ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, মৃত্যুহীন প্রাণ
সালেহীন বাবু
উইমেননিউজ২৪.কম
প্রকাশিত : ১০:৪৫ এএম, ২ আগস্ট ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১২:৪৩ এএম, ১৬ আগস্ট ২০১৮ বৃহস্পতিবার
বাঙালীর শত বছরের মুক্তি সংগ্রামে পর্বততুল্য অজেয় যে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তিনি হচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, ইতিহাসের মহানায়ক, যার জীবনাবসান হয় সপরিবারে স্বাধীনতার পরাজিত ঘাতকদের নির্মম বুলেটের আঘাতে। আমরা হারাই জাতির অভিভাবককে।
ইতিহাস বলে যুগে যুগে পৃথিবীতে মহানায়কের উথথানের পিছনে একজন বিচক্ষণ, মহীয়সী, দুরদর্শী নারীর প্রতক্ষ্য কিংবা পরোক্ষ ভূমিকা থাকে। ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মহানায়ক হিসেবে প্রকাশের পেছনেও এরকম একজন সার্বিক আদর্শে গুণী নারীর ভূমিকা ছিল অনন্য। সেই মহীয়সী নারী আর কেউ নন, তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু পত্নী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গর্ভধারিণী মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
বাঙালীর প্রতিটি সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু নিজেকে মুক্তির আলোকে আপোসহীনভাবে সম্পৃক্ত করেছেন, নিজেকে নিয়ে এসেছেন নেতৃত্বের কাতারে। বাংলার স্বাধীনতাকে করেছেন প্রতিষ্ঠিত। এ পরিক্রমায় তারই পেছনে ছায়াসঙ্গী হিসেবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তার ডাকনাম ছিল রেণু। তিনি মাত্র তিন বছর বয়সে পিতা ও পাঁচ বছর বয়সে মাতা হারান। পিতার নাম শেখ জহুরুল হক এবং মাতার নাম হোসনে আরা বেগম। দুই বোনের মধ্যে ছোট ছিলেন তিনি। দাদা শেখ কাশেম। চাচাতো ভাই শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে শৈশবইে বেগম ফজিলাতুন্নেছার বিবাহ হয়। শৈশবের সেই সময় থেকে বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ সময়টুকু পর্যন্ত বিস্তর পরিক্রমায় সঙ্গে ছিলেন বেগম মুজিব।
তিনি একদিকে যেমন হাল ধরেছিলেন কারাবন্দী স্বামীর রেখে যাওয়া সংসারের, তেমনি কারাবন্দী মুজিব সংগ্রামের কঠিন দিনগুলোতে নেতা ও কর্মী বাহিনীর প্রতি যে নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন তা সময় মতো এবং যথাযথভাবে বাস্তবায়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল তার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।
উত্তরাধিকার সূত্রে বেগম মুজিব যতটুকু অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছিলেন তার পুরোটাই তিনি ব্যয় করেছেন নিঃশর্তভাবে সংসার এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত রাজনীতির পেছনে। পুত্রসম শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি, নিজ পুত্র শহীদ শেখ কামাল, কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, শেখ জামাল এবং কনিষ্ঠ পুত্র শহীদ শেখ রাসেলের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার সমস্ত দায়িত্ব সূচারুভাবে পালন করেছেন।স্বামীর জন্য কষ্ট করলেও কখনও কোন অনুযোগ ছিল না । তার দায়িত্বশীলতার জন্য পরিবার বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে প্রতিবন্ধকতার কারণ হয়ে দাড়ায়নি। অভাব-অনটন, কষ্ট, বিড়ম্বনা নীরবে সহ্য করেছেন। কারো কাছে কোন অনুযোগ করেননি। কখনো রাগ করেননি।
১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অবধি বেগম মুজিব ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে, বেগম মুজিব কখনওবা প্রকাশ্যে কখনও পর্দার অন্তরালে দৃঢ় এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই সময় ছাত্র ও তরুণ সমাজের প্রেরণার প্রধান উৎস ছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
১৯৬২ সালে বন্ধবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার পর তার পক্ষ্যে ধানমণ্ডি ৩২ থেকে সার্বিক নির্দেশনা দিতেন বেগম মুজিব। ১৯৬৬-তে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণা করেন। তখন সেই ৬ দফা কেন্দ্রিক আন্দোলনে বাঙালী জনগোষ্ঠী একত্রিত হয় শোষণের বিরুদ্ধে। সেই ছয়দফা আন্দোলনের পক্ষে জনসমর্থন আদায় ও জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করতে লিফলেট হাতে রাস্তায় নেমেছিলেন বঙ্গমাতা। কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবকৃত ৬ দফা বাস্তবায়িত হলে বাংলার মানুষ তাদের অধিকার ফিরে পাবে। তাই তিনি জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছিলেন এবং বাংলার মানুষের মুক্তির সনদ হিসেবে ৬ দফা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো। সে সময় আন্দোলন দমন করতে না পেরে আইয়ুব শাহী বঙ্গবন্ধুসহ অনেক নেতার নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ফলে বঙ্গবন্ধু আবারও কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন। আন্দোলন আরও বেগবান হয়। দিশেহারা হয়ে আইয়ুব নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। সূচিত হয় মহান গণঅভ্যুত্থান। জনরোষে ভেসে যায় আগরতলা মামলা, এর বিচারক এবং পাকিস্তানী জান্তার দোসরদের সর্বশেষ ঠিকানা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয় তখন ঘৃণাভরে বেগম মুজিব তা প্রত্যাখ্যান করেন। বঙ্গবন্ধু নিজেও প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এই সিদ্ধান্ত বাঙালীর মুক্তির সংগ্রামে বড় একটা টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাড়ায়। গবেষকরা এখনো সেই সিদ্ধান্তের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং ঐ একটি সিদ্ধান্তই বাংলার স্বাধীনতার আকাশকে উজ্জ্বল দ্যুতির আলোয় মেলে ধরেছিলো। এখানেই বঙ্গমাতা অনন্য, অতুলনীয়। রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় তিনি যে কোন সময়ের নেতাকর্মীর চেয়ে অনেক দূর ভাবনায় নিয়ে আসতে পারতেন। আজ থেকে দীর্ঘদিন পর বাংলার আকাশে কি ঘটবে বা ঘটতে যাচ্ছে সেটি তিনি তার দূরদৃষ্টিতা দিয়ে অবলোকন করতে পারতেন। তাইতো তিনি বঙ্গবন্ধুকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পেরেছিলেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের সঠিকতা যাচাই হয়েছিলো।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাস অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্য্য নিয়ে বেগম শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। এমনকি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও ২৩ মার্চের পতাকা উত্তোলন বঙ্গবন্ধুর প্রধান উদ্দীপক ও পরামর্শক হিসেবে বিবেচনা করা হয় বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছাকে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি জোরালো ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু সামরিক জান্তা প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছিলো বঙ্গমাতার স্বাভাবিক জীবনাচরণে। ঐ কঠোর সময়ে তিনি ছেলে শেখ কামালকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সেক্টরগুলোতে নিয়মিত চিঠি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজখবর নিতেন। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের পর দিন ১৭ ডিসেম্বর তার ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বন্দিদশার অবসান ঘটে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডনে যান। সেখান থেকে বেগম মুজিবের সঙ্গে তার প্রথম কথা হয়। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অবসান ঘটে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার দীর্ঘ প্রতীক্ষার। এরপর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজেও বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়ান তিনি। অনেক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে দিয়ে সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন জীবনদান করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত অর্থাৎ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেগম মুজিব ছায়াসঙ্গীর মত একজন মহানায়িকা হিসেবে মহানায়কের পাশে ছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তারা ছিলেন একাত্মা। একইসঙ্গে ছিলেন সুখ-দুঃখে-উৎসবে-সংগ্রামে। জীবনের কঠিনতম সময়ে তারা পার করেছেন পারস্পরিক বিশ্বাস আর শ্রদ্ধায়। একজন আদর্শ স্ত্রী হিসেবে এর চেয়ে একজন নারী আর কিইবা করতে পারে? পরিবারকে নিজের বন্ধনে আগলে রেখে মমতাময়ী হিসেবে জীবনের শেষ পর্যন্ত সেবা করতে কয়জনই বা ধৈর্য্য রাখতে পারে? বাঙালী জাতি প্রতিষ্ঠায় একজন সাহসী নিরব পর্যবেক্ষক, সংগঠক, বিদুষীনী হিসেবে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
বঙ্গবন্ধুর মত একজন মহানায়কের আর্বিভাব ছাড়া আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেতাম না। আর এটাও ঠিক মহানায়িকা বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছার অবদানেই মহানায়কের স্বপ্ন সোনার বাংলাদেশ রুপলাভ করে। বঙ্গমাতা হলেন সেই নারী, যিনি বাঙালীর মুক্তির জন্য স্বামীকে উৎসর্গ করেছিলেন। এক মহীয়সী নারী হিসেবে বেগম শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবের অবিস্মরণীয় ভূমিকা বাঙালির অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে চিরদিন। দেশ ও জাতির জন্য তার এই অপরিসীম ত্যাগ সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও বিচক্ষণতাই বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবকে বঙ্গমাতায় অভিষিক্ত করেছে।