অন্যতমা নূরজাহান বেগম
শামীম আজাদ
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১১:২৬ পিএম, ২৩ মে ২০২৪ বৃহস্পতিবার
কবি শামীম আজাদ।
কতই বা বয়স আমার ১৪ বা ১৫ হবে।জামালপুর গার্লস স্কুলে পড়ছি। আমার লেখালেখির শুরু তখনই। আব্বা (মাহমুদ তরফদার) মুকুলের মহফিল ও কচি কাঁচার মেলার জন্য লিখিয়ে পড়ে এডিট করে আবার লিখিয়ে তারপর খামে ভরে ডাকে আমার সে লেখা পাঠিয়ে দিতেন। লেখা ছাপা না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা ফুরাতো না। সে তিনি বুজান, শিরিন তরফদার ও শামীম তরফদার উভয়ের জন্যই করতেন। মারীতে অল পাকিস্তান গার্লস গাইডের ক্যাম্পিং করে মাত্র তিনখানা ছবি নিয়ে ফিরলাম। আব্বা তিন পর্বের "মারীর ডায়েরী" লিখিয়ে ঐ তিনখানা ছবি সহ পাঠিয়ে দিলেন। দৈনিক আজাদের মুকুলের মহফিলে। তিন সপ্তাহ ধরে তা ছাপা হল। আর আমি যে আমার ছবিগুলো যে ফিরে পেলাম তাতেই মহা খুশি হয়ে গেলাম।
একদিন দেখি মুকুলের মহফিলে নিয়মিত লেখকদের ছবির সঙ্গে আমাদের দুবোন শিরিন তরফদার ও শামীম তরফদারের ও ছবি। আমার গোলাপ ফুল জামা পরা শ্রেষ্ঠ ছবিটিই আব্বা পাঠিয়েছেন। তিনি যেন আমাদের দপ্তর সম্পাদক। সব ছোটদের পাতার ঠিকানা তার কাছে। কোন কাগজে কি লিখবো তারও খবরদারি করেন। ছাপা হলে বসবার ঘরে চা খেতে খেতে আম্মা আব্বা উচ্চস্বরে হাঁক দেন শামীম নতুন লেখাটা নিয়ে আসো। আমি যাই এবং দাঁড়িয়ে সেটা পড়ে শোনাই। বিড়ম্বিত বোধ করি না বরং খুশিই হই। ওঁদের বন্ধুরা এলেও পড়ে শোনাই।
এসএসসি পাশ করার আগে থেকেই আব্বা আমার রাজনীতি সচেতনতা নিয়ে ভয়ে ছিলেন। আইয়ূবসাহীর সরকারী রক্ত চক্ষু তার তার কারন। ব্যস্ত হয়ে ভাবতে লাগলেন এমন কোথায় উচ্চমাধ্যমিক পড়ানো যায়, যেখানে আমার পায়ে বাঁধা পড়বে কৃষ্টির নুপুর। কারন আমার এ এনার্জী কোথাও না কোথাও তো রাখতে হবে!
তখন শহীদ দানবীর রনদা প্রসাদ সাহার কুমুদিনী কলেজের কাচ গাঁথা সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা নিরাপত্তা, ভেতরে শাপলা ফোটা পুকুর, জলপাই গাছ ঘেরা টিনশেড হোস্টেল। বাঁশের দেয়াল ও এক ঘরে আট বা ছজন শিক্ষার্থীর ব্যবস্থা তার পছন্দ হল।আর আমি সেখানে প্রবেশের পরই ভাবলাম এবার লেখা যাক দু একটি প্রেমের গল্প। আব্বা জানতেই পারবেন না আমি কোথায় কি পাঠাচ্ছি! বড় হবার মজাই আলাদা!
প্রথমেই মনে হল সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার কথা। সেখানে সুফিয়া কামাল থেকে কত কত নারী যে লেখেন! ঈদ সংখ্যায় কতজনের ছবি ওঠে! আম্মাকে দেখেছি নিয়মিত সংখ্যা থেকে সেলাইর ডিজাইন কার্বণ কপি করে আমার হলুদ জামার বুকে লেইজি ডেইজী প্যাটার্ণ তুলে নিতে। রান্না দেখে একবার আম্মা কি অসাধারণ একটা মোরব্বা করলেন। গোলাপি স্পঞ্জের মত টুকরা। ঘন সরপরা দুধের ক্ষিরে চুবানো। মুখে দিলেই দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে মিষ্টির রস অনাআয়াসে চলে আসে যথাতথা! আমরা কেউই চিনলাম না কি খাচ্ছি। আম্মা রান্না ঘর থেকে তার রাঙা কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, জানতাম তোমরা কেউ বুঝতে পারবে না। এ হচ্ছে জাম্বুরার খোসার মিষ্টি। আমি "বেগম" থেকে পেয়েছি! সেই বেগম! এরই সম্পাদক নূরজাহান বেগম। ছবি দেখেছি। কী অপরূপ সুন্দরী তিনি।
আমাদের বাসায় কখনো ইত্তেফাক কখনো আজাদ রাখা হত কিন্তু বেগম ছিল নিয়মিত। এবং তা আম্মার জন্য।ছোটদের বিভাগে লিখে লিখে তখন আমার খালি প্রেমের গল্প লিখতে ইচ্ছা হত। মনে হত কবে বড় হব! এদিকে আব্বা জানেনই না আমি ক্লাস সেভেনেই লুকিয়ে কপাল কুন্ডলা পড়ে ফেলেছি। পাবলিক লাইব্রেরি থেকে মন্টি আর আমি মাসিমা ও আম্মার জন্য বই আনতে গেলে নদীর পাড়ে আগে আমরাই পড়ে নিচ্ছি এক চ্যাপ্টার মেমসাহেব, নটি। কপালকুন্ডলা পড়ে তার মত হবার জন্য আম্মাকে আর চুল কাটতেই দিতে চাই না। কড়ি দিয়ে কিনলাম লেপের ভেতরে লুকিয়ে শেষ করে তখন সঞ্চয়িতা পড়ে রবীন্দ্রনাথ নকল করছি দিনরাত। ভাবা যায়!
স্কুল শেষ করে কুমিদিনীতেই আব্বার ভাষায় 'এ্যারেস্টেড' হয়েই পেলাম মুক্তি। স্বাধীনতা! আহ , সেখানে রাতে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনে শুনে লিখলাম ‘এক পশলা বৃষ্টি’র মত ক্লিশে নামেই আমার প্রথম প্রেমের গল্প। সাধারণ সংখ্যায় তা যেদিন ছাপা হল সেদিন জলপাই গাছের নিচে কমন রুমের সামনে আমাকে ঘিরে ধরলো সবাই। আর আমার কি ভাব! মাই গড, বিখ্যাত শিল্পী হাশেম খান এর ইলাশট্রেশন। সোজা কথা!
এদিকে জামালপুর থেকে আব্বার বদলী হয়ে গেল। পুরো পরিবার চলে গেল নারানগঞ্জে। তখন কায়দে আজম রোডের বালুর মাঠের উল্টোদিকে তারা থাকেন। দারোগা চাচার গাড়ি না হলে কলেজ ছুটিতে আড়াইশ মাইল বাসে করে যেতাম আসতাম কলেজে। "এক পশলা বৃষ্টি"ছাপা হবার পর প্রথম ছুটিতে যেবার নারায়নগঞ্জে গেলাম আমি সারাদিন পদ্মফুলের ব্যল্কনিতে দাঁড়িয়ে জুলিয়েটের মত আমার রোমিওদের জন্য অপেক্ষা করি। এদিকে ড্রইং রুমে আব্বার বন্ধুরা করেন চায়ের অপেক্ষা। তাদের সালাম জানিয়ে ভেতরে গিয়ে আগের মত চা ও পেঁয়াজু রেডি করে আমি চিনি দিয়ে দিয়ে চা নাড়তে থাকলাম। সব কথা শোনা যায়। হঠাৎ শুনি আব্বা অনেক গর্ব ভরে তার বন্ধুকে বলছেন, 'আমার ফুরি (কন্যা) অখন বড় অই গেছে। বেগমো লেখে... ‘। বিখ্যাত বেগম পত্রিকায় লেখা ছাপা হওয়া যে তাঁর মেয়েকে লেখকের সম্মান দিয়েছে তাতেই তাঁর গর্ব।
বেগমের কোন ঈদ সংখ্যায় না লিখেও বড়দের জন্য লিখতে শুরু করেছি আপার পরিচর্যায়। কাগজে কাগজে। ডাক যোগাযোগের মাধ্যমে। অনেকটা চিঠিতে প্রেম করার মত। প্রেমে পড়ার মত। লেখালেখির জগতে কিশোরী সত্ত্বার খোসা ছাড়িয়ে এ ছিল যুবতীর প্রথম পাখা মেলা।তিনিই ছিলেন তার প্রথম সম্পাদক।এদিকে আবার কচিকাঁচার সম্পাদক দাদা ভাইর স্ত্রী ছিলেন আমাদের নূরজাহান আপা। আমাদের অন্যতমা।
৮ জুন ১৯২৫ সালে তাঁর জন্ম হয়েছিল আর আজ ২৩ মে নূরজাহান আপার প্রয়ান দিবস। অশেষ শ্রদ্ধায় আপার চরণতলে ফুল দিয়ে যাই।
লেখক পরিচিতি: লন্ডন প্রবাসী লেখক।