ঢাকা, সোমবার ১৮, নভেম্বর ২০২৪ ০:৩৮:৫৮ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

পলিথিন বন্ধে সরকারের তোড়জোড়, তবু বন্ধ হয়নি ব্যবহার

বিবিসি বাংলা অনলাইন

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৮:৪০ পিএম, ১৭ নভেম্বর ২০২৪ রবিবার

সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বাজারের জন্য পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের বিষয়ে বেশ সোচ্চার। অক্টোবরে সুপারশপ এবং নভেম্বর থেকে বাজারে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে সেটা সম্ভব হয়নি।

নভেম্বর মাসের শুরু থেকে অভিযান পরিচালনা করার কথা থাকলেও বাস্তবে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হয়নি।

যদিও এর মধ্যে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু পলিথিন বহনকারী ট্রাক ও পলিথিন জব্দের তথ্য জানানো হয়েছে সরকারের তরফ থেকে।

পলিথিন বিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে কোথাও কোথাও বাধার মুখেও পড়তে হয়েছে কর্মকর্তাদের।

১৩ই নভেম্বর বুধবার পুরান ঢাকায় যৌথ অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে বাধার মুখে অভিযান স্থগিত করতে হয় সরকারি কর্মকর্তাদের। কারখানার শ্রমিক-মালিকরা বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে কারখানা বন্ধের প্রতিবাদ করতে থাকেন।

“অভিযান বন্ধ করতে হয়নি, অভিযানটা যে মাত্রায় পরিচালনা করার পরিকল্পনা ছিল সেই মাত্রায় (বুধবার) হয়নি, কারণ ওখানে একটা জমায়েত করা হলো, এবং বললো যে তাদেরকে অন্তত ছয় মাস সময় দিতে হবে” অডিও বার্তায় বিবিসিকে জানান পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

এর আগেও বহুবার এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে, তবে এবার তারা একটু বড় মাত্রায় অভিযান পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন বলে তিনি জানান।

সরকারের তাদেরকে পুনর্বাসন করতে হবে এমন দাবির প্রসঙ্গে তিনি পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, “আপনি একটা নিষিদ্ধ পণ্য বানাচ্ছেন, আপনি মালিক, আপনি শ্রমিকদেরকে নিয়োগ দিয়ে কাজটা করছেন, শ্রমিকরা হয়তো জানে না, এখন এটার পুনর্বাসন সরকার করবে নাকি এর ক্ষতিপূরণ মালিক করবে?”

পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য ক্ষতি বিবেচনায়, ২০০২ সালে আইন করে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল বাংলাদেশ সরকার।

সেসময় বাংলাদেশ ছিল এমন পদক্ষেপ নেয়া বিশ্বের প্রথম দেশ। যদিও পশ্চিমা বিশ্বের বিবেচনায় বাংলাদেশে পলিথিন ব্যবহারের শুরুটা অনেক পরের দিকে শুরু হয়েছিল।

আইন করে নিষিদ্ধ করাটা কাজেও এসেছিল। ২০০৬ সাল পর্যন্ত মোটামুটি পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার সেভাবে দেখা যায়নি। এরপর ধীরে ধীরে নজরদারির অভাবে বাজারে জায়গা ফিরে পায় পলিথিন।

এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) নামের সংস্থার একটি হিসেবে প্রতিদিন ঢাকা শহরেই সাড়ে চার কোটি পলিথিন ব্যাগ বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেয়া হয়।

তাদের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী যারা প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য উৎপাদনের সাথে সরাসরি কাজ করেন তাদের উপরই বিষাক্ত রাসায়নিকের স্বাস্থ্যগত প্রভাব বেশি পড়ে।

এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ড. শাহরিয়ার হোসেন মনে করেন, যেটি আগে থেকেই নিষিদ্ধ সেটি আইনের প্রয়োগ না থাকার কারণেই বিস্তার হয়েছে এবং বর্তমানে আইনের প্রয়োগে বাধা সৃষ্টিটাও রাজনৈতিকভাবে সরকারকে অপ্রস্তুত করতে করা হচ্ছে।

“মাঠপর্যায়ে তো চ্যালেঞ্জ আসবেই, কিছু সুবিধাবাদী লোকজন তো এটা করতেই চাইবে,” তারপরও ক্ষতির দিক বিবেচনায় আইনের প্রয়োগ করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহারে ২০১০ সালে আরেকটি আইন করা হয়। যদিও আইন প্রয়োগের অভাব এবং বিকল্প ব্যবস্থার সংকটে পলিথিনের ব্যবহার রোধ করা যায়নি।

তবে পলিথিন বন্ধের ব্যাপারে সরকারি তোড়জোড়ের কথা যতটা শোনা গেছে, বাস্তবে বাজারে বা যেসব স্থানে পলিথিন বিক্রি করা হয়, সেসব স্থানে অভিযান তেমন দেখা যাচ্ছে না। ফলে সুপারশপ গুলোয় পলিথিন ব্যবহার বন্ধ হলেও খোলা বাজারে এখনো প্রকাশ্যেই পলিথিন বিক্রি ও ব্যবহার হচ্ছে।

বিকল্প সংকট?
পলিথিন নিষিদ্ধের ব্যাপারে একটা প্রশ্ন অনেক সময়েই ঘুরে ফিরে আসে, সেটি হচ্ছে এর বিকল্প কী?

নভেম্বর মাসেই যখন বাজারে পলিথিন নিষিদ্ধ থাকার কথা, তখনও দেদারসে পলিথিনের ব্যবহার দেখা গেছে। যারা ক্রেতা তাদের বড় অংশই সরকারের পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও সহজলভ্য কোনও বিকল্প না থাকার কথা উল্লেখ করেন। বিক্রেতারাও জানান বিকল্পের ঘাটতির কথা।

“মাংসটা, মাছটা, পলি ছাড়া ক্যামনে নিবো? পলিথিন কোম্পানি বন্ধ করে দেক, আমরা পাইতাম না, শেষ! কাস্টমার ব্যাগ নিয়া আসবে, আমরা দিবো” বলছিলেন বনানী কাঁচাবাজারের মাংস ব্যবসায়ী দ্বীন মোহাম্মদ।

তিনি বলছিলেন “পলিথিন নিষিদ্ধ হওয়া উচিৎ, কিন্তু তার পাশাপাশি বিকল্পও আনা দরকার। বিকল্প বাজারে না এনেই যদি পলিথিন আমরা বন্ধ করে দেই তাহলেও সমস্যা” বলছিলেন বাজার করতে আসা গোলাম মহীউদ্দীন।

উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এক্ষেত্রে উল্লেখ করেন, ১৯৯৫-৯৬ সালের আগে পলিথিন না থাকার কথা। সেসময় বাড়ি থেকে চট বা পাটের ব্যাগ নিয়ে মানুষ বাজারে যেতেন যেটা ধুয়ে পুনরায় ব্যবহার করা হতো।

সমস্যা হচ্ছে এতটা কম খরচে সহজ বিকল্প এখনও নেই। মাঝে পাট থেকে তৈরি সোনালী ব্যাগ নিয়ে আশার জায়গা তৈরি হলেও, বাজারে সেসব ব্যাগ কখনও সেভাবে দেখা যায়নি।

তবে ২০০২ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যখন কড়াকড়ি ছিল তখন বিকল্প উপায়েই বহন করা হতো। তখন মাছ-মাংস থেকে পানি ঝরিয়ে কাগজে বা পাতায় মুড়ে এরপর প্যাকেটে বা ব্যাগে দেয়া হতো বলে উল্লেখ করেন শাহরিয়ার হোসেন।

আগেকার দিনগুলিতেও বাঁশের বা বেতের ঝুড়িতে কলাপাতা দিয়ে বহন করার কথা মনে করিয়ে দেন তিনি।

“চাহিদা যখন তৈরি হবে তখন এগুলো চলে আসবে। আমরা যদি চাহিদা তৈরি না করেই বলি বিকল্প নেই সেটা ঠিক হবে না”, বলেন তিনি।

স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি এবং চ্যালেঞ্জ
যে কোনও ধরনের প্লাস্টিক পণ্য পরিবেশে মিশে যায় না বলে পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্যে সমস্যা তৈরি করে। পরিবেশে মিশে না গেলেও প্লাস্টিকের কণা পরিবেশে ঠিকই ছড়িয়ে যায় যেগুলো খাদ্যের সাথে মিশে একরকম বিষাক্ত পরিস্থিতি তৈরি করে।

এসডোর গবেষণা অনুযায়ী খাবার, পানি ও বাতাস, প্রায় সবদিকেই প্লাস্টিকের কণা ছড়িয়ে পড়ে মানবদেহের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে। দূরবর্তী পর্যায়ে বিবেচনা করলে চিকিৎসা বা ওষুধপত্রের খরচটাও কম হয় না যেটা হয়তো বিবেচনা করা হয় না।

বেশি মাত্রায় প্লাস্টিক থেকে নিঃসৃত রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসলে মেদ, হাঁপানি, হৃদরোগ, পাকস্থলি, ফুসফুস অথবা দৃষ্টিশক্তি সমস্যা, চর্মরোগ, আরও নানাবিধ রোগের কারণ হয় বলে উল্লেখ করা হয় এসডোর প্রতিবেদনে।

সেখানে বলা হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রভাবে ঢাকায় ঔষধ ও চিকিৎসাবাবদ মাসে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়।

প্লাস্টিক পণ্যে সেসব রাসায়নিক উপাদান ভরপূর থাকে এবং ক্রমাগত সেসব বিষাক্ততার সংস্পর্শ মানুষের জন্য দূরবর্তী এমন প্রভাব তৈরি করতে পারে।

এছাড়া মাটির সাথে সাথে মাছ-মাংস, এমনকি খাবার পানিতেও প্লাস্টিকের কণার দূষণ দেখা যাচ্ছে যেটা সরাসরি মানুষের দেহে প্রবেশ করে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে বলে উল্লেখ করছেন ড. হোসেন।

এর বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পলিথিনের কারণে পানি জমে যাওয়ার মতো সমস্যা সৃষ্টি করছে যা থেকে মশার বিস্তার এবং ডেঙ্গুর মতো রোগের কারণ হচ্ছে বলে জানান তিনি।

তবে বাজারের পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করতে গিয়েই অনেকটা বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে সরকারকে।

সেক্ষেত্রে “মানুষের অভ্যাস এবং কোনও আইনই প্রয়োগ করা যাবে না এমন সংস্কৃতি” এগুলো চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে বলে উল্লেখ করেন রিজওয়ানা হাসান।

প্রায় ১৮ বছরে নজরদারির ঘাটতিতেই এত সংখ্যক মানুষ এগুলো উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত হতে পেরেছে এবং মানুষও সহজলভ্য হিসেবে ব্যবহার করে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি।

অথচ কিছু ক্ষেত্রে বাজারের ব্যাগ পুনরায় ব্যবহার সম্ভব হলেও এমন অনেক কিছুই আছে যেগুলো একবারের বেশি ব্যবহার সম্ভব না। খাদ্যপণ্য ছাড়াও প্লাস্টিকের মোড়ক এখন প্রায় বেশির ভাগ সামগ্রির সাথে জড়িয়ে থাকে।

চিপস বা মিনিপ্যাক পণ্যের মতো প্লাস্টিকও পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলে। বাজারের দোকানীরাও সেগুলোর উদাহরণ দেন যে সেগুলো বন্ধ করা হয় না কেন।

কিছু কিছু একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিরুৎসাহিত করতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন মিস হাসান। ধাপে ধাপে বিভিন্ন পরিসরে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক নিরুৎসাহিত করার কর্মপরিকল্পনা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

যদিও চিপসের প্যাকেট বা মিনিপ্যাক পণ্যের ক্ষেত্রে বিষয়টা “একটু কষ্টের কাজ যেহেতু এখানে কোনও নিষেধাজ্ঞা বা এটা থেকে বের হয়ে আসার কোনও পরিকল্পনা বাংলাদেশ সরকার দেয়নি,” বলছেন তিনি।

এছাড়া বাংলাদেশে রিসাইক্লিং বা পুনরায় ব্যবহারের সুবিধা না থাকায় এর বদলে ডিজাইন পরিবর্তন করার মতো উদ্যোগ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সাথে সমন্বয় করে সামনে আসতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।