ঢাকা, রবিবার ২৪, নভেম্বর ২০২৪ ১০:২৭:৫৬ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

ও কেন একা পারে!

লাবণ্য লিপি

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৯:৫৯ পিএম, ১১ ডিসেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার

ছবি : সংগ্রহ করা

ছবি : সংগ্রহ করা

শিশুরা বড় হতে থাকে আর একটু একটু করে স্বাধীন-স্বাবলম্বী হতে থাকে। এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু শিশুটি যদি হয় কন্যাশিশু? তাহলে সে বড় হতে হতে পরাধীন হতে থাকে। তাকে গড়ে তোলা হয় মেয়ে হিসেবে; মানুষ নয়। সেই শৈশবেই তার মস্তিস্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তুমি মেয়ে এবং তুমি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছো। সেই সঙ্গে তার মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় অসংখ্য বিধি নিষেধ। তুমি একা স্কুল-কলেজে যেতে পারবে না, প্রাইভেট পড়তে যেতে পারবে না, বাজারে যেতে পারবে না, বেড়াতে যেতে পারবে নাসহ আরো অনেক ‘না ’ তার চলার পথে জুড়ে দেওয়া হয়। কেন? কারণ সময় খারাপ। বাইরে তুমি নিরাপদ নও! তুমি ঘরে থাকো। তোমার যা লাগবে আমরা এনে দিচ্ছি! তুমি যেখানে যেতে চাও নিয়ে যাচ্ছি। কাজেই আমি নিরাপদ নই, আমার একা চলা বারণ- এই মানসিকতা নিয়েই বেড়ে উঠতে থাকে কন্যাশিশুটি। এভাবেই এক সময় সে শৈশব- কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে প্রবেশ করে; নারী হয়ে ওঠে। কিন্তু স্বাবলম্বী আর হয়ে ওঠে না। এই নারীদের অধিকাংশই ‘ আমার সব কাজ অন্যেরা করে দেবে’ ভরসাতেই জীবন- যাপণ করেন। কিন্তু একবারও ভাবেন না, কখনও এমন পরিস্থিতি আসতেই পারে, যখন নিজের সব কাজসহ সংসারের অন্য দায়িত্বও তাকে একাই পালন করতে হতে পারে। তখন কী হবে? অভিভাবকরাও এটা ভাবেন না। ভাবেন না বলেই তারা শুধু সমাজের কথা ভেবে, নিরাপত্তার কথা ভেবে নিজেদের অজান্তেই মেয়েটিকে একটু একটু করে পরনির্ভরশীল, পরগাছা করে তোলেন। 

আর যদি পরগাছা না হয়? যদি স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে, তাহলে? প্রথমে তার ওপর আরোপ করা হয় পারিবারিক শাসন, বকাঝকা, উপদেশ, প্রয়োজনে মারধোর। তারপর শুরু হয় সামাজিক কটাক্ষ। আপনি হয়তো আপনার মেয়েকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলেছেন, তাকে একা চলার স্বাধীনতা দিয়েছেন, তাকে মেয়ে নয়, মানুষ করে তুলতে চেয়েছেন। তাহলে আপনি খারাপ বাবা- মা। আপনার আত্মীয়- স্বজন, সহকর্মী, প্রতিবেশি এমন কি আপনার কন্যার বান্ধবীর বাবা-মাও আপনার সমালোচনা করবে, মেয়েকে শুধরে নেওয়ার অযাচিত পরামর্শ দেবে। আপনি তাদের কথায় কান না দিলেও সমালোচনা। এত সব আলোচনা সমালোচনাকে উপেক্ষা করে, সব বাধা উৎরে যখন একজন নারী স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে তখন প্রথমে কটাক্ষ করে তার পরিবারের সদস্যরা। যে মেয়েটি স্বামীর ঘর থেকে বাবার বাড়িতে ফিরে আসে তার জীবন তো দুর্বিসহ। বিয়ের আগে যে মেয়েটি ছিল বাবা, মা, ভাই বোনের প্রিয়তম। সেই মেয়েটিই কেমন অবাঞ্চিত হয়ে যায় তার অতি আপনজনদের কাছে। সে খেলে দোষ, না খেলেও দোষ। চাকরি করলেও দোষ। তুমি সেজেগুজে অফিস যাবে আর এদিকে তোমার জন্য খাবার রেডি করে রাখবে কে! তোমার সন্তানের দেখাশোনা কে করবে? আবার তুমি বসেও খেতে পারবে না। কারণ আর কতকাল তোমাকে পুষবো! 

তাহলে একা নারী কী করবে? সহজ সমাধান হচ্ছে বাঁচার জন্য তাকে একাই সব পারতে হবে। কিন্তু পারলেও যে দোষ! কারণ একটি মেয়ে কিংবা একজন নারী নিজের সব কাজ করতে পারুক, এটা কেউ চায় না। না পরিবার, না সমাজ। কারণ এই সমাজ একজন নারীর একলা স্বাধীনভাবে চলা সহজে মেনে নিতে পারে না। কোনও কারণে একজন নারী যখন একা হয়ে যান মানে বিধবা কিংবা ডিভোর্সী তখন সংসারের সব দায়িত্ব তুলে নিতে হয় তার একার কাধে। ধরে নিলাম তার সন্তানও আছে।  তখন সন্তান লালন-পালন, সংসার চালানোর জন্য অর্থের যোগান দেওয়াসহ দৈনন্দিন সব কাজই তাকে একা করতে হয়। আর সেটা যদি সে ঠিকঠাক মতো করতে পারে, তাহলেও শুরু হয় পুরুষের গাত্রদাহ। পুরুষ নিকটাত্মীয়রা সব সময়ই আশা করেন ঐ একা নারী তাদের কাছে আসবেন, অর্থ সাহায্য চাইবেন, এটা করে দাও, ওটা করে দাও বলে বায়না ধরবে। তা না, মেয়েটা একা কেমন তেজের সঙ্গে সব করে যাচ্ছে। চাকরি করছে, বাজার করছে, সন্তানের দেখাশোনা করছে। ছেলে ভালো স্কুলে পড়ছে। কোনও কিছুতেই আমাদের সাহায্য লাগছে না! তখন ঐ মেয়েটির প্রতি মনের মধ্যে তৈরি হয় এক ধরণের বিদ্বেষ। মনে মনে খুঁজতে থাকে তার দোষ। কখনও আড়ালে আবডালে বদনাম করতে থাকবে। কখনও বা সরাসরিই বলে বসবে, যখন তখন বাজারে যচ্ছো, এটা কেমন দেখায়! কিছু লাগলে আমাদের তো বলতে পারো! কেন? কারণ কোনও কাজ করে দিয়ে মেয়েটির দুর্বল অবস্থার সুযোগ নেওয়া যাবে বলে! সব সময় মেয়েটিকেই কেন সব সামলে মাথা নিচু করে অথর্বের মতো চলতে বলেন! অথচ প্রয়োজন সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন। মেয়েটিকে অসুস্থ সমাজের উপযোগী নয় বরং সমাজটাকেই একজন নারীর বাসযোগ্য করে তোলা বেশি জরুরি। 

৥ লাবণ্য লিপি, লেখক ও সাংবাদিক।