সমুদ্র ও সাত মানবী
শান্তা মারিয়া
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১০:৫১ এএম, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ শুক্রবার
উপন্যাস : সমুদ্র ও সাত মানবী শান্তা মারিয়া (পঞ্চম পর্ব)
।পঞ্চম পর্ব।
নাহিদের ভিতরে অবশ্য দৃঢ়তার অভাব নেই। অভাব শুধু রূপের। আপাত দৃষ্টিতে তিনি দেখতে মোটেই সুন্দর নন। বাঙালি সমাজের প্রচলিত মাপকাঠিতে কালো, পুরুষালী গড়নের নাহিদকে বরাবর অসুন্দরীর দলে ঠেলে ফেলেছে তার পরিচিতরা। অথচ ইউরোপ বা আমেরিকায় তার এই গড়নের আলাদা কদর রয়েছে। তিনি কিছুটা টমবয় গোছের ছোটবেলা ধেকেই। একহারা নাহিদকে জিন্স ও চেক শার্টে দুর্দান্ত সুন্দর লাগে। নাহিদ রিপোর্টার হিসেবেও বেশ নামকরা। তার রিপোর্ট আন্তর্জাতিক পুরস্কারও জিতেছে। কথা কম বলেন বটে তবে যখন বলেন তখন খুবই গুছিয়ে বলতে পারেন। এত গুণ থাকা সত্ত্বেও বাইরের রূপ বিশেষ করে পুতুল মার্কা রূপ বাঙালি সমাজে কতটা মূল্যবান তা তিনি হাড়ে হাড়ে জানেন। যতই গুণ থাকুক এদেশের মানুষ আকৃষ্ট হয় নারীর রূপের প্রতিই। তার অফিসেই তো, সম্প্রতি যোগ দেওয়া একটি পুতুলমার্কা মেয়ে স্রেফ বসের সঙ্গে খাতির জমিয়ে একের পর এক সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছে। চিফ রিপোর্টারের সঙ্গে দুইবেলা আড্ডা দিয়ে বিদেশে অ্যাসাইনমেন্ট পাচ্ছে কয়েক মাস পরপরই।
নাহিদের ব্যক্তিগত জীবনেও কিছুটা সংকট চলছে। নাহিদের স্বামীও সাংবাদিক। একটি টিভি চ্যানেলের ভালো পদে আছেন। সুদর্শনা সহকর্মীদের সঙ্গে তার মাত্রাতিরিক্ত ঘনিষ্টতার গুজব বাতাসে ভাসে। অবশ্য নাহিদের হাত ছাড়িয়ে নেবার সাহস তার নেই। কিন্তু হাত ছাড়িয়ে নেবার ইচ্ছাটাই তো যথেষ্ট অপমানজনক। নাহিদ তার এই দুঃখবোধগুলো কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন না সুবর্ণা ছাড়া। কঙ্কনাকে আসলে তিনি অপছন্দ করেন ও বড় বেশি সুখী বলে।
কঙ্কনা কি সত্যিই সুখী? হোটেলের লবিতে বসে সুহার্সোর সঙ্গে আলাপ করতে করতে নিজেকেই প্রশ্ন করছিল কঙ্কনা। গত তিনদিন ধরেই নিজেকে এ প্রশ্ন করছে সে। নাইক্ষাংছড়ি, বৌদ্ধমন্দির, ডুলা হাজরা সাফারি পার্ক সর্বত্রই এই প্রশ্ন তাকে তাড়া করেছে। এমনকি এই তিনদিনে যখনি নজরুলের সঙ্গে ফোনে কথা হযেছে তখনি একটা অপরাধবোধ তার ভিতরে চেপে বসেছে। সুহার্সোকে এতটা ভালো লাগা কি নজরুলের প্রতি প্রতারণা নয়? অবিশ্বস্ততা বা প্রতারণা বলতে যা বোঝায় সেটা নজরুলের প্রতি কখনও করেনি কঙ্কনা। ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে সে অন্য কারও সঙ্গে কোন সম্পর্কে জড়ায়নি। সত্যি বটে তাদের দাম্পত্য এখনও সন্তানহীন। কিন্তু সেটা ইচ্ছাকৃত। বিজ্ঞাপনী সংস্থায় নজরুলের চাকরিটা এখনও টালমাটাল। তারও পত্রিকার চাকরিতে মাঝেমধ্যে বেতন সংকট চলে। এমন অবস্থায় ওরা দুজনেই ভেবেছে আরেকটু সুস্থির হয়ে সিদ্ধান্ত। তাছাড়া সন্তানই দাম্পত্যের মোক্ষ এমনটা সে কখনও ভাবেনি। তাদের সম্পর্কটা ভালোবাসারই কিন্তু সেই ভালোবাসা কেমন যেন নিস্তরঙ্গ। শুরু থেকেই। নজরুলের স্বভাবটাই এমন। কোন বিষয়ে আবেগ প্রকাশ করতে চায় না। বিয়ের প্রথম দিকেই সেটা টের পেয়েছিল সে। নজরুল কখনও কঙ্কনার প্রতি কোন প্রশংসা করেনি। না রূপের না তার লেখার। আবেগের প্রকাশকে সে সবসময়েই মনে করে বাংলা সিনেমার ডায়লগের বাড়াবাড়ি। বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্ট লেখে বলেই হয়তো ব্যক্তিগত অনুভূতির বিজ্ঞাপন দিতে তার অস্বস্তি হয়। নজরুলের সঙ্গে কখনও ঝগড়াও হয় না, মানঅভিমানও নয়। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হয়ে একটা প্রেম ও শারিরীক আদান প্রদান আছে বটে কিন্তু তার কোন বিশেষত্ব নেই, একটা দিন ঠিক অন্য একটা দিনের মতোই। কঙ্কনা এতদিন এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করেনি। প্রথম তারুণ্যে বন্ধুরা তাকে খুব আবেগপ্রবণ বলে মনে করলেও এখন তাকে খুব প্রোফেশনাল ও প্র্যাকটিকাল বলেই মনে করে সহকর্মীরা। কক্সবাজারে আসার পর তিনদিনই নজরুলের সঙ্গে কথা হয়েছে বেশ কবার। কিন্তু সেসবও গতানুগতিক কথা। সাংসারিক। তোমাকে মিস করছি ধরনের কথা নজরুল একবারও বলেনি। এটাও ব্যতিক্রম নয়। যতবারই ট্যুরে গেছে কঙ্কনা সে কখনও এই সংলাপটি শোনেনি। অথচ কথাটি শুনলে নিশ্চয়ই ভালো লাগতো। নাহয় একটু যাত্রাঢঙের আবেগের প্রকাশই ঘটতো। সে কি ঠিক এ ধরনের সঙ্গী চেয়েছিল? হোটেলের লবিতে বসে সুহার্সোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিজেকে প্রশ্ন করে চলছিল সে।
আজকে আকাশে তেমন মেঘ নেই। পরিপূর্ণ চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে বেলাভূমি। কঙ্কনার খুব ইচ্ছা করছিল সুহার্সোর হাত ধরে সৈকতে হাঁটতে। রাতের বেলা কক্সবাজারের সৈকত নিরাপদ কি না সে নিয়ে দোলাচল থাকতে পারে তবে হোটেলের লবিতে কোন সমস্যা নেই। লবির কাঁচের বড় বড় উইনডো দিয়ে দেখা যাচ্ছে সমুদ্রতটের অপার্থিব সৌন্দর্য। ঘরের ব্যালকনি থেকে সমুদ্র দেখা যায় আরও ভালোভাবে। কিন্তু রাতের বেলা সুহার্সোকে নিজের ঘরে ডাকতে পারেনি কঙ্কনা। কে কী বলবে ঠিক সে ভয়ে নয়। সে এসবের পরোয়া কমই করে। সুহার্সোকে এত ভালো লাগছে যে নিজেকেই ভয় লাগছিল তার।
খুব সাধারণ বিষয় নিয়ে আলাপ করছিল ওরা। বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যা, গান, সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র, সাহিত্য, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এমনি এলোমেলো বিষয়। কিন্তু প্রতিটি কথাই যেন নিবিড়ভাবে বাঁধছিল ওদের এক অদৃশ্য সুতোয়। পরষ্পরের সঙ্গ অসম্ভব ভালো লাগছিল দুজনের কাছেই। রাত গভীর হচ্ছিল তবু লবি থেকে উঠে ঘরে যাবার কথা ভাবছিল না কেউই। বিশেষ করে আজকের ডিনারের স্মৃতি দুজনকেই আলোড়িত করছিল। আজ ডিনার ছিল রেস্টুরেন্ট লিটল মারমেইডে। অন্যরকম একটি জায়গা। সমুদ্রতীরে খড়ের চাল দেওয়া ছোট ছোট কয়েকটি কুঁড়ে ঘর। ঠিক কুঁড়ে নয়। বরং বলা যায় বেশ কয়েকটি আটচালা। মৃদু আলো। সন্ধ্যারাতের সমুদ্রকে ম্লান করা চড়া আলো এখানে একবারেই বেমানান লাগতো। তাই দেখতে জাহাজের হারিকেনের মতো হালকা আলোর ব্যবস্থা। সূর্যডোবা দেখার পর একটু একটু করে মায়াবি অন্ধকারের ছড়িয়ে পড়া অনুভব করা যাচ্ছিল। সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ, খোলা আকাশের নিচে বারবিকিউ। খাবারটাও ছিল সামুদ্রিক মাছের গ্রিল, চিংড়ি ভাজা আরও নানা রকম অফট্র্যাকের। ঠিক গতানুগতিক পোলাও মাংস নয়। কঙ্কনার নিজেকে মনে হচ্ছিল তাহিতি দ্বীপের কোনো মেয়ে। যখন শীতের শেষে বসন্তের বাতাস ভেসে আসে সাগরের ঢেউ ছুঁয়ে। যখন আকাশ তারায় ভরে যায়। অনেক আগে, কিশোরবেলায় অথবা গতজন্মে কঙ্কনাকে কে যেন বলেছিল তাহিতি দ্বীপের রাতগুলো খুব মায়াবী হয়। আকাশে অসংখ্য তারা। বেলাভূমিতে নারিকেল গাছের পাতা ছুঁয়ে বয়ে যায় সাগরের আদরমাখা বাতাস। ছোট ছোট নৌকা দোলে ঢেউয়ে। বিশ্বের কত দেশেই না গেছে কঙ্কনা তার পেশাগত কাজে। কলম্বো, পাতায়া, বালির সৈকত দেখেছে। কিন্তু আজকের মতো কিশোরবেলায় ফিরে যেতে পারেনি কখনও। তাহিতি দ্বীপের যে রাতটির কল্পনা করেছিল সতের বছর বয়সে তা যেন আজকে হঠাৎ ফিরে এসেছে। ডিনারের পর বাজনার সঙ্গে নাচের আয়োজন। ধুমধারাক্কা বলিউডি গান নয়। মুনলাইট সোনাটা। খুব পাশ্চাত্য ঢংয়ে নাচের ব্যবস্থা। এই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজমেন্টের রুচি আছে বলতে হবে। দ্বিধা সংকোচ ঝেড়ে সকলেই নাচের জন্য উঠেছিলেন। এমনকি জলি আপা পর্যন্ত। কঙ্কনার সঙ্গে নাচের অভিজ্ঞতা সুহার্সোর কাছে মনে হচ্ছিল যেন দুর্লভ প্রাপ্তি। কঙ্কনা শাড়ি পরেছিল। কপালে বড় লাল টিপটির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল সুহার্সো । শাড়ি পরা কঙ্কনাকে তার এত কোমল, সুন্দর অথচ সাবলীল লাগছিল যে কিছু সময়ের জন্য বাস্তবতাকে ভুলে যাচ্ছিল সে। সুহার্সো বিবাহিত। ঢাকায় স্ত্রী ও এক সন্তানকে রেখে এসেছেন। স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্কও মন্দ নয়। তবে তার স্ত্রী সাজগোজ ভালোবাসে না। প্রসাধনহীন তার রূপ বড্ড একঘেঁয়ে। অবশ্য কঙ্কনাকে দেখার আগে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে এত বেশি ভাবনা চিন্তা করেননি তিনি। তার স্ত্রী সালিমা ঢাকার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক। মাত্র তিনমাসের ঢাকা তথা বাংলাদেশ জীবনে কঙ্কনার মতো প্রাণোচ্ছ্বল নারীর দেখা পাননি তিনি। সত্যি বলতে কি নিজের চল্লিশ বছরের জীবনেই এমন নারীর দেখা পাননি তিনি। সে তুলনায় আট বছরের বিবাহিত স্ত্রীকে তার আরও বেশি প্রাণহীন বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু একথাও ঠিক সুহার্সো একটি প্রতিষ্ঠানে অনেক দায়িত্বপূর্ণ পদে আছেন। সংসারে দায়িত্ববান স্বামী ও বাবা। হুট করে কারও প্রেমে পড়াটা তার একদম শোভা পায় না। সুহার্সো আশা করছেন কঙ্কনার প্রতি তার এই আকর্ষণটা হবে সাময়িক। হয়তো এটা এই অপরূপ প্রকৃতির নেশায় ঘটছে। ঢাকায় ফিরে নিশ্চয়ই সব ঠিক হয়ে যাবে। কারণ তা না হলে যা ঘটবে তাতো পরিণতিহীন ভয়ংকর। তার জন্যও, কঙ্কনার জন্যও। এই তীব্র ভালোলাগার শেষ কোথায় কেজানে। এই পরিণতির কথা না ভেবেই আপাতত বর্তমানকে উপভোগ করছেন তিনি। কাচের দেয়াল ঘেরা সমুদ্রের সান্নিধ্যে তিনি আলাপে মেতে উঠছেন কঙ্কনার সঙ্গে।
চলবে...