ক্যাপ্টেন টিলি পার্ক : সবুজের অরণ্য
আইরীন নিয়াজী মান্না, নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরে
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০২:১৮ এএম, ২০ মে ২০১৯ সোমবার
ক্যাপ্টেন টিলি পার্কে লেখক
নিউ ইয়র্কের জ্যামাইকা হিল সাইডে ক্যাপ্টেন টিলি পার্ক ঠিক যেন সবুজের অরণ্য। গাছ, পাহাড়ি পথ, পুকুর আর পাখ-পাখালির বিচরণে এক মূখরিত এলাকা।
গ্রীষ্মে সবুজের চাদরে ঢাকা থাকে পার্কটি। আবার শীতে একেবারে ভিন্ন রূপ। শ্বেতশুভ্র বরফে যখন ঢেকে যায়, তখন দেখতে খুব অচেনা লাগে। এ সময় পার্কজুড়ে চোখে পড়ে পত্রহীন গাছের কঙ্কাল। গত ২৩ মার্চ আমি যখন নিউ ইয়র্ক যেয়ে পৌঁছাই তখনও শীতের তিব্রতা রয়ে গেছে বেশ। পার্কের ফুলহীন, সবুজপাতাহীন গাছগুলো আমার চোখে ধরা দেয় অন্য এক রূপে। তারপর মাত্র দু মাসেই আমার চোখের সামনে একটু একটু করে সবুজের অরণ্যে পরিণত হয় পার্কটি।
জ্যামাইকা ৬৪ স্ট্রিটে আমার বোনের বাসা। এ বাসা থেকে বেড়িয়ে রাস্তা পেড়িয়ে দু কদম হেঁটে গেলেই ক্যাপ্টেন টিলি পার্ক। আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা পার্কটি আশেপাশের কাঠের তৈরি বাড়িগুলোর শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক বেশি।
দুই মাস নিউ ইয়র্কে থাকার সময় প্রায় প্রতিদিন আমরা দু’বোন কোনো দিন সকালে, কখনো বা বিকেলে আবার কোনো সময় নির্জন দুপুরে এ পার্কে বসে কত না গল্প করেছি ঠান্ডা বাতাস গায়ে মেখে। নির্জন পরিবেশে রুমি আপা কখনো গুনগুন করে গেয়ে উঠেছে মান্না দের রোমান্টিক গান। কখনো তার গলায় সুর ভেজেছে সতিনাথ কিংবা শাহানাজ রহমতুল্লাহ। খোলা আকাশের নিচে বসে আমি নিরবে শুনেছি রুমি আপার শ্রুতিমধুর কন্ঠ।
জ্যামাইকা হিল সাইডের এই পার্কটিতে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক মানুষ ঘুরতে আসে। গাছের ছাঁয়ায় দু‘দন্ড বসে ক্লান্তি দূর করে। নির্জন দুপুরে অথবা বিষন্ন বিকেলে এ পার্কে সময় কাটায় অনেকেই।
পার্কটি আয়তনে ৯ দশমিক ১৬ একর। সাজানো, পরিপাটি ছোট্ট একটি পার্ক। অসংখ্য গাছ-গাছালিতে ভরা। নাম না জানা পাখির নানা ডাক আর পাতা ঝরার শব্দে এখানে সময় কেটে যায় চমৎকার।
এই পার্কে বাচ্চাদের খেলার জন্য চমৎকার ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে স্লিপার, দোলনা, ক্লাইমিং ওয়ালসহ নানা রকম খেলনা। প্রতিদিন বিকেলে আর সাপ্তাহিক ছুটির দিন শিশুর দল মা-বাবার হাত ধরে ভিড় জমায় টিলি পার্কে।
টিলি পার্কের প্রধান আকর্ষণ টলটলে স্বচ্ছ পানির একটি পুকুর। নাম ‘গুজ পন্ড’। এই পুকুরে মহানন্দে ভেসে বেড়ায় হাঁসের দল। সাদা বড় বকসহ আরো নানা রকম পাখি অবাধে বিচারণ করে এখানে। পুকুরের মাঝখানে জংলি ঘাসে ঘেরা এক টুকরো দ্বীপের মতো জায়গা রয়েছে। পাখিদের প্রধান আশ্রয়স্থল ওটি।
পার্কটির নামকরণ নিয়ে আছে এক অসাধারণ ইতিহাস। জ্যামাইকা এলাকায় বসবাসকারী ধনাঢ্য এক পরিবারের সন্তান ক্যাপ্টেন টিলি। তার জন্ম হয় ১৮৬৩ সালের কোন একদিন। তারা পুরো নাম জর্জ এইচ টিলি (১৮৬৩-১৮৯৯)। ‘আর্মি সিগনাল’ গ্রুপের হয়ে ১৮৯৮ সালের স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। এই সৈনিক ফিলিপিন্স এবং প্যারিসে দায়িত্বপালণ করেন। সেই যুদ্ধে ১৮৯৯ সালে তিনি শহীদ হন। সে সময় তার বয়স ছিলো মাত্র ৩৬। পরে তার স্মৃতি রক্ষার্থে পার্কটির নামকরণ করা হয় তার নামে।
পার্কের জায়গাটি একসময় টিলি পরিবারেরই ছিল। পরে মালিকানা দেওয়া হয় ‘হাই ল্যান্ড পার্ক সোসাইটি’র কাছে। ১৯০৮ সালে পার্ক কর্তৃপক্ষ মাত্র এক ডলারের বিনিময়ে এটিকে নিউ ইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। শর্ত ছিল, জায়গাটিকে কেবল পার্ক হিসেবেই ব্যবহার করতে হবে। এক সময় ‘হাই ল্যান্ড পার্ক’ বলা হলেও, ১৯৩৫ সালে এটির নাম বদলে করা হয় ক্যাপ্টেন টিলি পার্ক।
এই পার্কে স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধের বেশ কয়েকটি স্মৃতি স্মারক রয়েছে। বড় একটি স্ট্যান্ডে গৌরবে উড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা। পার্কের প্রধান গেইটের পাশে লিখে রাখা হয়েছে পার্কটির ইতিহাস।
স্থানীয় মানুষদের প্রিয় মিলনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে টিলি পার্ক। এমনকি বিভিন্ন মেলা ও পিকনিকসহ সামাজিক নানা আয়োজনও হয়ে থাকে এখানে।
ছোট এই পার্কটি বৈচিত্রে ভরপুর। রক্ষণাবেক্ষণও অসাধারণ। গুজ পন্ডকে ঘিরে রয়েছে একটি ওয়াকিং ট্রেইল। ঘূর্ণায়মান মসৃণ এই পথ ধরে প্রতিদিন সকাল-বিকেল মানুষ হেঁটে বেড়ায়। জগিং করে। শিশুরা ফুটবল বা ছোট ছোট সাইকেল নিয়ে মেতে ওঠে খেলায়। সবুজ ঘাসকে বাঁচিয়ে কালো পিচঢালা মশ্রিণ পথ তৈরি করা হয়েছে পার্কের বিভিন্ন প্রান্তে হেঁটে যেতে।
পুকুরটির চারপাশে কাঠের বেঞ্চ ক্লান্ত কিংবা উদাস পথিককে আশ্রয় দেয়। বসে থাকতে ভালো লাগে বেশ। পার্কের মাঝামাঝি জায়গাতেও বেশ কিছু কাঠের বেঞ্চ রয়েছে আগতদের বসার জন্য।
চারদিক দিয়েই পার্কটিতে প্রবেশ করার ব্যবস্থা রয়েছে। পার্কটির এক পাশে রয়েছে এক খণ্ড পাহাড়ি পথ। সেই পথের দুই ধারে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষরাজি যেন সবাইকে অভিবাদন জানায়। গ্রীষ্মকালে রাস্তাটির কোথাও কোথাও গাছের জন্য সূর্যের আলো পৌঁছায় না। শীতে পাতা ঝরে আবার একেবারে ফাঁকা হয়ে যায় এই সবুজের অরণ্য। ক্যাপ্টেন টিলি পার্ক বছরে ঠিক যেন দুবার রূপ বদলায়।