ঢাকা, রবিবার ২৪, নভেম্বর ২০২৪ ৭:১৯:৫০ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

ডা. আলীমদের আদর্শ-স্বপ্নের মৃত্যু হয় না: শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী 

শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী 

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০১:২৯ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮ রবিবার

ছবি : সংগ্রহ করা

ছবি : সংগ্রহ করা

১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে গত ৪৭ বছর, যখনই সুযোগ হয় মুক্তযুদ্ধ-বিজয় আর শহীদ ডা. আলীম চৌধুরীর কথা বলি। মনে হয় এতো স্মৃতিচারণ নয়, এসব ঘটনা আমার কাছে সবসময় জ্বলজ্বল করা নির্মম সত্যি, কষ্টেরও। এ স্মৃতি কখনোই ধূসর হয় না, ভোলারও নয়! ডা. আলীম তো দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। দেশের জন্য তাঁর আত্মত্যাগ আমার ও আমার দুই মেয়ে নীপা ও সম্পার জন্য যেমন অনন্ত শোকের, তেমনি গর্বেরও। 

ডা. আলীম চৌধুরীর সাথে বিয়ের পর থেকে বুঝতে পেরেছি, ব্যক্তি আলীম তাঁর পেশা ও পরিবারকে যতটা ভালোবাসেন তার চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসা দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তিনি নীরবে হৃদয়ে ধারণ করেন। যা ক্রমেই সঞ্চারিত হয়েছে আমার মধ্যে। আর এটাই তিনি চেয়েছেন। 

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি একদিনের জন্যও তাঁর হাসপাতালে যাওয়া বা রোগী দেখা বন্ধ করেননি। বন্ধু ও আত্মীয় স্বজনকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে সাহায্য করা, ক্লিনিকে গোপনে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, হাসপাতালে ডিউটি শেষে বিভিন্ন জায়গা থেকে ওষুধ যোগাড় করে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পাঠানো-সব করতেন নিয়মিত, এর কিছু জানতাম, অনেকটাই পরে জেনেছি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর, রাজাকারদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। তার মূল্য দিতে হয়েছে নিজের জীবন দিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবা মৃত্যুশয্যায়, আমার দুই ভাই মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে। বাসায় মা আর বোন দীপা বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও উলের জাম্পার বানিয়ে দিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। উদয়ন স্কুলে আমার সহকর্মী শিক্ষিকা এডলিন মালাকারের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে জাম্পারসহ যখন যা পেরেছি পাঠিয়েছি, একদিন এসব কথা ডা. আলীমকে জানালাম, শুনে বললেন, এসব কথা আমাকে বলার দরকার নেই, ‘কাউকে কিছু দিলে বলতে হয় না, ডান হাত দিলে বা হাত জানবে কেন।’ সেদিন অনেক বড় শিক্ষা পেয়েছিলাম, সেইসাথে নতুন করে যেন দেশপ্রেমের দীক্ষা পেলাম। এভাবে তিনি ভয়ংকর দিনগুলোতে আমাকে সাহস সঞ্চার করেছেন প্রতিনিয়ত যা পথ চলতে সাহায্য করে আজও।    

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ঢাকায় কারফিউ চলতো। কিছু সময়ের জন্য কারফিউ উঠিয়ে দিলেও খুব কম মানুষই বের হতো বাইরে। সারা শহরজুড়ে পাক বাহিনী ঘুরছে, ভয় পেতাম এই বুঝি তাকে ধরে নিয়ে যায়। হাসপাতাল থেকে প্রায়ই দেরি করে ফিরতেন তিনি। খুব চিন্তা হতো, তখন বলতেন ডাক্তারদের ওরা মারবে না। অকুতোভয় ছিলেন। কর্তব্যে অবিচল থেকেছেন আমৃত্যু। নিজের বিপদের কথা একবারও ভাবেননি। সেসময় গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তো কাজ করতেন আবার বিপদে পড়া সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করতে দুইবার ভাবেননি।  

নিজের বিপদের কথা চিন্তা না করেই প্রতিবেশী মতিন সাহেবের অনুরোধে অচেনা আব্দুল মান্নানকে পরিবারসহ বাসার নিচের তলায় ক্লিনিকে থাকতে দিলেন। কিছুদিন পরেই তার আসল পরিচয় (আলবদর কমান্ডার আব্দুল মান্নান) পেলেও তাকে বাসা থেকে বের করা সম্ভব হয়নি। আমার প্রথম থেকেই মান্নানকে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে আপত্তি ছিল, যে আশঙ্কা ছিল, তা সত্যি হলো। শিয়রে মহা বিপদ জেনে সতর্ক হলাম কিন্তু ডা. আলীমের অগাধ বিশ্বাস  ‘দেশ স্বাধীন হবেই, আলবদর রাজাকাররা কিছুই করতে পারবে না।’  

নভেম্বর মাসটা খুব উত্তেজনায় কেটেছে আমাদের। ডিসেম্বর মাস, মুক্তিযোদ্ধারা সফল হচ্ছে, চারদিক থেকে নানা খবর পাই, মৃত্যুর খবরও পাই। তবে আশার আলোও দেখি। দু’জনই আলোচনা করি, খবর শুনি আর বলি, আমরা বেঁচে না থাকলেও দেশ যেন স্বাধীন হয়। ছোট ছোট দুই মেয়ের জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠে। গেরিলা বাহিনী, মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাছে পাক সেনাদের তখন হেরে যাওয়ার খবর আসছে। 

‘পাক বাহিনীকে সাহায্য করতে আমেরিকা সপ্তম নৌবহর পাঠাচ্ছে। তা কয়েকদিনে মধ্যেই পৌছবে চট্টগ্রামে’- রাজাকার মান্নানের এমন কথা শুনে তিনি ঘরে ফিরে এসে হেসে দিয়ে বলেন, দু’দিন পরেই দেশ স্বাধীন হওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে। এসব বলে কোনো লাভ হবে না। 

তবে ভাবতে পারেননি যাকে বিপদে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন সেই মান্নানই তাঁকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবে।       

যদিও এসব নির্মম ঘটনার বছর পেরিয়ে গেছে অনেক তারপরও সেই দিনগুলোর কথা মনে করাতে চাই সবাইকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে।  

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই দেশ স্বাধীন হওয়ার আশাটা জোরালো হতে থাকে। তখনও ডা. আলীমকে অনেকেই পরিবার নিয়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়ার জন্য বারবার বলেছে। আমিও তাগাদা দিতাম। কিন্তু যাই যাই করেও হয়ে উঠেনি। ১৫ ডিসেম্বর হাসপাতালে যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘আজই আমরা নিরাপদ জায়গায় চলে যাব’, ফিরলেন দুপুরের পর। নিরাপদ জায়গা পাননি বলে যাওয়া হলো না। হাসপাতালে পরিবার নিয়ে থাকার অনুমতি দেয়নি বলে তাঁর মনটা খারাপ ছিল। সেদিন আমাদের একদিকে শঙ্কা, অন্যদিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার আশায় অস্থির ছিলাম। আমাদের রেখে একা যেতেও চাইলেন না। 

হঠাৎ কাঁদা মাখা একটা গাড়ি আমাদের গেইটে এসে থামে, তখন তিনি দোতলার বারান্দায় বসা। জিপ থেকে কয়েকজন লোক নেমে ঢুকে যায় মান্নানের বাড়িতে। বিশ থেকে ২৫ মিনিট পর বের হয়ে আসে তারা। কিছুক্ষণ পরেই বের হয়ে সোজা আমাদের দরজায় এসে জোরে জোরে করাঘাত করতে থাকে ও দরজা খুলে দিতে বলে। তারা ডা. আলীমকে সাথে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। এ অবস্থায় তিনি নিচতলায় থাকা মান্নানকে ডাকলেন। কিন্তু মান্নান তার ছাত্রদের সাথে ডা. আলীমকে যেতে বললো। সে আরো বললো, ‘যান কিছু হবে না, আমি আছি’। এরপর মান্নানকে কত যে অনুরোধ করেছি, তাঁকে কোথায় নিয়ে হলো, কেমন আছে, শীতের কাপড় দেওয়ার জন্য একটু সাহায্য করতে। কিন্তু তখন মান্নান ডাহা মিথ্যে কথ বলেছে, এমনকি দেখা করানোর মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আমাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছে। শ্বাশুড়ী মায়ের অনুমতি পাইনি আর ছোট ছোট দুই সন্তানের মুখ চেয়ে সেদিন ঘরের বাইরে যাইনি। অস্থির আর নির্ঘুম কী এক অসহনীয় যন্ত্রনার রাত পার করেছি তা বলে বোঝানোর নয়।  

১৬ ডিসেম্বর সকালে জয় বাংলার স্লোগানে সম্বিত ফিরে পেলাম। চারদিক থেকে বিজয় মিছিল আসছে ঢাকায়, রাস্তায় অসংখ্য মানুষ। বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। আশায় থাকলাম দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। ওরা আর কাউকে মারতে পারবে না। নিশ্চয়ই ও ফিরে আসবে। 

কথা ছিল দু’জন মিলে স্বাধীন বাংলাদেশে বাড়ির পতাকা উড়াবো, বিজয় মিছিলে যাবো। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে বিজয় মিছিলে কত যে খুঁজেছি, পাইনি। বেলা বাড়ে, দুপুর গড়ায় কিন্তু ও আর ফেরেনি। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বাসায় দৌঁড়ে এসে বলছে, ‘কোথায় ঐ রাজাকার আলবদর মান্নান, যে আলীম ভাইকে মেরে ফেলেছে’। একবার বলার পর আমি আবার  জানতে চাইলে তারা বলে,‘আলীম ভাইকে যেখান থেকে পারি আমরা খুঁজে আনবোই’। 

১৭ তারিখেও তাঁর খোঁজ মেলেনি। ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বদ্ধভূমিতে খোঁজ মিলেছে শুনে দেখার জন্য পাগলের মতো হয়ে পড়ি। স্বজন মোমিন, ডা. আলীমের ভাই হাফিজ ও তার বন্ধুরা সাদা চাদরে জড়িয়ে যে আলীম চৌধুরীকে বাসায় আনলো, তা আমার না দেখাই ভাল ছিল। ঘোরের মধ্যে ছিলাম যেন। একসময় দেখলাম সাহসী মানুষটা নীরব নিথর হয়ে আছে। আস্তে আস্তে কফিন আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল! 

অনেক কঠিন ছিল সেই শোকের ঘোর কাটিয়ে উঠা। সেদিন ডা. আলীম দৃশ্যত চলে গেলেও তাঁর দেশপ্রেমের আদর্শ, জীবনাদর্শন আর দুই মেয়েকে মানুষ করার স্বপ্ন আমার মধ্যে রেখে গেছেন। ডা. আলীমের মতো মানুষের আদর্শ ও স্বপ্নের মৃত্যু হয় না। 

২৯ বছর বয়সে দুই মেয়েকে নিয়ে স্বামী হারানোর পর বাস্তবতা কতটা নির্মম হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মাত্র ছ’বছরের বিবাহিত জীবনে তিনি আমাকে নিজে কিছু করা ও দায়িত্ব নেয়ার অভ্যাস করিয়েছিলেন। পরিবারের দায়িত্ব এমনই যে শোকই তখন শক্তি হয়ে পথ দেখায়। কিছুদিনের মধ্যেই জানলাম আমার মতো অনেক নারীর জীবনে এমন ঘটনা ঘটেছে। অনেক পরিবারের এমন নির্মম পরিস্থিতি। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অভিভাকের দায়িত্ব পালনে হাত বাড়ালেন। কিন্তু ’৭৫ সালে তাঁকে হত্যার পর আমাদের ওপর নেমে এলো আবারো দুর্বিসহ অবস্থা। রাজারকার, আলবদর আর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের ক্ষমতার আস্ফালনে ক্ষতবিক্ষত হয়েছি। শহীদের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিলে অপমানিত হতে হয়েছে। তারপরও তো থেমে যাইনি, দমে যাইনি, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছি। অনেক যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে, বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, অনেক দিক থেকে এগিয়েছে। তাই বলে রাজাকার, আলবদর আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা শুধরে গেছে? নিশ্চিহ্ন হয়েছে? একদম না, এই অপশক্তি ধনে ও জনে বেড়েছে। তাদের সন্তানরাও পূর্বপুরুষদের অপকর্মকে ভুল মনে করে না ক্ষমা চায় না, লজ্জিত হয় না একটুও। বরং তাদের আস্ফালন এখনো ফণা তুলে এ প্রজন্মকে ভুল বার্তা দিচ্ছে। শিক্ষায়, সংস্কৃতি পালনের আচরণে ও পোশাকে বাংলাদেশকে আবারো পেছনে নিয়ে যেতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করছে। 

আরো আশঙ্কার জন্ম দেয় যখন দেখি এতো বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও জাতীয় ব্যক্তিত্ব মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সাথে হাত মেলায়, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জোট গড়ে তোলে। এ কিসের আলামত! এবারের বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবসের আগে এসব ভেবে বার বার মন খারাপ হচ্ছে, এই বাংলাদেশের জন্য কি ডা. আলীমসহ এতো মানুষের আত্মত্যাগ! কিন্তু তা হতে পারে না। 

অনেকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধী ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এসব কথা পুরনো হয়ে গেছে, এখন এসব এতো বলার কী দরকার। তাদের উদ্দেশ্য কি তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। শত বাধা আসলেও হাজার আর লক্ষ কোটি বছর পরেও আমাদের গর্ব, ইতিহাস-ঐতিহ্যের ও মর্যদার স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য আত্মগের কথা, মুক্তিযুদ্ধের ঠিক ইতিহাস বলতে হবে, জানাতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে। মাঝে মাঝেই হতাশ হই তারপরও আমার বিশ্বাস, শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা হতে দেবে না এ প্রজন্ম। আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলবে আগামী প্রজন্ম।  

৥ শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী শহীদ ডা. আলীম চৌধুরীর স্ত্রী, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি,  উদ্দীপন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।