ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২১, নভেম্বর ২০২৪ ১৫:০৮:৩২ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

নক্ষত্র ও নীলকণ্ঠ পাখি/ আইরীন নিয়াজী মান্না

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:১৩ পিএম, ১১ নভেম্বর ২০২৪ সোমবার

সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি

পর্দা সরিয়ে ঘরের ভেতর উঁকি দিলো মা। জানালার পাশে খাটের ওপর বসে আছে নক্ষত্র। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। এক মনে কি যেন দেখছে। মা যে ততক্ষণে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টেরও পেলো না।
সোমা পেছন থেকে মেয়ের কপালে আলতো স্পর্শ করে বললো: এত সকালে উঠে পড়েছো। ঘুম ভেঙে গেলো?
এবার মেয়ে অবাক হয়ে পেছন ফিরে তাকালো। ও, মা!
-আজ কেমন লাগছে? এখন জ্বর নেই তো দেখছি।
-ভালো, অনেক ভালো। বলেই মায়ের কোলজুড়ে বেড়ালের মত গুটিয়ে শুয়ে পড়লো নক্ষত্র।
মা ওর কপালে পরে থাকা চুলগুলো পরম মমতায় নাড়তে নাড়তে বললো: অত মন দিয়ে বাইরে কি দেখছিলিরে। আমি ঘরে ঢুকলাম বুঝতেও পারলি না।
-ও মা, জানো আম গাছের ডালে একটা নীল রঙের পাখি এসে বসে প্রতিদিন। কি দারুণ দেখতে। টুই টুই করে ডাকে। তুমি শুনতে পাও না? ওটা কি পাখি মা? প্রতিদিন সকালে এসে আমার ঘুম ভাঙায়।
-কই দেখিনি তো।
-কি দারুণ নীল রঙ পাখিটার। আগে অত নীল ছিলো না। এই কয়দিনেই নীল হয়ে গেছে। প্রতিদিন ভোরে এসে আসে। কি মিষ্টি করে ডাকে।
-পাখিটা তোর বন্ধু হয়ে গেছে। তাই প্রতিদিন এসে তোকে ঘুম থেকে তোলে। ওটা তোর বন্ধুপাখি।
-বলো না ওটা কি পাখি। বলো না মা। 
নক্ষত্র সোমার হাত ধরে ঝাঁকি দেয়। ও কেমন উচ্ছসিত হয়ে ওঠে। মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসে। মনে মনে শান্তি পায়। মেয়েটার জ্বর একটু কমেছে। কী সুন্দর কথা বলছে। মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ দেয় সোমা। 
হেসে বলে: বোকা মেয়ে, আমি কি পাখি চিনি! কাল তোর আম্মা আসছে। তাকে দেখাস। ঠিক বলে দেবে ওটা কি পাখি।
আম্মা আসছে শুনেই আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠে নক্ষত্র। 
-সত্যি আম্মা আসবে? কি দারুণ হবে।
-কাল রাতে তোর বাবা ফোনে জানিয়েছে তোর জ্বরের কথা। আজই সে ট্রেনের টিকিট কেটে ফেলেছে। তোর জ্বর, আর তোর আম্মা আসবে না? তা কী হয়।
নক্ষত্র বলে ওঠে- কি মজা। এবার আম্মা এলে আর ঢাকায় যেতে দেব না। আম্মাকে ছাড়া আমার একদম ভালো লাগে না।
ওর কথা শুনে মা মিছে রাগ করে বলে: পাগল নাকি! চাকরি-বাকরি রেখে আম্মা তোর কাছে এই রাজশাহীতে এসে বসে থাকবে?
কথা বলতে বলতে বেশ ক্লান্ত লাগছিলো নক্ষত্রর। বালিশের ওপর মাথা রেখে ও মাকে প্রশ্ন করলো: আমি কবে স্কুলে যাবো মা?
-এই তো আর কদিন পরই পূজার ছুটি। এবার তো চারদিন ছুটি। ছুটি শেষ হলেই তুমি স্কুলে যাবে সোনাপাখি।
নক্ষত্র হাসে। খুশিতে ওর চোখে জল চলে আসে। ক্লান্ত দৃষ্টিতে মার দিকে তাকিয়ে বলে: বাবা কি অফিসে চলে গেছে, মা?
-হাঁ। তুমি ঘুমিয়ে ছিলে। তাই আর ডাকেনি। ফোন করবে। ফেরার পথে তোমার জন্য কি আনবে জানাতে বলেছে।
মার কথা শুনতে শুনতে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে ও। খোলা জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। বাইরে ভোরের কচি রোদ দোল খাচ্ছে গাছের সবুজ পাতায়। কচিরমিচির পাখি ডাকছে। বড় মিষ্টি শোনাচ্ছে সে ডাক।
সোমা আধো শোয়া হয়ে মেয়ের কপালে নিজের গাল আলতো করে চেপে ধরে আছে। আজ জ্বর না থাকলেও মেয়েটা বড় ক্লান্ত। 
সোমা বললো- তুমি শুয়ে থাকো। আমি গরম দুধ আর পাউরুটি নিয়ে আসি তোমার জন্য। দুধ খেলে শরীরে শক্তি পাবে।

দুই.
বাইরে থেকে বাবার কণ্ঠ শুনতে পায় নক্ষত্র। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে বাবা কারো সাথে কথা বলছে। ও কথাগুলো বিশেষ বুঝতে পারছে না। তবে কিছু শব্দ শুনতে পাচ্ছে। 
দুপুরে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। মাটির সোদাগন্ধ কানে এসে লাগছে। মাটির এই ভেজা গন্ধটা নক্ষত্রর খুব ভালো লাগে। ও জানালা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করছে। 
কথা শেষ করে বাবা হয় তো এখনই ঘরে এসে ঢুকবে। ঢুকেই বলবে: আমার প্রিন্সেস আজ কেমন আছে? কিন্তু বাবা এলো অনেক পরে। ভেতরের ঘরে মার সাথে কি সব কথা হলো তার। বিছানায় শুয়ে শব্দ পেলো নক্ষত্র।

তিন.
নক্ষত্রদের বাড়িটা একতলা। বিশাল বিশাল অনেকগুলো ঘর। পাশাপাশি দুটো ঘরের একটিতে নক্ষত্র ঘুমায়। অন্যটি মা-বাবার ঘর। রান্নাঘরটা বাড়ির পেছনদিকে। রান্নাঘরের পেছনে একটা ঘাটবাঁধানো মাঝারি মাপের পুকুর। বাবা অধিকাংশ দিনই এই পুকুরে গোসল করে। বাড়ির চারদিক জুড়ে খালি জায়গা। তাতে রয়েছে আম, কাঁঠাল, জাম, জামরুলসহ নানা রকম গাছগাছালি। কত রকম মৌসুমি ফুল যে আছে ওদের বাড়িতে। মা খুব সখ করে ফুল গাছ লাগায়। নিয়মিত যতœ নেয়। 
নক্ষত্রর ঘর থেকে বাড়ির উঠান, বাইরের গেট, বাগান, গাছ সব দেখা যায়। এ ঘরের দখিনের জানালাটা ওর ভীষণ পছন্দ। জানালাটা দিয়ে গেটের বাইরের পিচঢালা কালো পথটা সোজা দেখা যায়। আম-জাম গাছের ডালে কিভাবে বৃষ্টি ঝরে তা দেখা যায়। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে খুব পছন্দ করে ও। এই তো সেদিন কেমন ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছিলো। জানালা দিয়ে অনেকক্ষণ বৃষ্টি দেখছিলো নক্ষত্র। চোখে-মুখে এসে বৃষ্টির ছটা লাগছিলো। তা-ও সরেনি। বাইরের ঠান্ডা বাতাস মন কেমন উতলা করে দিচ্ছিলো। এই বৃষ্টির কারণেই তো জ্বর এলো। 
অনমনা হয়ে এসব ভাবছিলো নক্ষত্র। এসময় বাবা এসে ঢোকে ঘরে। তার পেছন পেছন মা। ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে বাবা। তারপর ওর কপালে হাত দিয়ে বলে: জ্বর তো নেই। আজ কেমন লাগছে মা? 
-ভালো। 
এ সময় মা বলে: দেখ নক্ষত্র বাবা তোর জন্য কি এনেছে। রেডিমেট পাস্তা। একটু দেই এখন, খা।
নক্ষত্র মা দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। মা ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। নক্ষত্র বাবাকে বলে: বাইরে কার সাথে কথা বলছিলে বাবা?
-ও মা, লেবার ঠিক করলাম। গাছগুলো পরিস্কার করাবো। চারদিকে যা ডেঙ্গু হচ্ছে। ড্রেনগুলোও পরিস্কার করতে হবে। কখন পড়শীরা অবজেকশন দেয়, বলা তো যায় না।
এসময় পাস্তার প্লেট হাতে মা ঘরে ঢুকলো। বললো: কেন. কেউ কিছু বলেছে নাকি? দেখ, কোনো গাছ যেন কাটা না পড়ে। সেই কবে শশুর-দাদা শশুরের আমলের গাছ সব।
-না, না। তা কেন হবে। ছেটেছুটে দেবে আর কি। বড় বড় গাছগুলোতে যা ঝুল হয়েছে। দেখলাম বিকেলে।  ঝোপঝপরাগুলো একটু  ছেটে দিলে আর মশা হবে না। যা ডেঙ্গু হচ্ছে চারদিকে। আমি তো ভেবেছিলাম নক্ষত্রর ডেঙ্গু হয়েছে। ভগবান রক্ষা করেছে। 
এক কথা শুনে সোমা ভয়ে মা দুগগা মা দুগগা বলে কপালে দাগ কাটলো। 
নক্ষত্র মার ভয়ার্ত চেহারা দেখে হেসে বললো: মা, ভয় পাচ্ছো কেন। আমার তো ঠান্ডাজ্বর।
মা বললো: ভয় পাই কি আর সাধে। তুমি আবার উঠে বসেছো কেন? শুয়ে থাকো নক্ষত্র। আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরই দুর্গাপূজা। পূজা শেষেই স্কুলে যাবে। 
বাবা বললো: একটু বসে থাকুক। জ্বর নেই তো। মনে হয় আর আসবে না। কত আর শুয়ে থাকবে বাচ্চাটা।
নক্ষত্রর মাথায় বিলি কাটতে কাটতে মা ওর বাবাকে বললো: বাগান কে পরিস্কার করবে? কবে আসবে?
-করিম মিয়া দুটি ছেলে নিয়ে আসবে কাল। ছুটির দিন, কালই করে ফেলি। তা না হলে আবার সাত দিন অপেক্ষা করতে হবে।

চার.
টুই.. টুই.. খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেলো নক্ষত্রর। চোখ খুলে তাকালো সে। নীল পাখিটা আম গাছের ডালে এসে বসেছে। ওর গায়ের নীল রঙ আগের চেয়ে আরো গাঢ় হয়েছে। কুসুম কুসুম রোদ পরে আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ওকে। ভোরের ঠান্ডা বাতার এসে নীল পালকে লাগছে। ওর গায়ের নীল রঙ যেন ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকের আলোতে। 
নক্ষত্র উঠে বসে। মা কখন ঘুম ভেঙে উঠে গেছে ও জানতেই পারেনি। মা হয়তো নাস্তা বানাচ্ছে। এতক্ষণে ভেতর বাড়িতে নিশ্চয় ঝি বুয়া চলে এসেছে। 
নক্ষত্রর শরীর এখনো বেশ দুর্বল। তবে মাথার ভার ভার ভাবটা কমেছে। ও খাটে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে। তারপর জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। বাইরে আলো ঝলমল করছে। গতকালের মত আকাশের সেই গোমরামুখ আর নেই। চারদিক ঝকঝকে। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয় নক্ষত্র।
নীল পাখিটা এখন আর গাছের ডালে নেই। হয় তো উড়ে গেছে কোথাও। বাগান থেকে পাতা সরানোর শব্দ কানে আসছে। কারো যেন মৃদৃলয়ে কথা বলছে। এত ভোরে কি লেবাররা কাজ করতে শুরু করেছে। নক্ষত্র উঠে জানালার পাশে দাঁড়ালো। আরে, তাই তো। দুজন লোক সামনের উঠানটা দুদিক থেকে ঝাড়– দিচ্ছে। জায়গায় জায়গায় ঝরা পাতার স্তুপ।
বাবা বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে করিম মিয়াকে কি যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে। নক্ষত্র আস্তে করে ডাকলো: বাবা...। 
বাবা দূর থেকে তাকিয়ে হাত নাড়লো।
-উঠে গেছো, মা? তোমার মা নাস্তা বানাচ্ছে তোমার জন্য। বারান্দায় আসতে চাও?
ঠিক এ সময় মা নাস্তা হাতে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলো: না, না। বাইরে যেয়ে কাজ নেই। দুনিয়ার ধূলা উড়ছে উঠানে। নক্ষত্র তুমি নাস্তা খাও।
-তুমি আমাদের কথা কিভাবে শুনলে মা?
-ও মা! শুনবো না? তোমার বাবা যেভাবে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে। ওই রান্নাঘর থেকে শোনা যাচ্ছে।
মা-মেয়ের হাসিতে কলকলিয়ে ওঠে সারা ঘর। নক্ষত্রর মুখে একটু একটু করে খাবার তুলে দেয় মা। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাবাকে ডাকে মা। 
-আর কতক্ষণ লাগবে? সকালে নাস্তাও খেলে না ঠিক মত। একটু চা খেয়ে যাও।
বাবা জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। বাবার কপালে হালকা ঘাম জমেছে। চেহারাটা বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে। নক্ষত্রর মায়া হয় বাবার জন্য।
-এই তো হয়ে গেছে। খাবার ঢেকে রাখো। আমি এখনি আসছি। আর ওদের জন্য পারলে একটু চা-নাস্তা পাঠাও। বেচারারা অনেক কষ্ট করছে।
-এক্ষণি পাঠাচ্ছি। আর তুমি তাড়াতাড়ি এসো। কাল ভোরে দিদি চলে আসবে। আমার হাতে অনেক কাজ। নক্ষত্রর ঘরটা একটু গুছিয়ে রাখি। দিদি নাকি ওর সাথেই ঘুমাবে।
মহানন্দে লাফিয়ে ওঠে নক্ষত্র। আম্মা আসছে! আম্ম এলেই দারুণ মজা হয়। গল্প, ঘুরে বেড়ানো আর কত রকম কেনাকাটা যে হয় তার সীমা নেই। এর আগেরবার এসে আম্মা দেশ-বিদেশের কত গল্প বলেছিলো। কত যে জানে নক্ষত্রর আম্মা। দুনিয়ার গল্প থাকে তার ঝুলিতে। মুক্তিযুদ্ধের গল্প, দেশের গল্প, রুপকথা, ভূতের গল্প, গাছের গল্প, পাখির গল্প। নক্ষত্রর আম্মা সাংবাদিক। চাকরি করতে সে চলে গেছিলো সুদূর চীনে। চীনের কত গল্প জানে আম্মা তার শেষ নেই। সে সব গল্প বলেছে নক্ষত্রকে। গ্রেটওয়ালের গল্প, চিনের বীর নারী যোদ্ধা মূলারের গল্প, প্রাচীন চীনের রাজাদের মজার মজার সব গল্প। পৃথিবীর কত দেশে ঘুরে বেড়ায় আম্মা। নক্ষত্রকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে সব গল্প বলে। নক্ষত্র শোনে আর অবাক হয়।

পাঁচ.
সকালে ঘুম ভেঙে যায় নক্ষত্রর। চোখ খুলেই চমকে যায়। আম্মা বসে আছে ওর মাথার পাশে। ও হেসে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে।
-কখন এলে আম্মা। আমাকে ডাকলে না কেন?
-অনেক ভোরে এসেছি, মা। তুমি ঘুমাচ্ছিলে বলে আর ডাকিনি। বাইরে তাকিয়ে দেখ কি সুন্দর আলো ঝলমলে সকাল। নীল আকাশে মেঘপরিরা কেমন ছুটোছুটি করছে।
উঠে বসে নক্ষত্র। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। ঘরজুড়ে মিষ্টি আলো ছড়িয়ে পরেছে। নক্ষত্র অনুভর করে ওর বেশ ভালো লাগছে। শরীরেও কোনো কষ্ট নেই।
ও বলে: জানো আম্মা, আমার কত জ্বর হয়েছিলো। কত কষ্ট হয়েছে। বাইরে যেতে পারি না কত দিন। স্কুলেও যাই না। আজ তুমি এসেছো আর আমি সুস্থ হয়ে গেছি।
আম্মা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে: আমি সব জানি সোনাপাখি। তুমি কত কষ্ট পেয়েছো। এজন্যই তো আমি চলে এসেছি। তুমি বেশি বেশি করে খাওয়া-দাওয়া করো। দেখবে শরীরে শক্তি পাবে।
ধুপের গন্ধ ভেসে আসে নাকে। মিষ্টি সুরে শাখ বাজছে। নক্ষত্রর কি যে ভালো লাগে।
ও জিজ্ঞাসা করে: মা কি পূজা করছে, আম্মা। 
আম্মা বলে: হ্যাঁ। আজ তো মহালয়া, তুমি জানো? আজ দেবীপক্ষের শুরু। আজকের দিনে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সারা বাড়িতে ধুপ দিতে হয়। 
আম্মার কথা শুনে অবাক হয়ে যায় নক্ষত্র। এই শরীর খারাপের মধ্যে ও তো ভুলেই গিয়েছিলো মহালয়ার কথা! বাবা নিশ্চয় রেডিওতে মহালয়া শুনছে। ইস্। এবার ওর আর শোনা হলো না।
উদাস হয়ে ও বললো: আম্মা, এবার আমি আর মহালয়া শুনতে পারলাম না।
আম্মা ওকে শান্তনা দিয়ে বললো: একদম মন খারাপ করো না। রাতে আমি তোমাকে শ্রীরামের রাবণ বধের গল্প শোনাবো। মা দুর্গা কিভাবে মহিষুরকে হত্যা করেছিলেন সে গল্প বলবো। 
নক্ষত্র আনন্দিত হয়ে উঠে বলে: সত্যি? মা তোমার মত করে গল্প বলতে পারে না।
নক্ষত্রর কথা শুনে আম্মা হো হো করে হেসে ওঠে। 

ছয়.
ঠিক এ সময় বাইরে থেকে টুই টুই টুই, সেই মিষ্টি শব্দটা ভেসে আসে। চমকে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে আম গাছটার দিকে তাকায় নক্ষত্র। ফিসফিস করে বলে: আম্মা, দেখ, দেখ আম গাছে ডালে ছোট নীল পাখিটা দেখতে পাচ্ছো...?
আম্মা দ্রুত চশমাটা পরে নিয়ে জানালা গলে আম গাছটার দিকে তাকায়।
ওদিকে নক্ষত্র আবারো বলে: ওটা কি পাখি? রোজ ভোরে আম গাছের ঠিক ওই ডালটাতে এসে বসে। টুই টুই করে ডাকে। তারপর কেউ আসার আগেই কোথায় যেন চলে যায়।
আম্মা মিটিমিটি হেসে বলে: ওটা কি পাখি সত্যি তুমি জানো না? ওটা নীলকণ্ঠ পাখি। প্রতি বছর দশমীতে এই পাখিই কৈলাসে ফিরে গিয়ে শিবকে দেবী দুর্গার ঘরে ফেরার খবর জানায়।
নক্ষত্র অবাক হয়। ওটাই নীলকন্ঠ, অথচ ও চিনতেই পারেনি! 
ও বলে: জানো, প্রথম দিকে পাখিটা অত নীল ছিলো না। আস্তে আস্তে গাঢ় নীল হয়ে গেছে। 
নক্ষত্রর কথা শুনে আম্মা হাসে। বলে: ও তো তোমাকে খুব ভালোবাসে। ও জানে তুমি লক্ষি মেয়ে। তাই তোমার সব অসুখ নিয়ে ও পুরো নীল হয়ে গেছে। তোমারও জ্বর ভালো হয়ে গেছে। তাই না?
আম্মার কথা শুনে খুশি হয় নক্ষত্র। ভাবে তাই তো পাখিটার জন্যই সে সুস্থবোধ করছে।
এবার আম্মা বলে: তুমি কি জানো শিবের আরেক নাম নীলকন্ঠ?
নক্ষত্র আমতা আমতা করে বলে: না। তাহলে এই পাখিটাই কি শিব?
আম্মা ওকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বললো: না, তা না। তবে পুরান মতে, সমুদ্রমন্থনের সময় যে বিষ উঠে এসেছিল তা গ্রহণ করতে রাজি ছিল না অষুর বা দেবতারা কেউই। তখন সৃষ্টিকে রক্ষা করতে নিজের গলায় সেই বিষ ধারণ করেন স্বয়ং মহাদেব বা শিব। সেই বিষের জ্বালায় আস্তে আস্তে নীল হয়ে ওঠে মহাদেবের গলা। সেই থেকেই তার নাম নীলকন্ঠ। 
গল্প শুনতে শুনতে নক্ষত্র চোখ গোল গোল করে আম্মার দিকে তাকিয়ে থাকে। বিস্ময়ভরা কন্ঠে বলে: আম্মা, তুমি কত কিছু জানো!
আম্মা বলে: আরো আছে নক্ষত্র, রাবণকে বধ করার আগে, নীলকণ্ঠ পাখির দর্শন লাভ করেছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। সেজন্যে এই পাখিকে শুভ বলে মনে করা হয়। 
এ কথা শুনে নক্ষত্র ভাবে এই পাখিটাও সত্যি শুভ। প্রতিদিন ভোরে ওর কাছে এসে ওর সব ক্লান্তি দূর করে দিয়েছে। ওর বড় মায়া হয় পাখিটার জন্য। ও আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আম্মা জানালা দিয়ে বাইরে পাখিটার দিকে তাকিয়ে বলেই চলে: অনেকে বিশ্বাস করে দশমীর দিন নীলকণ্ঠ দেখলে, পাপ মুক্ত হওয়া যায় এবং ইচ্ছাপূরণ হয়। জানিস, পশ্চিমবঙ্গে দশমীর দিন দেবী বিসর্জনের আগে নীলকন্ঠ পাখি উড়িয়ে দেয়া হয়। আমাদের দেশে অবশ্য এমন নিয়ম নেই।
আম্মার কথা শেষ হতেই নক্ষত্রর মা এসে ঘরে ঢুকলো।
-কি রে নক্ষত্র দুজনে মিলে এত কি গল্প করছিস। নাস্তা করবি না। আম্মা সেই ভোর থেকে যে না খেয়ে তোর জন্য বসে আছে রে!
-মা ওটা নীলকণ্ঠ পাখি। আম্মা ঠিক চিনে ফেলেছে। উচ্ছসিত হয়ে বললো নক্ষত্র।
সোমা ওর কথা শুনে বললো: বলেছিলাম না তোর আম্মা বলতে পারবে। তোর আম্মা তো পাখি বিশেষজ্ঞ। তোর শরীর এখন কেমন লাগছে?
আম্মা বললো: কোনো অসুখ নেই। নক্ষত্র ভালো হয়ে গেছে। এখন শুধু বেশি বেশি খাবে। তাই না বাবা?
নক্ষত্র এবার আম্মার দিকে তাকিয়ে বললো: তুমি এলে বলেই তো ভালো হলাম। এখন বলো আমার জন্য কি এনেছো।
এ কথা শুনে সোমা বলে: হায় ভগবান, মেয়ে কি বলে! আগে নাস্তা খা, পরে দেখিস কি এনেছে আম্মা। তারপর দিদি নাস্তা খেতে আয় বলেই সোমা ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো।

সাত.
ঘরের ও প্রান্তে পরে থাকা চাকাওয়ালা লাগেজটা আম্মা টানতে টানতে খাটের কাছে নিয়ে এলো। তারপর একটা একটা করে জিনিস বের করতে শুরু করলো। 
: এই দেখ তোর জন্য দুটি জামা। এই দেখ তোর চকলেট বক্স। একটা চকলেট বক্স তোর বন্ধুদের জন্য।
নক্ষত্র একটা একটা করে জিনিসগুলো হাতে নেয় আর আনন্দে আটখানা হয়ে যায়।
: এই যে ভিক্টোর হুগোর লা মিজারেবল বইটা এনেছি এবার। আর টিনটিনের পাঁচটা পর্ব। একটা বারবি ডলও এনেছি। চলবে?
আনন্দে নক্ষত্র যেন বাকহীন হয়ে গেছে। মুখফুটে কিছু বলতে পারছে না। শুধু ড্যাপ ড্যাপ করে তাকিয়ে আছে বইগুলোর দিকে। 
আম্মা ওর দিকে তাকায় আর মিটমিট করে হাসে। বলে: একটা শেষ আকর্ষণ আছে তোর জন্য।
-কি...!
একটা বড় প্যাকেট বের করে আম্মা লাগেজের ভেতর থেকে। তারপর প্যাকেটা ছিড়ে একটা সুন্দর গাছের চাড়া বের করে।
বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে নক্ষত্র বলে: আম্মা, এটা কি গাছের চারা?
-শেফালী। শরতের ফুল। চিনিস তো?
-হ্যাঁ, আমাদের স্কুলে একটা বিশাল গাছ আছে। আমি কতবার ফুল কুঁড়িয়ে এনেছি। ভালো হলো। আমাদের বাসায় কিন্তু শেফালী ফুল গাছ নেই, আম্মা।
-সেজন্যই তো আনলাম। নাস্তা খাওয়ার পর আমরা দুজন গিয়ে বাগানে গাছটা লাগিয়ে দেবো। তুমি প্রতিদিন পানি দেবে। এ শরতে লাগাবো সামনের শরতে এ গাছে ফুল ফুটবে।
আম্মার কথা শুনে নক্ষত্রর খুব ভালো লাগে। অনেক দিন পর ও ঘরের বাইরে পা রাখবে, বাগানে যাবে। কেমন হালকা লাগে ওর। ও শুনতে পায় পাশের ঘরে বাবা এখনো মহালয়া শুনছে। রেডিওতে কে যেন বলছে-‘যা দেবী সর্বভূতেষু’। 
নীলকণ্ঠ পাখিটা এখনো আম গাছের ডালে বসে আছে। সকালের নরম রোদ গায়ে মেখে এক নাগাড়ে ডেকেই চলেছে-টুই..টুই..টুই..!  
##