সৌদি নারীদের ইন্টারনেট রেডিও
বিবিসি বাংলা অনলাইন
উইমেননিউজ২৪.কম
প্রকাশিত : ০৯:৪৯ পিএম, ২২ আগস্ট ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ০৩:৫৪ পিএম, ২৪ আগস্ট ২০১৮ শুক্রবার
সৌদি আরবে নারী অধিকারের পক্ষে কথা বলার জন্য ভিন্ন এক দেশ থেকে শুরু হয়েছে এক ইন্টারনেট রেডিও। নসাওয়া এফএম (ফেমিনিজম এফএম) নামের এই স্টেশনটিতে যখন পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে কথা হচ্ছিল তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছিল বিষন্ন সুর।
অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা কথা বলছিলেন সারা নামের এক নারীকে নিয়ে। তার গলা আবেগে কাঁপছিল। এক পুরুষ আত্মীয়ের হাতে খুন হয়েছিলেন সারা। সারা ছিলেন ৩৩ বছর বয়সী এক বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েট। চাকরি করতেন। থাকতেন বাবা-মার সঙ্গে। বিয়ে করতে চেয়েছিলেন এক ভিনদেশিকে। তার পছন্দের পুরুষটি ছিল ইয়েমেনের নাগরিক।
"কিন্ত সারার এই স্বপ্ন কেড়ে নিল পাঁচটি বুলেট, তার ওপর গুলি চালিয়েছিল তারই ২২ বছর বয়সী ভাই। অথচ বাবা-মার সম্মতি নিয়েই সারার সঙ্গে এই ইয়েমেনি লোকটির বাগদান হয়েছিল," বলছিলেন উপস্থাপিকা আস্তার। এটি আসলে তার ছদ্মনাম, যুদ্ধ এবং প্রেমের মেসোপটমিয়ান দেবির এই নামটিকেই তিনি বেছে নিয়েছেন ছদ্মনাম হিসেবে।
আস্তার টেলিফোনে তার নারীবাদী ইন্টারনেট রেডিও স্টেশন নিয়ে কথা বলছিলেন বিবিসির আরবী বিভাগে সঙ্গে। `সারাকে হত্যার এই ঘটনার খবর গণমাধ্যমে বেরিয়েছে। যারা তাকে চিনতেন, তারা এ নিয়ে কথাও বলেছেন," জানালের আস্তার।
হানান শাহারি নামে আরেক সৌদি নারীর কাহিনীও জানালেন তিনি। ২০১৩ সালে হানান আত্মহত্যা করেছিলেন। কারণ প্রেমিকের সঙ্গে তার বিয়েতে বাধা দিচ্ছিলেন তার ভাই এবং চাচা, তাকে মারধোরও করেছিলেন।
আস্তার বলছেন, সৌদি আরবে এরকম ঘটনা অনেক ঘটে, কিন্ত খুব কম ঘটনার কথাই জানা যায়। তিন সপ্তাহ আগে নসাওয়া এফএম একটি টুইটার একাউন্ট খুলে ঘোষণা করে যে তারা একটি সাপ্তাহিক রেডিও অনুষ্ঠান প্রচার করবে। এটি হবে সৌদি আরবের নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠদের কন্ঠস্বর।
এই রেডিও স্টেশনের জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে আগ্রহীদের যোগাযোগ করারও আহ্বান জানায় তারা। গত দু সপ্তাহে রেডিও স্টেশনটি থেকে দুটি এক ঘন্টার অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে। একটি মাইক্রোফোন, একটি ল্যাপটপ, এডিটিং সফ্টওয়্যার এবং স্ট্রীমিং ওয়েবসাইট মিক্সএলআর হচ্ছে তাদের সম্বল।
রেডিও স্টেশনটির শব্দের মান মোটেই ভালো নয়, অনুষ্ঠানের মানও সেরকম কিছু নয়। পুরো ব্যাপারটাতে অপেশাদারিত্বের ছাপ স্পষ্ট। তবে অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা আস্তার বলছেন, তারা শুরুতেই বিরাট সংখ্যাক শ্রোতা আকর্ষণ করতে পারবেন সেটা আশা করেন না। তবে নারী অধিকার নিয়ে তারা সচেতনতা সৃষ্টির যে চেষ্টা করছেন, তাতে ধীরে ধীরে শ্রোতার সংখ্যা বাড়বে বলে আশা করেন।
সৌদি কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়তে পারেন এমন আশংকায় আস্তার তার অবস্থান সম্পর্কে জানাতে রাজী হলেন না। যদিও তিনি সৌদি আরবের বাইরে থাকেন। তাদের রেডিও স্টেশনের এই শুরুর দিনগুলোর সবকিছু তারা আর্কাইভ করে রাখছেন। যাতে ভবিষ্যতে মানুষ জানতে পারে, তাদের বাস্তব অস্তিত্ব আছে, তারা কোন অলীক মানুষ নন।
"সৌদি কর্তৃপক্ষ যে কোন সময় টুইটার নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। তখন আমাদের সবকিছু কিন্তু হারিয়ে যাবে। সেজন্যেই আমরা রেডিও প্রোগ্রামকেই বেছে নিয়েছি। এখানে আমরা আমাদের সব চিন্তাভাবনা রেকর্ড করতে পারি, অন্য কোন প্লাটফর্ম থেকে আমরা এই অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারি।"
জাতিসংঘের হিসেবে, গত মে মাসের মাঝামাঝি হতে অন্তত ১৭ জন মানবাধিকার কর্মী এবং নারী অধিকার কর্মীকে সৌদি সরকার আটক করেছে।এদের অনেকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। বিদেশি এজেন্টদের সঙ্গে `সন্দেহজনক` যোগাযোগের অভিযোগও এর মধ্যে আছে। দোষী সাব্যস্ত হলে এই অভিযোগে তাদের বিশ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে।
নসাওয়া রেডিও স্টেশনে এই মূহুর্তে দুজন উপস্থাপিকা এবং নয়জন কর্মী আছে। দুজন বাদে এদের আর সবাই সৌদি নাগরিক। এদের কেউ কেউ সৌদি আরবেই থাকেন। যেহেতু তারা বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন টাইম জোনে থাকেন, তাই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা অনেক সময় বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়াও অনেকের পড়াশোনা, চাকুরিও সামাল দিতে হয়।
আস্তার নিজেকে একজন `অ্যাকটিভিস্ট` বলেই বর্ণনা করলেন। মিডিয়াকে ব্যবহার করে তিনি তার চিন্তাভাবনা ছড়িয়ে দিতে চান। সমাজ, ধর্ম এবং রাজনীতি সম্পর্কে আস্তার যে চিন্তাভাবনা করেন, তা প্রচলিত চিন্তার সঙ্গে বেশ সংঘাতপূর্ণ। তার এসব ভাবনা তিনি লিখে পাঠিয়েছিলেন কয়েকটি লেবাননী পত্রিকায় প্রকাশের জন্য। কিন্তু কেউ তা ছাপতে রাজী হয়নি।
প্রাক ইসলামিক আরবের যে মাতৃতান্ত্রিক যুগে বিভিন্ন উপজাতির নেতৃত্বে ছিল নারী, সেই যুগের প্রতি তার অনুরাগের কথা জানালেন আস্তার। "আমার বিশ্বাস মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যদি আবার নারী ক্ষমতায় ফিরে আসে, বিশেষ করে বিচার বিভাগের মতো ক্ষমতাধর জায়গায়, এই বিশ্ব অনেক বদলে যাবে।"
ঈদ উল ফিতর বা অন্য কোন উৎসবে যখন পরিবারের সবাই মিলিত হন, তখন আস্তার তার এসব ভাবনা নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যরা তার এসব ভাবনাকে মোটেই পাত্তা দেন না। "তারা বলেন পশ্চিমা দুনিয়া তোমার মগজ ধোলাই করেছে।"
সৌদি আরবে মেয়েদের গাড়ি চালানোর ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছেন বাদশাহ সালমান। এখন আস্তার এবং তার বন্ধুরা আন্দোলন করছেন মেয়েদের ওপর পুরুষদের `অভিভাবকগিরি ব্যবস্থা`র অবসান ঘটাতে।
সৌদি `পুরুষ অভিভাবকগিরি` ব্যবস্থায় নারীর পক্ষে সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন পরিবারের পুরুষ সদস্যরাই। আস্তার এবং তার বন্ধুরা মনে করেন এটি একটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা। তারা এর অবসান চান।