ঢাকা, শনিবার ২৩, নভেম্বর ২০২৪ ১৮:০৭:৫৬ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

নির্মম নির্যাতনে গৃহকর্মী কল্পনা যেন জীবন্ত লাশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:৩৯ পিএম, ২১ অক্টোবর ২০২৪ সোমবার

সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি

অভাবের সংসারের মেয়ে কল্পনা। তাই তো মেয়েকে হবিগঞ্জ থেকে ঢাকায় অন্যের বাসায় কাজে পাঠিয়েছিলো পরিবার। যেন নরকে এসে পড়ে কল্পনা। এমন কোনো নির্যাতন নাই যা ১৩ বছর বয়সী কিশোরীর সাথে করেননি তার গৃহকর্ত্রী। 

খেতেও দিতেন না। কারণে-অকারণে করতেন মারধর। শরীরের বিভিন্ন স্থানে আগুনের ছ্যাঁকা দিতেন।  কাপড় কাটার কেচি দিয়ে হাতের নখ উঠিয়ে ফেলেন। মারধর করে দাঁত পর্যন্ত নাড়িয়ে দেন। চুল শুকানো মেশিন দিয়েও ছ্যাঁকা দিতেন। সমস্ত শরীরে ক্ষত চিহ্নে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। সেই গন্ধ দূর করতে পারফিউম ব্যবহার করাতেন। তবুও তাকে ওষুধ দিতেন না। নির্মম নির্যাতনে যেন জীবন্ত লাশে পরিণত হয়েছে কল্পনা। 

এখন সমস্ত শরীরে ব্যান্ডেজ পরিহিত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরির্চযা কেন্দ্রে (আইসিইউ) পড়ে আছে এই  গৃহকর্মী।

অবশেষে গোপন সংবাদে ১৯ অক্টোবর পুলিশ উদ্ধার করে কল্পনাকে। আটক করে গৃহকর্ত্রী ২১ বছরের দিনাত জাহান আদরকেও। পুলিশ খবর দেয় কল্পনার পরিবারকে। কল্পনাকে নির্যাতনের মামলায় ওই দিনই মামলা করেন মা আফিয়া বেগম।

রোববার (২০ অক্টোবর) দিনাত জাহানকে আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করে পুলিশ। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আফনান সুমীর আদালতে রিমান্ডের বিষয়ে শুনানি হয়। তদন্ত কর্মকর্তা ভাটারা থানার সাব-ইন্সপেক্টর ওবায়দুল হক আদালতকে বলেন, ওই বাসাতে কল্পনা গৃহকর্মীর কাজ করতো। মেয়েটাকে আগুনের ছ্যাঁকা দিতো। সে মারা যায়নি, তবে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অবস্থা খুব খারাপ। চারটা দাঁতও ফেলে দিয়েছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত করেছে। ক্ষত স্থান পচে গন্ধ বের হয়েছে। আমরা ওই বাসায় গন্ধে ঢুকতে পারছিলাম না। গন্ধ দূর করতে পারফিউম ব্যবহার করতো।

আসামিপক্ষের আইনজীবী ঢাকা আইনজীবী সমিতির অ্যাডহক কমিটির সদস্য সচিব নজরুল ইসলাম রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। তিনি বলেন, ঘটনা একটা ঘটে গেছে। আমরা বিপদগ্রস্ত, তারাও। আর দাঁতের বিষয়ে বলা হচ্ছে মারার কারণে দাঁত পড়ে গেছে। এটা ঠিক না। সিঁড়ি মুছতে গিয়ে পড়ে গিয়ে দাঁত পড়ে গেছে। আসামির বয়স ২১ বছর। বিয়েও হয়নি। তারও ভবিষ্যৎ আছে। রিমান্ড বাতিল করে প্রয়োজনে তাকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক।

শুনানি শেষে আদালত তার এক দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন। 

আদালতে উপস্থিত ছিলেন দিনাত জাহানের বড় বোন। তিনি বলেন, অভিযোগে কিছু সত্য, কিছু মিথ্যা।

মামলা সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তা ভাটারা থানার সাব-ইন্সপেক্টর ওবায়দুল হক বলেন, মেয়েটির সাথে নির্মম অত্যাচার করা হয়েছে। সে বলেছে দিনাত জাহান আদরের পাশাপাশি একটা ছেলেও তাকে অত্যাচার করেছে। আমরা দিনাত জাহানকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছি। ভূক্তভোগী পরিবার যেন ন্যায়বিচার পায় সে চেষ্টা চালিয়ে যাবো। 

কল্পনার মা আফিয়া বেগম বলেন, ওর বাপে অসুস্থ। কাজ করতে পারে না। অভাবের কারণে মেয়েটাকে অন্যের বাসায় কাজে দিয়েছিলাম। মেয়েটাকে মেরে কি করছে। মারতে মারতে মেয়েটারে পচা বানিয়ে ফেলছে। 

তিনি বলেন, ওর মা-বাবা, ভাই থাকে ধানমণ্ডির ঝিগাতলায়। ও একা বাসায় থাকতো। তিন বছর আগে এক পরিচিতের মাধ্যমে কাজে দেয়। আমরা অতো চিনিও না। বলছে গুলশানের বাসায় কাজ করবে। মেয়েটার সাথে কাউকে দেখা করতে দিতো না। ফোন দিলেও কথা বলতে দিতে চাইতো না। প্রথমে মাসখানেক ভালোবাসতো। এরপর থেকে মারা শুরু করে। প্রথমে কম কম মারতো। পরে আরও মারতে থাকে। আমার মেয়ে বাড়ি চলে যেতে চাইতো। ওকে দা দেখিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিতো। বাসায় বসে মদ, গাজা, সিগারেট খাইতো আর আমার মেয়েটাকে মারতো। 

আফিয়া বেগম বলেন, কত বছর হয়ে গেছে মেয়েটাকে দেখি না। ফোন দিয়ে কথা বলতে চাইলে বলতো সে বাসায় নাই। দেখাও করতে দিতো না। দুই মাস আগে ঢাকায় আসি। বোনের বাসায় উঠি। বিল্ডিংয়ে বিল্ডিংয়ে খুজি আর কান্নাকাটি করি। মেয়েটাকে পাই কি না। পরে তো পেলাম এ অবস্থায়। মেয়েটার কোনো অঙ্গ ঠিক নাই। আমার মেয়ে আর মেয়ে নাই। মারতে মারতে পচা বানিয়ে ফেলছে। দাঁতও ভেঙে দিছে। চুলও কেটে ফেলছে। নিজে মারতো, আবার ভাইকে ফোনে ডেকে এনেও মারাতো। ওর ফ্যামিলির সবাই জানে। ওর মা-বাবাকে ফোন দিতাম। বলতাম মেয়েটাকে কত বছর নিছে, দেখি না। তারা বলতো অত পাগল কেন। আমার মেয়ে কি অন্যায় করছে। ওদের শক্ত বিচার চায়। এখন ৫০ লাখ টাকা দিয়ে মামলা তুলে নিতে বলে। গরীব হতে পারি। টাকা চাই না। বিচার চাই। ওই ফ্যামিলির সবার যাবজ্জীবন সাজা চায়। 
 
কল্পনার বাবা শহিদ মিয়া বলেন, আমার পাঁচটা মেয়ে আর ছোট একটা ছেলে। আমি অসুস্থ, মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গেছে। তাই কাজ করতে পারি না। এজন্য মেয়েটাকে কাজে দিয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েটাকে কিভাবে অত্যাচার করছে। এখন মেয়েটা আইসিউতে আছে। কথাও বলতে পারছে না। মেয়েটার সাথে যারা এমনটা করেছে তাদের সাজা চাই।

কল্পনার দুলাভাই ছিদকু বলেন, ওকে প্রচন্ডভাবে মেরেছে। তার সাথে ভয়াবহ অত্যাচার করেছে। দাঁত ভেঙে দিয়েছে। সুচ গরম করে জিহ্বায় ছ্যাঁকা দিয়েছে। ওর জীবনটা নষ্ট করে দিছে। সারা শরীর ব্যান্ডেজ। এখন আইসিউতে আছে। আল্লাহ জানে কতদিন থাকা লাগে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই।    

রোববার দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের অবজারভেশনে কল্পনার চিকিৎসার খোঁজখবর নিতে আসেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ। সেখানে এসে তিনি বলেন, কিশোরী গৃহকর্মীকে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, একজন সুস্থ মানুষ এভাবে নির্যাতন করতে পারেন না। দেশে প্রায় পাঁচ লাখের মতো শিশু রয়েছে যারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় বা পরিবারে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। আমরা শুনে আশ্চর্য হয়েছি, গত সাড়ে চার বছর যাবত এই শিশুটি নির্যাতিত হয়েছে। এটা আমাদের দেশের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

তিনি আরও বলেন, নির্যাতিত শিশুটির বয়স মাত্র ১৩ বছর। যদিও চৌদ্দ বছর বয়সের আগে কোনো শিশুকে শ্রমিকের পেশায় নিয়োজিত করার আইন আমাদের দেশে নেই। আমাদের দেশে শুধু দারিদ্র্যতার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যারা এই ধরনের নিষ্ঠুর শিশু নির্যাতন করে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, আফিয়া বেগমের বোন রাজিয়া দিনাত জাহান আদরের বান্ধবী আলাবির বাসায় কাজ করতো। সেই সুবাদে আলাবির মাধ্যমে কল্পনা তিন বছর আগে ২০২১ সালের ১ জুন দিনাত জাহান আদরের বসুন্ধরার বাসায় মাসিক দশ হাজার টাকা বেতনে কাজের বুয়া হিসেবে কাজ শুরু করে। এরপর থেকে দিনাত কল্পনাকে তার মায়ের দেখা করতে দেয় নাই। বিভিন্ন সময়ে আফিয়া বেগম ফোনে মেয়ের সাথে কথা বলতে চাইলেও দেয় নাই।  বাসার ঠিকানা চাইলেও দেয় না। ১৯ অক্টোবর ভাটারা থানা পুলিশের মাধ্যমে আফিয়া বেগম সংবাদ পান তার মেয়েকে আসামিরা শারীরিকভাবে মারধর করে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আগুনের ছ্যাঁকা দিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর পচা দুর্গন্ধযুক্ত ক্ষত জখম করেছে। পুলিশ তার মেয়েকে উদ্ধার করে দিনাত জাহানকে আটক করে।

আফিয়া বেগমের অভিযোগ, ২০২১ সালের ১ জুন থেকে দিনাত জাহানের বাসা বসুন্ধরার আবাসিক এলাকায় কাজে আসার কিছু দিন পর থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত বিকাল পর্যন্ত কল্পনাকে ঠিকমত কোনো দিনই খেতে দেয়নি। কারণে-অকারণে দিনাতসহ অজ্ঞাতনামা এক পুরুষ মারধরসহ চুল শুকানো মেশিন দিয়ে আগুনের ছ্যাঁকা দিতো, কাপড় কাটার কাঁচি দিয়ে তার হাতের নখ উঠিয়ে ফেলতো। রুম মোছার ব্রাশ দিয়ে মুখে আঘাত করে সামনের নিচের অংশের দুইটি দাঁত নাড়িয়ে দিয়েছে। দীর্ঘদিন অনাহারে ও অর্ধাহারে থেকে কল্পনা শুকিয়ে গেছে। মারধরের ফলে মুখ, হাত-পা, পিঠসহ সমস্ত শরীরে ক্ষত চিহ্নে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে।