যশোরের ঐতিহ্যবাহী খেজুর রস, গুড়
নিজস্ব প্রতিবেদক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১১:৪৬ এএম, ১৮ নভেম্বর ২০২৪ সোমবার
সংগৃহীত ছবি
আশ্বিনের শেষের দিকে খেজুরগাছকে প্রস্তুত করতে হয় আহরণের জন্যে। গাছের বাকল কেটে 'গাছ তোলা' হয়। গাছ তোলা শেষে গাছ কাটার পালা। কোমরে মোটা দড়ি বেঁধে ধারালো গাছিদা দিয়ে সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে গাছ কেটে রস আহরণ করা হয়। এ অঞ্চলের মানুষ রস ও গুড় দিয়ে তৈরি করেন নানা ধরনের পিঠা। বানানো হয় নানা ধরনের পাটালি। আকৃতি, রং ও স্বাদে থাকে ভিন্নতা। এখানকার মানুষ নারিকেলের পাটালি বিশেষ পছন্দ করে। এই পাটালি পাঠানো হয় তাদের স্বজন-আত্মীয়-পরিজনকে। আর এই বিশেষ ধরনের পাটালি কেবল এখানকার কারিগররাই বানাতে পারেন। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বাইরে এই পাটালির আবরণ থাকে শক্ত। কিন্তু ভেতরটা গলে যাওয়া মোমের মতো।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের মতে, এই অঞ্চলের মাটি সাধারণত বেলে দো-আঁশ। আর পানিতে লবণাক্ততা নেই। ফলে গাছের শিকড় অনেক নিচে পর্যন্ত যেতে পারে। সব মিলিয়ে জলবায়ু উপযোগী যশোরের খাজুরা, বাঘাপাড়া, চৌগাছা, মাগুরার শালিখার খেজুরের রস সুগন্ধি ও সুস্বাদু হয়ে থাকে।
১৭৫৭ সালে ইংরেজরা বাংলার ক্ষমতা দখলের পর দলে দলে সাহেব বিলেত থেকে এ দেশে আসতে থাকে। মি. বালকে নামে এক সাহেব চিনি তৈরির ব্যবসায়ে নামেন। তিনি বর্ধমান জেলার (বর্তমানে ভারত) ধোবাতে একটি বড় ধরনের চিনি কারখানা স্থাপন করেন। যশোর থেকে খেজুরের গুড় নিয়ে চিনি তৈরি শুরু করেন। খরচ বেশি পড়ায় তিনি ধোবাও সুগার কোম্পানি গঠন করে কোটচাঁদপুর ও ত্রিমোহনীতে দুটি বড় চিনি ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন। ১৮৮২ সাল পর্যন্ত মি. বাকলে সাহেবের কারখানা দুটো ভালো চলে। এরপর লোকসানের পালা শুরু হয়।
এক ইংরেজ সাহেব কোটচাঁদপুর ফ্যাক্টরি কিনে নেন। পরে সেইনটস ব্যারি নামে আরেক সাহেব ত্রিমোহনী ফ্যাক্টরি কিনে নেন। যশোর ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারে বর্ণিত তথ্যে জানা যায়, ১৮৪২ সালে কলকাতায় বসবাসরত সাহেবগণ গ্যাডস্টোন অ্যান্ড কোম্পানি গঠন করে চিনি ব্যবসায়ে নামেন। তারা চৌগাছাতে একটি বড় চিনি ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন। এ ফ্যাক্টরির ম্যানেজার ছিলেন মি. স্মিথ নামে এক বিলেতি। পরে ম্যাকলিউড নামে আরেক সাহেব ম্যানেজার হন। ম্যাকলিউড পরিবারের অনেক স্মৃতি এখনো কোটচাঁদপুরে আছে। কোটচাঁদপুর ছাড়াও ঝিকরগাছা, ত্রিমোহনী, চৌগাছা, নারকেলবাড়িয়াতে এ কোম্পানির আরো চিনি ফ্যাক্টরি ছিল। তিন-চার বছর এসব ফ্যাক্টরি ভালো চলে। পরে লোকসান শুরু হতে থাকে। ১৮৫০ সালের পরও কোটচাঁদপুর ও চৌগাছার ফ্যাক্টরি দুটো চালু ছিল। ১৮৫৩ সালে মি. নিউ হাউজ তাহেরপুরে একটি বড় আকারের ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন। তিন- চার বছর চলার পর লোকসান শুরু হয়। পরে চিনি তৈরি বন্ধ করে এ কারখানাতে 'রাম' মদ তৈরি হতো।
মি. এলএসএস ওম্যালি কর্তৃক প্রকাশিত যশোর ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, সাহেবদের চেয়ে দেশীয় ময়রাদের কারখানায় উৎপাদিত চিনির মান ভালো থাকায় চাহিদাও বেশি ছিল। আখ থেকে উৎপাদিত সাদা চিনির আমদানি শুরু হলে খেজুর গুড় হতে তৈরি চিনি শিল্পে বিপর্যয় ঘটে। ১৮৯০-এর পর যশোর অঞ্চলে গড়ে উঠা দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি চিনি বাজার হারায়। যশোর জেলাতে গড়ে উঠা চিনি ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ হতে থাকে। একমাত্র কোটচাঁদপুর ও আশপাশের এলাকাতে ছোট-বড় প্রায় ৫০০ চিনি ফ্যাক্টরি ছিল। তবে ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারে চিনির উৎপাদন সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য আছে। ১৮৭৪ সালে কোটচাঁদপুরের ৬৩টি ফ্যাক্টরিতে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৭৫ মণ চিনি উৎপাদন হয়েছিল বলে উল্লেখ আছে। এ চিনি তৈরিতে এক ধরনের শেওলা ব্যবহার করা হতো। কপোতাক্ষ নদে প্রচুর পাটা শেওলা মিলত। গুড়ের ভাড় ভেঙে অন্ধকার ফ্যাক্টরির ভেতর ঝুড়িতে রাখা হতো। ঝুড়ির ওপর শেওলা বিছিয়ে দেওয়া হতো। রস ঝরে পড়ে চিনি হতো। রোদে শুকিয়ে বস্তা ভর্তি করে চালান পাঠানো হতো বিভিন্ন স্থানে। প্রথম বারে উৎপাদিত চিনির মান ভালো হতো। বলা হতো নালুয়া চিনি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চিনির ব্যবসা শুরু করেছিল। ১৭৭৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতা বন্দর দিয়ে ১ হাজার ৯০০ টন চিনি রপ্তানি করেছিল। ১৯২৪ সালে আরো কমে ৫০টিতে নেমে এসেছিল। ১৯৫০ সালেও কয়েকটি কালের সাক্ষী হিসেবে টিকে ছিল। পরে এগুলো কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
খান বাহাদুর এম এ মোমেন ফাইনাল রিপোর্ট অন দি সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট অব যশোর বইতে লিখেছেন, ১৯০৮ সালের দিকে যশোর অঞ্চলে ৬০ লাখ খেজুরগাছ ছিল। এ গাছ থেকে ২৫ লাখ মণ গুড় তৈরি হতো। অবশ্য এ সময়ে খেজুর থেকে চিনি তৈরি প্রায় উঠে গিয়েছিল।
বড়ই আপসোস, পরিতাপের বিষয় আশঙ্কার কথা হচ্ছে, দিনদিন খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বৃক্ষ নিধনকারীদের নজর পড়েছে বেশ কিছুকাল আগে থেকেই। তারা উচ্চ মূল্য দিয়ে ইটভাটার জন্য খেজুরগাছ কিনছে। অন্যান্য অর্থকরী ফসলের চাষাবাদের দরুন খেজুরগাছের ওপর মানুষের নির্ভরতা কমে গেছে। পরিকল্পিতভাবে খেজুরগাছ লাগানোর কোনো উদ্যোগও নেই। তবুও গাছিরা আছেন। ধারালো দা- এর কোপে বৃক্ষের বুক বিদীর্ণ করে বের করে আনেন মিঠা রস। এখনো 'গাঁও-গেরামের' অভাবী সংসারও রস, গুড়, পিঠা- পায়েসের ম-ম গন্ধে ভরে যায়।