দুবলার চরের নিউমার্কেট, শুঁটকি, রাসমেলা ও প্রকৃতি
আইরীন নিয়াজী মান্না
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১২:২৮ এএম, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ রবিবার
দুবলার চরে সূর্যাস্ত। ছবি: লেখক।
আজ থেকে ঠিক বিশ বছর আগে আমি অ্যাসাইনমেন্ট করতে দুবলার চরে যাই। সেই ২০০৪ সালের কথা! পূর্ণিমা রাতে রাসমেলার নিউজ কাভার করতে গিয়েছিলাম। এত বছর পর সুন্দরবন ভ্রমণে যাবো আর দুবলার চর যাবো না তা তো হতেই পারে না। সেই বিশ বছর আগে দুবলার চরের অপরূপ প্রকৃতি দেখে যেভাবে মুগ্ধ হয়েছিলাম এত বছর পর ঠিক তাই হলো!
দুবলার চর সুন্দরবনের একটি দ্বীপ। এটি সকলের কাছে চর নামে পরিচিত। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের শেষ সীমায় বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা এই চরে গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় শুটকি পল্লী।
কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে এটি একটি বিচ্ছিন্ন চর। এই চরের মোট আয়তন ৮১ বর্গমাইল। আলোরকোল, হলদিখালি, কবরখালি, মাঝেরকিল্লা, অফিসকিল্লা, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয় এবং মেহের আলির চর নিয়ে দুবলার চর গঠিত।
সুন্দরবনের দক্ষিণ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত দুবলার চর মূলত জেলে গ্রাম। বাংলাদেশে শুঁটকি উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত এই চর। বন বিভাগের পক্ষ থেকে জেলেরা প্রতি বছর অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত অর্থাৎ ছয় মাস এখানে ব্যবসার অনুমতি পান। এই চরে কাজ করেন ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ। জেলেদের মাছ ধরার সঙ্গে চলে শুঁটকি শুকানোর কাজ।
বর্ষা মৌসুমের ইলিশ শিকারের পর বহু জেলে ছয় মাসের জন্য সুদূর কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা থেকে এসে ডেরা বেঁধে সাময়িক বসতি গড়ে তোলে দুবলার চরে। এই ছয় মাস তারা মাছকে শুঁটকি বানাতে ব্যস্ত থাকেন।
এখান থেকে সংগ্রহ করা শুঁটকি চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জের পাইকারী বাজারে মজুদ ও বিক্রয় করা হয়। তারপর যেখান থেকে সারা দেশের বাজারে চলে যায় এসব শুঁটকি।
শুঁটকি প্রক্রিয়ার জন্য লইট্টা, তেলফ্যাসা, ছুরি, চাকা চিংড়ি, বৈরাগী এবং রূপচাঁদার মতো মাছ শুকানো হয়। শিকারের পর মাছগুলো বাছাই করে শুকাতে দেওয়া হয়, যা প্রস্তুত হতে তিন থেকে পাঁচ দিন সময় লাগে।
এই শুঁটকি শিল্প স্থানীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। শুটকি উৎপাদন এবং সরবরাহ প্রক্রিয়া থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুঁটকি উৎপাদন হয়েছে ৫,১০০ টন এবং রাজস্ব এসেছে ৬.৬৮ কোটি টাকা।
চরের আলোরকোলের পূর্ব দিকে গড়ে উঠেছে বাজার। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ অন্যান্য এলাকার মানুষ দোকান দিয়েছেন ওই বাজারে। এখানে আছে সেলুন, লেদ মেশিন, খাবারের হোটেল, কসমেটিকস, মুদি ও কাপড়ের দোকান। আছে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকানও। তবে এখানে টেলিটক ছাড়া অন্য কোনো ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না।
জেলেরা এই বাজারের নাম দিয়েছেন 'নিউমার্কেট'। এসব দোকান থেকে ছয় মাসের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটান জেলেরা।
চরটিতে আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। ছয় মাসের জন্য আসা মানুষগুলোর চিকিৎসা হয় না। চরের নিউমার্কেট এলাকায় কয়েকটি ওষুধের দোকান আছে। দোকানদাররা অসুস্থতার ধরন শুনে জেলেদের চিকিৎসা দেন।
এই চরে খাবার পানির তীব্র সংকট কাটাতে কয়েকটি পাতকুয়া করা হয়েছে। বর্ষায় সেখানে পানি জমে। ওই পানি জীবাণুমুক্ত নয়। তবুও ওই পানিই ভরসা পল্লীবাসীদের।
সাগরের যে কোনো ঝড় সবার আগে আঘাত হানে দুবলার চরে। এ কারণে দুবলার চরে কাজ করা অধিকাংশ মানুষের দাবি—সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্র। এখানে কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র ছিল, কিন্তু বর্তমানে সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী।
প্রতি বছর কার্ত্তিক মাসে (নভেম্বর মাস) হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাসমেলা বা বাসপূজা এবং পূণ্যস্নানের জন্য দ্বীপটি বিখ্যাত। প্রতিবছর আলোরকোলে আয়োজন করা হয় এসব। যদিও বলা হয়ে থাকে, ২০০ বছর ধরে এ রাসমেলা হচ্ছে এ চরে, তবে জানা গেছে, ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে হরিচাঁদ ঠাকুরের এক বনবাসী ভক্ত, নাম হরিভজন (১৮২৯—১৯২৩), এই মেলা চালু করেন।
প্রতিবছর অসংখ্য পুণ্যার্থী রাসপূর্ণিমাকে উপলক্ষ করে এখানে সমুদ্রস্নান করতে আসেন। দুবলার চরে সূর্যোদয় দেখে ভক্তরা সমুদ্রের জলে ফল ভাসিয়ে দেন। কেউবা আবার বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ভজন-কীর্তন গেয়ে মুখরিত করে তোলেন চারপাশ।
দুবলার চরের রাসমেলায় স্থানীয় লোকজন ছাড়াও দূর-দূরান্তের শহরবাসী এমনকি বিদেশি পর্যটকেরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়ে থাকেন। তিনদিনব্যাপী এ মেলায় অনেক বিদেশী পর্যটকেরও সমাগম হয়। পূজা উপলক্ষে এখানে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ আসেন বলে জানা গেছে।
দুবলার চরে লাল বুক মাছরাঙা, মদনটাক পাখি, বকসহ নানা রকম পাখি দেখা যায়। পশুদের মধ্যে হরিণের দেখা মেলে।
দুবলার চরের জেলে পল্লীতে বনদস্যুদের উৎপাত, খাবার পানির অভাব, স্বাস্থ্যসেবা সংকট, বাঘ ও কুমিরের আক্রমণ, নিম্ন মজুরি ইত্যাদি প্রায় প্রতি মৌসুমের নিয়মিত ঘটনা। এছাড়া বড়সড় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছাসে বিপর্যস্থ হয় দুবলার চরের জেলে পল্লী। সরকারের উচিত পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে এই চরের সার্বিক জীবনমানের উন্নয়ন করা।