রাজধানীতে রাতভর ডাকাত আতঙ্ক, আটক ২৯
নিজস্ব প্রতিবেদক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১২:১৮ পিএম, ৮ আগস্ট ২০২৪ বৃহস্পতিবার
সংগৃহীত ছবি
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত সোমবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর থেকে দেশে শুরু হয়েছে নৈরাজ্য, লুটপাট আর ডাকাতি। হামলা হতে পারে এ ভয়ে পুলিশ সদস্যরা থানায় তালা মেরে পালিয়ে থাকায় দুর্বৃত্ত এবং ডাকাতরা যে যার মতো বাসা-বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে
হামলা করছে। সাথে লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। রাত গভীর হলে আতঙ্ক বাড়ছে রাজধানীবাসীর মাঝে। ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে রাত হলে ডাকাতির খবর পাওয়া যাচ্ছে।
বুধবার (০৭ আগস্ট) রাত ১২টার পর থেকে রাত তিনটা পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে।
রাতভর খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আরশিনগর, আটিবাজার, নয়াবাজার, বসিলা, বসিলা মেট্রো হাউজিং, মোহাম্মদপুরের কাদিরাবাদ হাউজিং, শেখেরটেক, জিগাতলা, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ এলাকা, শনিরআখড়া, মিরপুরের পল্লবী, মিরপুর ১০, ইসিবি চত্বর এলাকা, উত্তরার ৮-৯, ১০-১১ নম্বর সেক্টর, গাজীপুর ও টঙ্গী কলেজ রোড এলাকায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং রাজশাহী মিলে প্রায় ২৯ জনকে আটক করা হয়েছে খবর জানা গেছে।
মিরপুর পল্লবী এলাকায় ডাকাতি করতে গিয়ে আটক হয়েছেন ১৭ জন।
আটকদের মধ্যে বসিলা এলাকা থেকে চারজন এবং মিরপুর থেকে ১৭ জনকে এলাকাবাসী আটক করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে ডাকাতদের এলোপাতাড়ি অস্ত্রের আঘাতে মিরপুরের ইসিবি চত্বর এলাকায় দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু তাদের নাম-পরিচয় এখনো জানা যায়নি। এছাড়া মোহাম্মদপুর এলাকায় পাঁচজনকে অস্ত্রসহ আটক করে এলাকাবাসী। পরে তাদেরকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এছাড়াও উত্তরা এলাকায় কয়েকজন আটক করেছে এলাকাবাসী।
সুমি নামে একজন জানান, বসিলা মেট্রো হাউজিং, সিটি হাউজিংয়ে ডাকাত ঢুকেছিল। এসময় তারস মেট্রোর কয়েকটা বাসা থেকে অস্ত্র ধরে নগদ টাকা ও স্বর্ণ নিয়ে যায়। এরপর সেনা সদস্যরা চলে আসায় আবার সিটি হাউজিং এ ঢুকে পড়ে। তবে সিটি হাউজিংয়ের কারো বাসায় ঢুকতে পারেনি। এর আগেই দুই জনকে ধরতে পারেন এলাকার লোকজন। বাকিরা পালিয়েছে। এলাকাবাসী সবাই নিজ নিজ বাড়ি পাহারা দিচ্ছে।
এছাড়া ঢাকার বাহিরে আর ওয়ান ফাইভ বাইক নিয়ে ডাকাতি করতে এসে জনতার হাতে আটক হয়েছেন এক যুবক। বৃহস্পতিবার রাতে রাজশাহী জেলার নওহাটা বাজারে এ ঘটনা ঘটে। পরে তাকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয় লোকজন। এছাড়াও গাজীপুর ও টঙ্গী এবং সাভার এলাকায় ডাকাতির খবর পাওয়া গেছে।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এলাকার লাল খায় এলাকায় ডাকাতি করতে গিয়ে চার যুবক এলাকাবাসীর হাতে আটক হয়েছেন। পরে তাদেরকে উত্তম মাধ্যম দেন এলাকাবাসী। কিন্তু বাকিরা পালিয়ে যায়।
ভুক্তভোগী এলাকার অধিকাংশ মানুষ জানিয়েছেন, যারা ডাকাতি করতে এসেছিল বেশিরভাগ টোকাই এবং উঠতি তরুণ।
স্থানীয়রা জানান, এলাকায় ডাকাতি হচ্ছে খবর পেয়ে মসজিদের মাইকে সতর্ক করা হয়। পরে লোকজন লাঠিসোটা ও যার যা অস্ত্র ছিল তা নিয়েই রাস্তায় বেরিয়ে আসেন এবং তাদের ধাওয়া করেন। বিভিন্ন জায়গায় ডাকাত সদস্যরা আটকও হয়েছেন। তবে এই অবস্থা কতদিন ধরে চলবে তারা তা জানেন না। তবে কেউ কেউ ডাকাতির প্রমাণস্বরূপ এলাকায় ডাকাতদের ধাওয়া দেওয়া ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুধবার রাত নয়টার দিকে মিরপুরের ইসিবি চত্বরের একটি টাওয়ারে ঢুকে শতাধিক যুবক। তাদের হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল। এসময় তারা ৭০টি ভবনে ঢুকে পড়ে ও ভবনগুলোর বাসিন্দাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ডাকাতি শুরু করে। খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে তারা এলাকার সব গেট বন্ধ করে দেন। এরপর ধাওয়া দিয়ে তাদের ধরে ফেলেন। এ সময় গণপিটুনিতে একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে তার নাম পরিচয় কেউ জানাতে পারেনি। পরে এলাকাবাসী দুজনকে আটক করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেন। তার আগে এলাকাবাসী বেধড়ক গণপিটুনি দেয় তাদের। এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে আনে সেনাবাহিনী।
আরও জানা গেছে, তার আগে সেনাবাহিনীর কয়েক প্লাটুন সদস্য এসে ভবনগুলো ঘেরাও পারে। তারা ভবন গুলোতে ঢুকে পড়া ডাকাত সদস্যদের উদ্দেশ্যে হ্যান্ড মাইক দিয়ে বলতে থাকেন তারা যদি বের না হয়ে আসে তবে তারা ভেতরে প্রবেশ করে গুলি চালাতে বাধ্য থাকবে। এমন কথা শোনার পর ডাকাত সদস্যরা চুপ করে থাকলে সেনাবাহিনী গুলি করতে বাধ্য হয়। পরে তারা আসার চেষ্টা করলে জনগণ তাদের ধরে গণধোলাই দেন এবং ১৭ জন আটক করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেন তারা। আটকরা সবাই টোকাই বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী। প্রায় ঘণ্টা ধরে এই অভিযান চলে। তাদের ধরতে ৭০টি ভবনের প্রতিটিতে ঢুকে পড়েন সেনারা। তখন বাইরে সাইরেন বাজিয়ে চলছিল। পরে আরও কয়েক গাড়ি আসে। তারাও যোগ হয়।
সেই এলাকার বাসিন্দা মেরিনা মিতু নামে একজন বলেন, আমাদের ইসিবি এলাকায় রাত নয়টার দিকে ২০০/৩০০ ডাকাত এক সাথে ৭০টি ভবনে ঢুকেছিল। ঢুকেই তারা এলোপাতাড়ি কোপ দিতে শুরু করে। এসময় রাস্তায় খেলতে থাকা দুটি বাচ্চা স্পট ডেড। পরে আমরা এলাকাবাসী তাদের ধাওয়া করে সব এক্সিট গেটে অবস্থান নিয়ে ঘেরাও দিয়ে অনেকগুলোকে আটক করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছি।
তাদের এলাকায় ডাকাতি রোধে সতর্ক আছেন, অন্যদেরও নিজ নিজ এলাকায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করার আহ্বান জানান তিনি।
অন্যদিকে রাত ৪টায় সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে মিরপুর ১০ এলাকার শিশির নামে একজন জানিয়েছেন, যখনই ঘুমাতে যাব এই মুহূর্তে মাইকে শুনছি এলাকায় ডাকাত পড়েছে। ঘুমাতে পারবো কিনা আর জানি না।
উত্তরা-১১ নম্বর সেক্টর থেকে পিয়াল সরকার, অভিনেত্রী চমক, তাসনিয়া ফারিন ফেসবুক লাইভে জানান, তাদের সেই এলাকায় ডাকাত পড়েছে। ডাকাতরা প্রত্যেকটা বাসা বাড়িতে ঢুকে ডাকাতির চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা সাহায্য চেয়ে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন নম্বরে কল দিচ্ছেন কিন্তু প্রত্যেকটি নম্বরই বিজি। এ সময় অনেকে আত্মীয়-স্বজনদের ফোন করে তাদের সহযোগিতা চান। আশপাশে তারা সকলকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান। রাত দুইটার দিকে উত্তরায় ৯ নম্বর সেক্টরেও ডাকাত তখন ঢুকে পড়ে বলেও জানান তিনি।
উত্তরা-১১ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা শাহ আলম তার ফেসবুক লাইভে এলাকায় ডাকাত পড়ার বিষয়টি জানিয়ে সবার কাছে সহযোগিতা কামনা করেন। পাশাপাশি তিনি যাদের কাছে বৈধ অস্ত্র রয়েছে সেটা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান। তিনি তার ফেসবুক লাইভে আরও জানান, এলাকায় ডাকাত পড়ার বিষয়টি আমরা মাইকিং করেছি। উত্তরা-১১ নং সেক্টরের ৫ নম্বর রোডে রাত সাড়ে তিনটার দিকে এই ডাকাতের ঘটনা ঘটে।
মিরপুর ১২, পল্লবী, বসিলা, মোহাম্মদপুর, আদাবর, উত্তরা এবং আটিবাজার এলাকায় ডাকাত ঢুকে পড়েছে এমন খবর জানিয়ে মসজিদ গুলোতে গভীর রাতে মাইকিং করা হয়েছে। মাইকিং এ বলা হচ্ছিল, এলাকায় ডাকাত পড়েছে। আপনারা ঘরে বসে থাকবেন না। যার যা আছে লাঠিসোটা অস্ত্র টানিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। আশেপাশে যারা আছেন আপনার পাশের বাড়িতে ডাকাতি হলে নেমে পড়েন। সাহায্যে এগিয়ে আসেন।
মঙ্গলবার রাত থেকে শুরু হয়েছে এই ডাকাতি। বুধবার সেটা একযোগে চলতে থাকে। ঢাকা ছাড়াও মুন্সিগঞ্জ এবং বিভিন্ন জেলায় ডাকাতের খবর জানার আছে।
ডাকাতির এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এলাকাবাসী একত্রিত হয়ে ডাকাত প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেছেন। শুধু তাই নয় তারা এলাকাবাসীর মাঝে সহযোগিতা দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ফোন নম্বর ছড়িয়ে দিচ্ছেন। যাতে খুব সহজে কল করলে ছুটে যেতে পারেন। এমন সংক্রান্ত কমিটি করা হয়েছে মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, বসিলা এবং ঢাকা উদ্যান এলাকায়।