আমি ভাষাসৈনিকের মেয়ে : শান্তা মারিয়া
শান্তা মারিয়া
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০১:১৯ এএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ বৃহস্পতিবার
বাবা কমরেড তকীয়ূল্লাহর সঙ্গে শান্তা মারিয়া। ছবি : ফেসবুক থেকে
একুশে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষাশহীদ দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশে ফেব্রুয়ারি আমার কাছে বাবার স্মৃতির সঙ্গে এক হয়ে যায়। শহীদ মিনারে আমি দেখতে পাই বাবার স্নেহময় মুখ। আমার বাবা কমরেড তকীয়ূল্লাহ মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও সৈনিক। তিনি ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের একমাত্র আলোকচিত্রীও। তিনি ভাষা আন্দোলনের কর্মী হিসেবে সেসময় গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির একজন প্রথম সারির বিপ্লবী নেতা হিসেবে ১৯৫১ সালে তিনি আবার কারাবন্দী হন। তাই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি রাজবন্দী ছিলেন। সেসময় কারাগারে শহীদ মুনীর চৌধুরির লেখা কবর নাটক প্রথম অভিনীত হয়। কমরেড তকীয়ূল্লাহ ছিলেন সেই কবর নাটকের একজন অভিনয় শিল্পী। জেলের ভিতরে রাজবন্দীরা ভাষা আন্দোলনে ছাত্রজনতার উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে অনশন করেছিলেন। মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ প্রতিবাদ অনশনেও অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য তিনি ত্যাগ করেছিলেন সেনাবাহিনীতে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যত। তিনি বর্তমানে প্রচলিত বাংলা বর্ষপঞ্জিরও জনক। সংগত কারণেই ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমার মনে প্রবল হয়ে ওঠে বাবার স্মৃতি, ছোটবেলার স্মৃতি। আজ নাহয় সে কথাগুলোই বলি।
ঊনিশশ সত্তরের দশক ও আশির দশক। তখন শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে যেতাম প্রভাত ফেরীতে। বাবার হাত ধরে ছোট্ট আমি খালি পায়ে চলে যেতাম শহীদ মিনারে। হাতে থাকতো ফুলের স্তবক। তখন হাইকোর্টের সামনে থেকে পুরো পথটা খালি পায়ে হেঁটে যাওয়ার রীতি ছিল। বাবার ভয় হতো যদি আমার পায়ে কাঁটা ফোটে বা বেশি ধুলোবালি লাগে। এদিকে জুতো পরাও চলবে না। তাই আমাকে সাদা রঙের মোজা পরিয়ে নিতেন। অনেকটা পথ বাবার কোলে চড়েই যেতাম অবশ্য। আজ মনে হয়, সন্তানের প্রতি কতটা যত্নশীল হলে একজন বাবা এতদিকে খেয়াল রাখতে পারেন। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে যেতাম দাদার কবরে। শহীদুল্লাহ হলের সামনে দাদা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবর। বাবা আমাকে মুখে মুখে শোনাতেন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনে জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কি অসীম সাহস ও দৃঢ়তায় শাসক শ্রেণীর চক্রান্তের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সেকথা বলতে গিয়ে আবেগ প্রবণ হয়ে পড়তেন তিনি। আরও বলতেন তার সহযোদ্ধা কমরেড ভাষাসৈনিকদের কথা। বলতেন সহযোদ্ধা ভাসাসৈনিক কমরেড শহীদুল্লাহ কায়সারের কথা। ভাষাসৈনিক বন্ধু গাজীউল হক, আবদুল মতিন, ভাষা শহীদ আবুল বরকত, ভাষাসৈনিক নাদেরা বেগম ও রওশন আরা বাচ্চুর কথা।
শহীদুল্লাহ হল প্রাঙ্গণ থেকে আমরা চলে যেতাম বাংলা একাডেমির চত্বরে। সেখানে বাবার একান্ত উত্সাহে ‘স্বরচিত কবিতা পাঠের আসরে’ অংশ নিযেছি অনেক বার।
মনে পড়ে বাবার হাত ধরে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় যাবার স্মৃতি। আমি যখন ছোট তখন মুনতাসীর মামুনের ‘অ্যান্ডারসনের গল্প’, ‘দ্বীপ দ্বীপান্তর’, শাহরিয়ার কবিরের ‘নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘হাতকাটা রবিন’, ‘কপোট্রনিক সুখদুঃখ’, ‘মহাকাশে মহাত্রাশ’ হায়াৎ মামুদের রবীন্দ্রনাথের কিশোর জীবনী, হালিমা খাতুনের ‘কাঁঠাল খাবো’, ‘হরিণের চশমা’ ইত্যাদি বই, মেলায় ছোটদের মন কেড়ে নিত। মোহাম্মদ নাসির আলী, সাজেদুল করিমের মতো শিশু সাহিত্যিককে একালের শিশুরা কতটা চেনে আমি জানি না। তবে আমরা চিনতাম। এখলাস উদদীন আহমেদের বইও খুব জনপ্রিয় ছিল। মুক্তধারা থেকেও বের হতো অনেক বই। আর সেবা প্রকাশনীর বই ২০ শতাংশ ছাড়ে কেনার আকর্ষণ তো থাকতই। দু’হাত বোঝাই করে বই কিনতাম আমরা দু’ভাইবোন। বাবা যে খুব ধনী মানুষ ছিলেন তা নয়। সাধারণ মধ্যবিত্ত। কিন্তু বই কেনার বেলায় কখনও আঁটসাঁট করতেন না। শুধু বইমেলা নয়, অন্য সময়েও প্রচুর বই কিনতাম আমরা। স্টেডিয়ামে আইডিয়াস ম্যারিয়েটা, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স আর নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানগুলো ছিল লোভনীয় বেড়ানোর জায়গা। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত ছোটদের বইগুলো কিনতাম দেদার। একালের শিশুকিশোরদের মতো ফাস্টফুডের পিছনে আমাদের টাকা ব্যয় হতো না। ব্যয় হতো বই কিনে, বই সংগ্রহ করে। জন্মদিনেও আমরা বই উপহার পেয়ে খুশি হতাম। বাবা আমাকে অনেক বই উপহার দিযেছেন যেমন ছোটবেলায়, তেমনি বড়বেলাতেও।
বাবার মুখে ভাষা আন্দোলনের গল্প শুনতে শুনতে মনে হতো চোখের সামনে সব ঘটনাগুলো যেন দেখতে পাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গল্পও বলতেন তিনি। তিনি ঢাকায় গেরিলা যোদ্ধাদের অনেক সহায়তা করেছিলেন। আমার বাবা সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, কমরেড তকীয়ূল্লাহ ছিলেন এমন একজন ভাষাসৈনিক যিনি মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, আলোকচিত্রী এবং এই আন্দোলনের জন্য কারাবরণকারী। ভাষা আন্দোলনের জন্য তিনি ত্যাগ করেছিলেন সেনাবাহিনীতে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা। বলতে গেলে তিনি তার সারা জীবনই উৎসর্গ করেছিলেন মাতৃভাষা, মাতৃভূমি ও সমাজের কল্যাণে। নিভৃতচারী এই মানুষটি জীবদ্দশায় তাঁর এই ত্যাগস্বীকারের জন্য পাননি কোন সম্মাননা বা স্বীকৃতি। তিনি শুধু ভাষা আন্দোলনেই অংশ নেননি, তিনি বাংলাদেশের বর্তমান বর্ষপঞ্জির সংস্কারক এবং পঞ্চাশের দশকে এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
ভাষাসৈনিক ও বাংলাবর্ষপঞ্জির সংস্কারক কমরেড তকীয়ূল্লাহ মাতৃভাষার সেবায় তার অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক পান ২০১৭ সালে তার মৃত্যুর মাত্র তিনমাস পরে। পঞ্চাশের দশকে এদেশের প্রগতিশীল প্রতিটি আন্দোলনে তাঁর ছিল অগ্রণী ভূমিকা। জীবনের অনেকগুলো বছর তিনি পার করেছেন রাজবন্দী হিসেবে। শ্রমিক আন্দোলনকে সংগঠিত করতে ব্যয় করেছেন তারুণ্যের শ্রেষ্ঠ সময়, মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বেছে নিয়েছেন ঝুঁকিপূর্ণ পলাতক জীবন, সহ্য করেছেন পুলিশী নির্যাতন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ঢাকার গেরিলা যোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন। স্বাধীনতার পর সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে এসে বর্ষপঞ্জি সংস্কারের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন তিনি। এর পাশাপাশি বাড়িতে নিজ উদ্যোগে পরিচালনা করতেন বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম। ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার বিরোধী গণ-আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আবার গ্রেপ্তার হন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, তাজউদ্দিন আহমেদ প্রমুখের সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২৬ নম্বর সেলে বন্দী ছিলেন। জেল থেকে মুক্তির পর তিনি জুটমিলের চাকরিতে যোগ দেন। যেসব জুটমিলে তিনি চাকরি করেছেন সেখানেও শ্রমিক কর্মচারি ইউনিয়নের পরামর্শদাতা ছিলেন। বন্যা ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে রেডক্রসের স্বেচ্ছাসেবক কর্মী হিসেবেও কাজ করেছেন।
পরবর্তিতে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে এসে বিভিন্ন ধরনের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি চর্চারও অন্যতম পথিকৃত তিনি। মূলত শ্রমজবিী মানুষের ছবি তুলেছেন। তিনি ব্যক্তিগত খরচে বাড়িতে বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম চালাতেন। পাড়ার শ্রমজীবী মানুষরা তার ছাত্র ছিলেন।
ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সূচিত ও বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত বাংলা বর্ষপঞ্জির ব্যাপক সংস্কার করেছেন মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ। বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত এই বর্ষপঞ্জি বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত আছে। তকীয়ূল্লাহ প্রস্তাবিত পদ্ধতিতেই ১৪০২ বঙ্গাব্দ থেকে বাংলা সনের বর্ষপঞ্জির দিন তারিখ গণনা করা হচ্ছে। তিনি চার হাজার বছরের বাংলা, ইংরেজি ও হিজরি ক্যালেন্ডার তৈরি করেছেন। তিনি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জীবনী লিখেছেন সেই সঙ্গে আমাদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বিকাশ সম্পর্কে লেখালেখি করেছেন। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত রচনার প্রথম তালিকাটি তাঁরই করা।
ব্যক্তিগত জীবনে বাবা ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক ও নারী-পুরুষ ও ধনী-গরীবের বৈষম্য বিরোধী একজন মানুষ। তিনি আমার মাকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। ঘরের সবকাজে সমানভাবে অংশ নিতেন। আমাদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত যত্নশীল। আমার জ্বর হরে সারা রাত জেগে সেবা করতেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। ঘুমাতে না চাইলে সারা রাত কোলে নিয়ে পায়চারী করতেন। আমাকে তিনি ইতিহাসের ও সমাজবিজ্ঞানের পাঠ দিতেন। বিশেষ করে দর্শন ও সমাজতন্ত্রের বই রীতিমতো নিয়ম করে পড়াতেন। আমাকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন মুক্ত চিন্তার মানুষ হিসেবে। কোনরকম পুরুষতান্ত্রিকতা তার ভিতরে আমি কোনদিন দেখিনি। তিনি ছিলেন আমার দার্শনিক, পথপ্রদর্শক এবং সেরা বন্ধু। একজন ভাষাসৈনিক, একজন কমরেডের কন্যা হিসেবে আমি গর্বিত। আমার পরম সৌভাগ্য যে তার মতো মানুষকে বাবা হিসেবে পেয়েছিলাম, সেরা বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলাম। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে তাঁর স্মৃতির প্রতি নিবেদন করছি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
শান্তা মারিয়া : লেখক ও কবি