধারণার বীজ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে অন্যদিকে নারীরা আর ঘরে আটকে থাকতে চাইছে না। তারাও সমাজে ভূমিকা রাখতে চাইছে।
আমাদের সরকার বা রাষ্ট্র যতটুকু উন্নয়ন করেছে তার পুরোটাই এজেন্ডার অংশ হিসাবে। কিন্তু কাঠামোগত যে উন্নয়ন বা সমাজে বিদ্যমান নারীবান্ধব মগজ তৈরিতে যে ভূমিকা রাখার কথা বা কাজ করার প্রয়োজনীয়তা সেটির কিছুই হয়নি। বরং আরও উল্টোকিছু হচ্ছে।
অন্যদিকে আমাদের শহুরে নারীদের একটি অংশ চাইছে কিছু একটা করতে, কিন্তু থেকে যাচ্ছে বিচ্ছিন্ন। তাদের মধ্যে যতটা না নারীদের অধিকার কেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার আকাঙ্খা তার চেয়েও ব্যক্তিগত অবস্থানকে পাকাপোক্ত করার দিকে মনযোগ বেশি। নারীবাদ বা নারীমুক্তি এখন অনেকের জন্য অনেকটাই ফ্যাশনের অংশ। শো-অফের অংশ। এমন নারী যেমন আছেন, আছেন কিছু পুরুষও। তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তুলে সারা দেশে নারীদের নিয়ে ব্যাপক কিছু করার তাগিদ কম।
ভার্চুয়াল নারীবাদীরা এখন লীড করতে চাইছে নারী ইস্যুকে। বুঝে বা না বুঝে হোক তারা যেকোন কিছুতেই এখন অতিরিক্ত মাত্রার রিয়েকশনারী হয়ে যাচ্ছে। এর একটাই কারণ, তারা কেউই সামগ্রিক চিন্তার মানুষ নয়। সামগ্রিকভাবে কেউ আগাতে চাইলে তাকে আগে একটি সামাজিক ভিত্তি তৈরি করতে হবে। সে কষ্টের কাজটি করতে গেলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। এ জায়গাটিতে ক’জন আছেন, এটি একটি প্রশ্নই বটে।
এই যে সমাজে ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে এগুলো কী নতুন? বিষয়গুলো নতুন না হলেও মাত্রাগত দিক থেকে নতুন। এর পিছনের সাইকোলজিটা খুঁজতে গেলে দেখা যাবে সমাজে নারীদের এগিয়ে আসার জায়গাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই এই ভীতির জায়গাটি তৈরি করা হচ্ছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা যত বাইরে বেরিয়ে আসবে, যত মানসিকভাবে শক্তি অর্জন করবে ততই তার জন্য নড়বড়ে অবস্থা তৈরি হবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম শক্তি হচ্ছে নারীকে দূর্বল করে দেয়া, তাদের মানসিক শক্তিকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়া। আর এটা করতে পারলেই চারদিকে নারীরা কোণঠাসা হয়ে পড়বে। ভার্চুয়াল জগতে নারীদের প্রতি যেসব ধর্ষণকামী মানুষের আক্রমণ বা যেসব ভাষায় নারীদের আক্রমন করা হয় এর সবই সেই কৌশলের অংশ। কিন্তু অন্যদিকে আমরা নারীরা কতটা শক্তি নিয়ে এগুতে পারছি এর বিরুদ্ধে? আমাদের মধ্যে রয়েছে হাজারো বিভক্তি। রয়েছে ব্যক্তিগত বিভেদ আর হিংসার মানসিকতা। কেউ নিজেকে একজন অতিমাত্রার জ্ঞানী হিসাবে জাহির করতে চাইছে। আবার কেউ নিজেকে একজন মহাবিপ্লবী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। আবার কেউবা এসবের ধার না ধেরে নিজের মত করেই চুপচাপ থেকে যাচ্ছে।
এই বিভক্তির সুযোগ নিচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধিরা। দিনশেষে নারীমুক্তি থেকে যাচ্ছে বইয়ের আলোচনায়, নারীর কষ্টের সীমানায়, যেখানে কেবলি আফসোসের হাওয়ার আসা-যাওয়া। প্রশ্নটা আবারও করতে চাই, নারীদের নিয়ে সত্যিকার অর্থে কথা বলার, লড়াই করবার সেই শক্তিটি কোথায়?
লীনা পারভীন : কলাম লেখক।