নীলফামারী: গ্রামীণ নারীদের পরিকল্পিত শাক-সবজির বাগান
নিজস্ব প্রতিবেদক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১২:২১ পিএম, ৫ জুন ২০২৪ বুধবার
সংগৃহীত ছবি
নীলফামারী জেলার সদর উপজেলার খোকসাবাড়ি ইউনিয়নের মাঝারডাঙ্গা গ্রামের গৃহিনী জাহানারা পারভীন (৫২)। সচেতন পরিবারে পুষ্টি সমৃদ্ধ বৈচিত্রময় খাবার তৈরিতে। তিনি জানেন সুস্থ থাকতে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা। তাই পরিবারের পুষ্টির চাহিদা যোগানে নিজের শ্রমে গড়ে তুলেছেন বিষমুক্ত শাক-সবজির পরিকল্পিত বাগান।
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন শরীরের জন্য যে পরিমান খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন, সে হিসেবে খাবার তৈরী করি। পরিবারের সকলকে সুস্থ রাখতে নিয়ম করে পুষ্টিকর খাবার তৈরি করছি। এসবের যোগান দিচ্ছি নিজের সবজির বাগান থেকে’।
জাহারারা পারভীন জানান, আগে সচেতন ছিলেন না খাদ্যমানের বিষয়ে। এতে করে যেমন হয়েছে অপচয়, তেমনি পুষ্টির অভাবে রোগবালাই লেগে থাকতো পরিবারের সদস্যদের। সচেতন হয়ে বদলে ফেলেছেন খাদ্যের নিয়ম। নিখাদ পুষ্টির যোগানে নিজেই গড়ে তুলেছেন রাসায়নিক এবং বিষমুক্ত শাক- সবজি বাগান। ওই বাগানের যোগানে মেটাতে সক্ষম হচ্ছেন পরিবারের চাহিদা। পাশপাশি বাড়িতে পালন করছেন হাঁস-মুরগি। হাঁস-মুরগির ডিম এবং মাংসে মেটাতে পারছেন পরিবারের আমিষের ঘাটতি। নিজেদের চাহিদা মেটানোর পর শাক-সবজি ও ডিম বিক্রি করে হচ্ছেন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান। পুষ্টির চাহিদা পূরণে রোগবালাই কমেছে পরিবারের সদস্যদের। এখন পরিবারের আট সদস্যই সু-স্বাস্ব্য নিয়ে কাজ করছেন যে যার কর্মস্থলে।
শুধু জাহানারা পাভীনই নয়, একই গ্রামে বৈচিত্র্যময় খাবার তৈরীর সক্ষমতা অর্জন করেছেন অন্তত তিনশত নারী। তারা সকলে পরিবারে পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার যোগানে রাখছেন ভূমিকা। পরিবারের পুষ্টির যোগানে ছোট আকারে সকলে গড়ে তুলেছেন সবজির বাগান। আমিষের চাহিদা মেটাতে বাড়িতে পালন করছেন হাঁস-মুরগি।
তাদের মধ্যে মর্জিনা খানম শিউলি (৪২) অন্যতম। তিনি তার বসত ভিটার সঙ্গে বিষমুক্ত শাক-সবজি চাষে সাড়া ফেলেছেন এলাকায়। হাঁস-মুরগি পালনের পাশপাশি ছোট আকারে একটি পুকুরে করছেন পরিকল্পিতভাবে মাছ চাষ। এতে করে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছেন গ্রামীণ ওই নারী।
মর্জিনা খানম জানান, পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তুলতে গ্রামীণ মায়েদের সচেতন করতে কাজ করেছে জয়েন্ট অ্যাকশন ফর নিউট্রিশন আউটকাম (জানো) প্রকল্প। এ প্রকল্পের মাধ্যমে পরিবারের পুষ্টি যোগানে পরিকল্পিতভাবে বিষমুক্ত শাক-সবজি চাষ ও আমিষের চাহিদা মেটাতে হাঁস-মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। ধারণা প্রদান করা হয় পুষ্টি সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যময় খাবার তৈরির। ওই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন হন গ্রামীণ নারীরা। এখন তারা সকলে পুষ্টির যোগানসহ ভূমিকা রাখছেন পরিবারে বৈচিত্র্যময় খাবার তৈরীতে। আবার অনেকে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদিত শাক-সবজি বিক্রি করে অর্থের যোগান দিচ্ছেন পরিবারে। বিক্রি করে স্বচ্ছলতা এনেছেন পরিবারের। একই কথা জানান খোকসাবাড়ি ইউনিয়নের ব্রাক্ষ্মণপাড়া গ্রামের শিরিন বেগমসহ আরো অনেকে।
মর্জিনা খানম বলেন, ‘প্রশিক্ষণ নিয়ে আমি এখন স্বাবলম্বী। সবজির বাগান করে পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করছি। হাঁস-মুরগী পালন করে পূরণ করছি আমিষের ঘাটতি। বাড়ির ভিটার বিভিন্ন খালি জায়গায় কলা, সুপারি, আম, লিচুসহ বিভিন্ন ফলের গাছ লাগিয়েছি। ছোট্ট একটা পুকুরে মাছ চাষ করছি। ওই পুকুর পাড়েও সবজি এবং বস্তায় করে আদা লাগিয়েছি। এসব করে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে কিছু অংশ বাজারে বিক্রি করে ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ যোগান দিচ্ছি। এতে আমার স্বামীর ওপর চাপ কমেছে। এখন আমরা আগের চেয়ে অনেকটাই স্বচ্ছল। আমাকে দেখে এলাকার অনেকে আগ্রহী হয়ে তারাও এ কাজ শুরু করেছে। এখন গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে আমার ন্যায় শাক-সবজি বাগান করছে। তারা সকলে খাদ্য ও পুষ্টি নিয়ে সচেতন হয়ে পরিবারে বৈচিত্র্যময় খাবার যোগানে পারদর্শী এখন’।
সরেজমিনে ওই গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন বাড়ির নিদিষ্ট একটি স্থানে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে শাক-সবজির বাগান। এসব বাগনে লালশাক, পুঁইশাক, টমেটো, পালংশাক, মিষ্টি কুমড়া, পেঁপে, কলমি শাক, ঢেঁড়স, বরবটি, সজিনা, মরিচ, শসা, ধুন্দুল, ঝিংগা, করলা, পটল, কায়তাসহ হরেক রকম উচ্চ পুষ্টিমান সমৃদ্ধ শাক-সবজির আবাদ। এসব বাড়ির আশপাশের বিভিন্ন খালি জায়গায় লাগানো হয়েছে কাঁচা কলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির কলা, আম, লিচুসহ বিভিন্ন ফলের গাছ। প্রত্যেক বাড়িতে পাওয়া গেছে এক থেকে একাধিক লেবু গাছ। স্বল্প পরিসরে হলেও বস্তায় আদা চাষের বৈচিত্র্যতা দেখা গেছে। শুধু তাই নয় বাগানের সবজি দিয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার তৈরি করা হচ্ছে প্রতিটি পরিবারে। এতে বিশেষত গর্ভবতী ও প্রসূতি, শিশু, কিশোর-কিশোরী, প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষসহ পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের।
খোকসাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রশান্ত কুমার রায় বলেন,‘গ্রামের সকলে রাসায়নিক সার ও বিষমুক্ত শাক-সবজির বাগান করে পরিবারের চাহিদা পূরণ করছেন। বিভিন্ন পাড়ায় পরিকল্পিত এসব বাগান দেখে আমার খুই ভালো লেগেছে। তারা নিজেদের চাহিদা পূরণের পর বাজারে বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। পাশপাশি এসব কর্মকান্ড এলাকার মানুষকে স্বাস্থ্য সচেতন করছে। এতে করে শাক-সবজির চাহিদা দিনে দিনে বাড়ছে’।
এবিষয়ে জানো প্রকল্পের ফুড বেস নিউট্রেশনের কনসালট্যান্ট মো. শফিকুল ইসলঅম জানান, গর্ভবতী ও প্রসূতি মা, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের পুষ্টি উন্নয়নে কাজ করে আসছে প্রকল্পটি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় এবং অস্ট্রিয়ান ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশনেরসহ আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত এবং কেয়ার বাংলাদেশ, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও ইএসডিওর সমন্বয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। নীলফামারী সদর, জলঢাকা, ডোমার ও কিশোরগঞ্জ উপজেলার ৪৪টি ইউনিয়নে এবং রংপুরের তারাগঞ্জ, গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়ার ২০টি ইউনিয়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২০১৮ সালে প্রকল্পটির শুরুতে কর্ম এলাকায় একটি বেজলাইন সার্ভে করা হয়। এসময় ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের বৈচিত্রময় খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস পাওয়া যায় ৩৪ দশমিক ৯ ভাগ। সেখান থেকে প্রকল্পটির মাধ্যমে ৪৬ দশমিক ৯ ভাগে উন্নীতের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ শুরু করা হলেও গত পাঁচ বছরে অর্জিত হয়েছে ৫১ দশমিক ২ ভাগে।
তিনি জানান, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুষ্টিকর খাদ্যাভাস গড়ে তোলা এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। প্রকল্প শুরুর আগে সবজির পুষ্টিমান বিবেচনা করে ১১টি উচ্চ পুষ্টিসমৃদ্ধ সবজি বাচাই করা হয়। পাশাপাশি খাবারে যাতে বৈচিত্র্য আনা যায় এজন্য কমিউনিটিতে রন্ধন প্রদর্শনীকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।