ঢাকা, মঙ্গলবার ২৬, নভেম্বর ২০২৪ ১০:১৩:৪০ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

সমুদ্র ও সাত মানবী

শান্তা মারিয়া

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০১:১৮ এএম, ১৮ জানুয়ারি ২০১৯ শুক্রবার

উপন্যাস : সমুদ্র ও সাত মানবী-শান্তা মারিয়া (দ্বিতীয় পর্ব)

উপন্যাস : সমুদ্র ও সাত মানবী-শান্তা মারিয়া (দ্বিতীয় পর্ব)

তবে কঙ্কনাকে আশ্বস্ত করে, সাতটার দিকে বৃষ্টি থেমে গিয়ে উঠলো অপূর্ব সুন্দর রোদ। সাগর এখন উচ্ছ্বল। কঙ্কনার মনে হলো সমুদ্র এক প্রবল প্রেমিক। এরকম প্রেমিকের দেখা সে জীবনে পায়নি। কৈশোরে এবং প্রথম তারুণ্যে যে প্রেমের স্বপ্ন সে দেখতো তেমন কুল ছাপানো ভালোবাসা তার জীবনে কখনও আসেনি। যা এসেছে তা গতানুগতিক, মামুলি। অ্যাফেয়ার করেই বিয়ে হয়েছে তার একথা সত্যি। কিন্তু সে মানুষটির জায়গায় যদি একই ধরনের অন্য কেউ থাকতো তাহলেও খুব বেশি তফাত হতো না। আজ উত্তাল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে প্রথমবারের মতো তার মনে হলো নজরুলের ভালোবাসা তার জীবনে ঠিক কতটুকু প্রয়োজনীয় ছিল? নিজেকে নিয়ে এই ভাবনাটা তাড়াবার জন্যই যেন পোশাক বদলে ব্রেকফাস্টে যাবার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়া। 

হোটেলের বিশাল ডাইনিংহলে মোটামুটি ঠিক সময়ে এসে পড়েছে দলের সবাই। দেরি করছিল শুধু সামিরা। যে কোন দলবদ্ধ ট্যুরে এমন একজন থাকে যাকে নিয়ে অন্যরা হাসাহাসি করতে পছন্দ করে। আসলে একজনকে একঘরে করতে পেরে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার রীতিটা শুধু গ্রামীণ সমাজের নয়, এ প্রবৃত্তি মানুষের মজ্জাগত। এই ট্যুরে সবার উপহাসের পাত্রী হলো সামিরা পারভিন। সামিরা একটি ইংরেজি দৈনিকে সাব এডিটর হিসেবে কাজ করছে। খুব স্থূলাঙ্গী হলেও চেহারায় লাবণ্য রয়েছে। সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গীতে তার সাজপোশাক উগ্র। কিন্তু ঠিক পোশাকের কারণে সে অন্যদের অপছন্দের তালিকায় পড়েনি। অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা বলার অভ্যাস সামিরার। কক্সবাজারে তিমিমাছ আছে কিনা ধরনের উদ্ভট প্রশ্ন আহ্লাদী কণ্ঠে যাকে তাকে জিজ্ঞাসা করে জার্নিতে সে সকলের বিরক্তি উত্পাদন করেছে। সামিরা টের পায় সবাই ওকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। অফিসেও কলিগরা ওকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু দীর্ঘ বারো বছর ধরে এই আচরণ তার সঙ্গী। কক্সবাজার ট্যুরে সে এসেছে প্রায় জোর করে। জলি আপাকে অনেক অনুরোধের পর এ সুযোগটা সে পেয়েছে। সাবএডিটরের পোস্ট থেকে ট্রেনিংয়ে বা ট্যুরে যাওয়ার সুযোগ রিপোর্টারের তুলনায় খুবই কম। কিন্তু বাড়ির বাইরে বের হওয়া তার প্রয়োজন ছিল ভীষণভাবে। মানসিক চাপ আর সহ্য হচ্ছিল না তার। সকালে সমুদ্র থেকেই তার মনে পড়ছিল ব্যাংককের কথা। বিয়ের পর হানিমুনে ব্যাংকক নিয়ে গিয়েছিল তাকে তারেক। বিয়ের প্রথম দুটো বছরকে এখন মনে হয় অন্য গ্রহের জীবন। যেদিন থেকে শুদ্ধর অটিজম ধরা পড়লো সেদিন থেকেই তারেকের আচরণে কেমন যেন একটা পরিবর্তন নজরে পড়েছিল তার। কিন্তু তখন এসব নিয়ে ভাবার সময় ছিল না। শুদ্ধকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল জীবন। তারেকের সঙ্গে দ্বন্দ্বও তার শুদ্ধকে নিয়েই। অটিস্টিক সন্তানকে সহ্য করতে পারতো না তারেক। যেন ও তার ব্যর্থতার প্রতীক। চোখের আড়ালে থাকলেই শান্তি। এরপর ছোট্ট ঋতিরও যখন একই উপসর্গ দেখা দিল তখন ডিভোর্স লেটারের সাহায্যে শুধু সামিরাকে নয়, নিজের দুই সন্তানকেও ত্যাগ করে সে খুঁজে নিয়েছে নিজের মুক্তি। তারেক এখন নিউজিল্যান্ডে, নতুন সংসারে, নতুন জীবনে। সুখি না অসুখি, সে খবর সাংবাদিক হয়েও রাখার ইচ্ছা হয়নি সামিরার। অটিস্টিক দুই সন্তানকে নিয়েই কাটে অফিসের সময়টুকু ছাড়া তার দিনরাত্রি। একেক সময় মনে হয় ওরাই স্বাভাবিক, পৃথিবীটাই অটিস্টিক। ক্রমাগত মানসিক চাপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে উদ্ভট আচরণগুলোই তার আশ্রয়। মায়ের কাছে অনেক চেষ্টায় রেখে এসেছে সে সন্তানদের। মাও যেন সামিরার ছেলেমেয়েদের ঠিক ভালোবাসতে পারেন না। তবু মেয়ের কান্নাকাটিতে বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছেন।

নাস্তার টেবিলে  একেক জনের একেক রকম মন্তব্যের ওঠানামা। সামিরার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া তির্যক মন্তব্য সবই চোখে পড়ছিল জলির। কিন্তু টিম লিডারের দায়িত্ব এবং বয়স তাকে এমন একটি উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে যে এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো তার শোভা পায় না। অবশ্য সামিরার প্রতি অন্য মেয়েদের মনোভাব যদি খুব বেশি অসহনীয় হয়ে ওঠে তখন তিনি কোন ব্যবস্থা করবেন নিশ্চয়ই। সে সময় এখনও আসেনি। এখন তিনি রামু যাওয়া নিয়ে আলফাজের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত। আলফাজ, প্রোজেক্ট ডিরেক্টর হাবিবুর রহমান আর ইন্দোনেশীয় কান্ট্রি ডিরেক্টর সুহার্সো ইবরাহিম সাংবাদিকদের নিয়ে যাচ্ছেন রামুতে। ঝকঝকে দুটি লেক্সাস অপেক্ষা করছে হোটেলের বাইরে। 

সুহার্সোর সঙ্গে বেশ জমিয়ে নিয়েছে কঙ্কনা। বিষয়টি একটুও ভালো লাগছে না সুবর্ণা ও নাহিদের। তারাও তো দুটি নামকরা পত্রিকার সাংবাদিক। অথচ সুহার্সো কেন কঙ্কনাকেই এতটা প্রাধান্য দিচ্ছে তা বুঝতে তারা অক্ষম। এটা তাদের গাত্রদাহের একটা প্রধান কারণ। তবে বিষয়টি গোপন বলেই হয়তো এটা তারা অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার করছে না। 

আসলে মানুষের জীবনে এমন অনেক অনুভূতি থাকে যা সে অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না। সেই কথাটি ভাবছিল শোভা। এই কক্সবাজারে বেড়াতে আসার পর থেকে তার বারে বারে মনে হচ্ছিল নিজের জীবনের অসীম শূন্যতার কথা। শোভা তার আটত্রিশ বছরের জীবনে এমন কাউকে পায়নি যে তাকে নিজের করে নিতে পারে। শোভা সেন বনেদী কায়স্থ বাড়ির মেয়ে। আজকাল হিন্দু পরিবারে জাতপাতের কথা আর কেউ ভাবে না। শোভার বাবা-মাও যে তেমন ভেবেছিলেন তা নয়। তবু কেন যেন জীবনে কাউকে নিজের করে পাওয়া হয়নি তার। দেখতে খারাপ নয় শোভা। অথবা বলা যেতে পারে খারাপ ছিল না তার প্রথম তারুণ্যে। একহারা দীর্ঘ দেহ, মাথায় একঢাল চুল। ভেজা চুল ছেড়ে যখন সে কলেজে যেত তখন পাড়ার উঠতি বয়সী ছেলেদের হৃদয় যে তোলপাড় করে উঠতো না তা নয়। সরস্বতী পূজার সময় সাদা শাড়ি পরা শোভাকে দেখে অনেকে বাগদেবীর সঙ্গে তুলনা করতো। একবার আশ্বিনের হিমঝরা রাতে দুর্গাপূজার মণ্ডপে বিনতার বলা কথাগুলো এখনও কানে বেজে ওঠে তার। বিনতা বলেছিল, তোর বর হবে কার্তিক ঠাকুরের মতো দেখতে। শোভাও তখন থেকে কার্তিক ঠাকুরের দিকে তাকালেই লজ্জা পেত। এরপর আরও অনেক শারদীয়া গেছে, গেছে কার্তিকপূজা, লক্ষ্মীপূজার তিথি। পার হয়েছে কোজাগরী রাত। শোভা বিনিদ্র ছিল। কিন্তু কার্তিক ঠাকুর আর বর হয়ে আসেননি। হ্যা, একবার তার আভাস মিলেছিল। শোভা আর অরিন্দম তখন একই পত্রিকায় চাকরি করতেন। শোভা তখন মাত্র মাস্টার্স শেষ করে পত্রিকায় যোগ দিয়েছেন। অরিন্দমও কাছাকাছি বয়সেরই ছিল। সামান্য বড়। পালটি ঘর। শোভা অরিন্দমের প্রেমেই পড়েছিল বলা যায়। অরিন্দমের মা ও বৌদি বেশ পছন্দও করেছিলেন শোভাকে। শোভার পরিবার থেকেও অপছন্দ ওঠেনি। কিন্তু এরই মধ্যে অরিন্দম জড়িয়ে পড়লো আরেক সহকর্মী মাল্যশ্রীর সঙ্গে। বিয়েটা অবশ্য মাল্যশ্রীর সঙ্গেও হয়নি, ফিরতেও চেয়েছিল অরিন্দম। কিন্তু শোভাই তখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। অরিন্দমকে তখন গ্রহণ করলে নিজের কাছেই খুব ছোট হয়ে যেত সে। পরে অরিন্দমের সুসজ্জিত স্ত্রীকে দেখে মনের ভিতরে চাপা আক্ষেপ হয়নি তা নয়। আজ সকালে গাড়িতে ওঠার সময় এই বিশাল সমুদ্রকে দেখে বার বার জল আসছিল শোভার চোখে। যদি সত্যিই সমুদ্র থেকে উঠে আসতেন কোনো দেবতা। না, শোভা সেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিপ্লবী রাজনীতি করা শোভা সেন, এখন অন্তত কোন দেবতার অস্তিত্বে আর বিশ্বাস করে না। 

বান্দরবানের পাহাড়ি প্রকৃতি অপরূপ। লেক্সাস গাড়িদুটি এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথ দিয়ে রামুর দিকে। বর্ষায় পাহাড়ি অঞ্চলের ঝর্ণাগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সুহার্সোর সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যেতে যেতেও ঝর্ণাগুলো চোখে পড়ছিল কঙ্কনার। মনের ভিতরে নিজের অজান্তেই গুঞ্জন করে উঠছিল রবীন্দ্রসংগীত। কঙ্কনার আনন্দ সঞ্চারিত হচ্ছিল সুহার্সোর মধ্যেও। বহুজাতিক এনজিওর কান্ট্রি ডিরেকটর সুহার্সো ইবরাহিমও তার স্বভাবজাত নিরপেক্ষতার মুখোস খুলে আকৃষ্ট হচ্ছিলেন এই বাঙালি নারীর প্রাণোচ্ছ্বলতায়। 

চলবে........