ঢাকা, রবিবার ২৪, নভেম্বর ২০২৪ ১১:০১:৩৩ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

আমার যত গ্লানি এবং #Me_too

পরাগ আরমান

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০১:৪২ পিএম, ২৩ নভেম্বর ২০১৮ শুক্রবার

‘যদি অপরাধ কর তবে এখনি সংশোধনের চেষ্টা কর, দেরী করো না। আর সংশোধিত হওয়ার জন্য লজ্জা পেয়ো না’- কনফুসিয়াস। পাপ বা গ্লানির ওজন যে এত ভারী তা #মি টু আন্দোলনের আগে বুঝিনি। বেশকিছু দিন ধরেই ভাবছিলাম, মানুষ হিসেবে আমার কি করণীয়। ভিতরে ভিতরে যন্ত্রণায় দগ্ধও হচ্ছিলাম। আর এই যন্ত্রণা শতগুণ বেড়ে গেল যখন মুশফিকা লাইজু শিমূলের সাহসী পদক্ষেপকে সবাই স্বাগত জানাতে গিয়ে ইনবক্সে আমাকেও ধন্যবাদ জানাতে লাগলো। অথচ আমি এর ছিটেফোঁটারও যোগ্য নই। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম জনতার আদালতে নিজেকে দাঁড় করাবার এবং গ্লানি মুক্ত হবার। 


মুশফিকা লাইজু-র ঐ নিপীড়নের ঘটনা, ও’র সাথে আলাপ হওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই (১৯৯৬ আমাদের প্রথম আলাপ) জানতে পেরেছিলাম, ওর মুখ থেকেই। আমি ছাড়া তৎকালীন আমাদের ঘনিষ্ট বন্ধুরা সকলেই মোটামুটি তার কষ্টের ব্যালাডটি (শোকগাঁথা) জানতো। সে যখন তার স্বপ্নভঙ্গের কথা বলতো তখন চোখের জল আড়াল করতে আকাশের দিকে তাকিয়ে কথা বলতো। লোকে যেমন বলে একজন নারীর বুকের ভেতর লুকানো থাকে হাজার নিযার্তনের (যৌন, মানসিক ও শারীরিক) ইতিহাস, তেমনি একজন পুরুষেরও ব্যাক পকেটে-বুক পকেটেও জমানো থাকে হাজারটা নির্যাতন করার গল্প। ব্যক্তিগতভাবে আমার একটি ফান্ডামেন্টল পরিবারে ও পরিবেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সেই প্রতিবেশ থেকেই শেখা, স্ত্রীকে ভালবাসতে হবে গতানুগতিক ধারায়। সমাজ নিধার্রিত দ্বায়িত্ব যেমন পালন করতে হবে তেমনি আমার/আমাদের কয়েকটি নিভৃত সভ্যতা বর্হিভূত লোভের জানালা থাকলেও থাকতে পারে। 


স্বীকার করতে বাধা নেই, তা আমারও ছিল। নিজেও ছিলাম যৌন নিপীড়কের ভূমিকায়। ১০ বার, ১২ বার অথবা তারও অধিক। যৌবনের শুরু থেকে জীবনের এক-তৃতীয়াংশ বয়স পর্যন্ত, যা ‘ও’ কখনো জানতে পারেনি। অথবা আমি খুব সুকৌশলে ও’কে জানতেও দিতাম না। শিমূল যখন মি টু আন্দোলনে যোগ দেবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, আমিও তখন মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম জীবনে যাদের সঙ্গে এ ধরণের অন্যায়-অসভ্যতা করেছি, তাদের কাছে যেয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করব, পারলে প্রকাশ্যে (ভিক্টিম যদি অনুমতি দেন)। অবশ্য শিমূলকে না জানিয়ে ইতোমধ্যেই তা শুরুও করেছি। 


আমি আমাকেই বলতে চাই, আমরা পুরুষেরা শৈশব থেকে শিখিই নি নারীর মনস্তাত্বিক গঠণ আসলে কেমন? তার চূড়ান্ত অসম্মান, আমার নিছক কয়েক মুহূর্তের নষ্ট-আনন্দ (কখনো গোপন কখনো প্রকাশ্য)। আসলে এটাই হয়তো একটা নারীর প্রতি হওয়া অবদমিত মনের জিঘাংসা। আর তার উৎপত্তি, একটা নষ্ট মস্তিষ্কপ্রসূত ধারণা থেকে। তাছাড়া আমি এ সমাজের পুরুষ প্রতিনিধি এবং পুরুষতন্ত্রের ধারক। আমার পেশীশক্তি আছে তাই এ বঞ্চনা তার/তাদের প্রাপ্য। সামান্য একটু স্পর্শে কি এমন ক্ষতি। নিজেকে নির্দোষ ভাবতে এমন নানা খোঁড়া আর সভ্যতা বর্হিভূত যুক্তিই এতোদিন লালন করেছি। আর এই অপযুক্তি, পাপকর্মকে হালাল করার জন্য ব্যবহার করেছি বহুবার। প্রতিবারই নিজেকে বুঝিয়েছি, আমার এই অসভ্যতায় শিমুলের তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। ও’কে তো আমি ভালোইবাসি। এ জীবনে কখনো হারাতে চাইওনা। 


কিন্তু আজ প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সে একজন মযার্দা সম্পন্ন যোদ্ধা নারী। সৌভাগ্যক্রমে সে আমার সহধর্মিনী। সে জীবনের যে গ্লানি ৩১ বছর ধরে বহণ করেছে তার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে আজ, বিশ্বজুড়ে চলমান #মি টু আন্দোলনের মাধম্যে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমার সকল পাপ স্বীকার করে গ্লানিমুক্ত হওয়ার। আমি করজোড়ে সকল কন্যা-ভগ্নি এবং বন্ধুদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি (সঙ্গত কারণেই কারো নাম উল্লেখ করছি না)। আশাকরি, আমার কৃত অপরাধের জন্য আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন। 


পরিশেষে, আমি আমার কন্যার জন্য যৌন হয়রানীমুক্ত একটি সুন্দর স্বাধীন পৃথিবী দেখে যেতে চাই।

৥ পরাগ আরমান, সিনিয়র সাংবাদিক