তথ্যপ্রযুক্তিতে ‘মেধাশ্রম আইন’ এর খসড়া প্রণয়ন
নিজস্ব প্রতিবেদক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০২:২২ পিএম, ৭ এপ্রিল ২০১৯ রবিবার
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে শ্রম নিয়ে আইন থাকলেও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ‘মেধাশ্রম’ ব্যবস্থাপনায় কোনো বিধিবিধান নেই, এ কারণেই বিকাশমান এই খাতটি বিভিন্ন সময় প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীদের জন্য ‘মেধাশ্রম আইন’ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
বাংলাদেশ মেধাশ্রম আইন প্রণয়নে খসড়া তৈরির জন্য সম্প্রতি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শ্রম) রেজাউল হককে আহ্বায়ক করে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিকে আগামী ছয় মাসের মধ্যে প্রস্তাবিত আইনের একটি খসড়া শ্রম সচিবের কাছে দাখিল করতে হবে।
অতিরিক্ত সচিব (শ্রম) রেজাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ ধরনের আইন আমাদের জন্য একেবারে নতুন। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে যারা কায়িক শ্রম দিয়ে নয় মেধা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, তাদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। তাদের তো আমাদের একটা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। সেজন্যই মেধাশ্রম আইন করা হবে। ’
তিনি বলেন, ‘আগামী দু-এক সপ্তাহের মধ্যে কমিটির প্রথম সভা আহ্বান করা হচ্ছে। এরপর আমরা মেধাশ্রমের সঙ্গে আর কারা সংশ্লিষ্ট, তাদের খুঁজে বের করে মতামত নেব। আইটি বিশেষজ্ঞদেরও পরামর্শ নেব। আমরা কাজটা শুরু করতে চাই। ’
রেজাউল হক বলেন, ‘কায়িক শ্রমের ক্ষেত্রে শ্রমঘণ্টা, মজুরি, ছুটিসহ অন্যান্য যে বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলো মেধাশ্রমের প্রেক্ষাপটে কী হবে, তা নতুন আইনে তুলে ধরা হবে। ’
তিনি বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করলে বা কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মকালীন বিশেষ প্রযুক্তি জ্ঞান অন্য কোথাও, কীভাবে প্রয়োগ করবেন তার ব্যাখ্যা থাকবে আইনে। মালিকের জন্য যেমন কিছু বিধিনিষেধ ও আচরণীয় বিষয় থাকবে, তেমনি কর্মীদের ক্ষেত্রেও থাকবে। কায়িক শ্রমের ক্ষেত্রেও নানা ধরনের বিধিনিষেধ প্রয়োগ করা হবে। ’
অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘আইটি ফার্মগুলোতে অনেকে মেধাশ্রম দিচ্ছেন। এখন ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে প্রচুর অনলাইন পত্রিকা হচ্ছে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি হচ্ছে, মেধা দিয়ে প্রকল্পের ডিপিপিও তৈরি হচ্ছে। মেধাশ্রম আইন করার ক্ষেত্রে তাদের বিবেচনায় নেয়া হতে পারে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘আইটি পার্ক গড়ে উঠছে। সেখানে শিল্পপ্রতিষ্ঠান থাকছে। সেখানে তো মানুষ কাজ করছে, মানুষ মেধাশ্রম দিয়ে কাজ করছে। কায়িক শ্রম দেয়া মানুষের মতো তাদের ট্রিট করলে তো হবে না। তাদের অধিকারগুলো রক্ষার জন্য একটা আইনের মধ্যে তাকে আনতে হবে। নতুন আইন করার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো নিয়েই আমরা ভাবছি। ’
আইনে সুনির্দিষ্টভাবে কোন কোন বিষয়গুলো আসবে, দু-একটি সভা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করলে তা আরও স্পষ্ট হবে বলেও জানান কমিটির আহ্বায়ক রেজাউল হক।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, ‘আমাদের একটা শ্রম আইন আছে, ট্র্যাডিশনালি শিল্পে কায়িক শ্রম যারা দিচ্ছেন, আইনটা তাদের জন্য। আইটি (তথ্যপ্রযুক্তি) ইন্ডাস্ট্রি আমাদের এখানে ধীরে ধীরে একটা বড় ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হচ্ছে। আইটি বিষয়টি এখন একটি ক্রস কাটিং বিষয়। কারণ অন্যান্য শিল্পের মধ্যে এটি আছে। পোশাক শিল্পে গেলেও আপনি দেখবেন, সেখানে আইটির একটি বড় ভূমিকা আছে। ’
তিনি বলেন, ‘এখন আইটির বিষয়টি আমরা অবহেলা করতে পারব না। এখানে আমাদের অ্যাটেনশন দিতে হবে। যারা আইটি নিয়ে কাজ করেন তাদের কাজটি কিন্তু কায়িক নয়, তারা মেধা দিয়ে কাজটি করেন। একজন মানুষ মেধা খাটিয়ে প্রোগ্রামিং করছেন বা গ্রাফিক্সের কাজ করছেন বা এনিমেশন করছেন, ইন্টেলেকচুয়াল শ্রম এটা। এটা নিয়ে আলাদা আইন থাকতে হবে। কারণ কায়িক শ্রম আর মেধাশ্রম তো এক নয়। ’
আলমাস কবীর আরও বলেন, ‘মেধাশ্রমের ধরনটা অন্যরকম। কায়িক শ্রমটা যেমন ঘণ্টা দিয়ে নির্ধারণ করা হয়, মেধাশ্রমটা সেখানে সম্ভব নয়। কারণ আপনি যখন গাড়িতে যাচ্ছেন তখনও হয়তো কাজটা করছেন। তাই এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে অবশ্যই ভিন্ন আইনের প্রয়োজন রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মেধাশ্রম আইন না থাকায় জিপি (গ্রামীণফোন) আইটিতে সেখানে বেশকিছু সমস্যা হয়েছিল। সেখানে দাবি-দাওয়া নিয়ে কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল। মালিকদের সঙ্গে শ্রমিকদের দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানিই বন্ধ হয়ে যায়, জিপি আইটি বাংলাদেশ থেকে চলে যায়। এতো বড় একটি কোম্পানি এলো, এটি আরও বড় হতে পারত। আরও অনেকে মানুষের কর্মসংস্থান হতো সেখানে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিদেশ থেকে নলেজ ট্রান্সফার হচ্ছিল, সেটা তো আর হলো না। ওটা ছিল আইটি ইন্ডাস্ট্রির জন্য খারাপ একটি উদাহরণ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আইন থাকলে এ ডিসপিউটটা (দ্বন্দ্ব) হতো না। ’
তিনি আরও বলেন, ‘তাদের (জিপি আইটি) চলে যাওয়ার বিষয়টি অন্য বিদেশিদের জন্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে, যারা এখানে এ খাতে বিনিয়োগের চিন্তা করেছিল। তারা হয়তো ভেবেছে, ওখানে আইন নেই, আমরাও ওখানে যাব কি-না? আমাদেরও এমন খারাপ অভিজ্ঞতা হবে কি-না?’
তিনি বলেন, ‘আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা যদি নতুন আইন না করি, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ আনা মুশকিল হবে। এখন যে আইটি কোম্পানিগুলো আছে, বিশেষ করে যারা ভালো করছে, বড় হচ্ছে, কর্মী বাড়াচ্ছে, তাদের জন্যও মুশকিল হবে। আইনটা হলে কর্মী ও মালিক- সবার জন্যই ভালো হবে। ’
তিনি বলেন, গোপনীয়তার কিছু বিষয় অবশ্যই থাকতে হবে। কেউ আমাদের এখানে কাজ করছেন, তিনি যদি কাল আমার এখান থেকে চলে যান, তখন আরেক জায়গায় গিয়ে যদি আমার কাজটা নিয়ে কাজ শুরু করে দেন- এটার জন্য তো ফিজিক্যালি কিছু নিতে হচ্ছে না। এটা তো মাথায় রয়ে গেছে। তাই এখানে গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে। এটা আইনে আনতে হবে।
‘প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের একটা নিজস্ব কাজ করার পদ্ধতি রয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের ট্রেড সিক্রেটটা সারাজীবন সিক্রেটই রাখতে হবে, বিদেশে এমন নিয়মও আছে। ’
খসড়া প্রণয়ন কমিটিতে যারা আছেন:
কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের একজন প্রতিনিধি, পেটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদফতরের একজন প্রতিনিধি, বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের একজন প্রতিনিধি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমের (বেসিস) একজন প্রতিনিধি, বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটির (বিসিএস) একজন প্রতিনিধি, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) একজন প্রতিনিধি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের একজন প্রতিনিধি, শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালকের একজন প্রতিনিধি, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের মহাপরিদর্শকের একজন প্রতিনিধি, ঢাকা বিভাগীয় শ্রম দফতরের পরিচালক মো. এস এম এনামুল হক এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিস্টেম এনালিস্ট।
কমিটি অন্যান্য দেশের (ভারত ও শ্রীলংকা) এ সংক্রান্ত আইনের কপি সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করবে। এছাড়া দেশে প্রচলিত অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইন যেমন- ট্রেড মার্কস আইন, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন, পেটেন্ট ও ডিজাইন আইন, কপিরাইট আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ইত্যাদি পর্যালোচনা করবে এ কমিটি।
-জেডসি