অসাধারণ মহাকাব্য গেসার ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
আইরীন নিয়াজী মান্না
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৬:০৪ পিএম, ২৩ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার
মহাচীনের মহাবীর রাজা গেসারের জীবনী পৃথিবীতে আজও একটি আকর্ষনিয় মহাকাব্য। চীনের তিব্বত, অন্তমঙ্গোলিয়া, ছিনহাই প্রভৃতি অঞ্চলের শতাধিক লোকশিল্পী এখনো মহাবীর রাজা গেসারের মহান কীর্তির স্তুতি গাইছেন।
খ্রীষ্টপুর্ব দু থেকে তিন শো’ বছর থেকে খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দি পর্যন্ত রাজা গেসারের জীবনী রচিত হয়। প্রায় এক হাজার বছর লোকশিল্পীদের মুখে মুখে প্রচলিত হতে হতে গেসারের জীবন কাহিনী ক্রমেই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ‘রাজা গেসারের জীবনী’ পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয় এবং তিব্বতী জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
অনেক লোকসংগীত, উপকথা ও গল্প ‘রাজা গেসারের জীবনী’র মূল উপজীব্য। এ মহাকাব্যের শতাধিক চরিত্রের সকলেই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বে উজ্জ্বল। সে দিকবিজয়ী বীর হোক বা নিষ্ঠুর রাজা হোক, পুরুষ হোক বা নারী হোক, বৃদ্ধ হোক বা তরুণ হোক। প্রতিটি চরিত্র স্পষ্ট।
তিব্বত জাতির নানা প্রবাদ এ জীবন কাহিনীতে ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়া উপমা-উতপ্রেক্ষা, কোরাস, পুনরাবৃত্তি প্রভৃতি মৌখিক কাব্য সৃষ্টির বহু অর্থালঙ্কার ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন ‘হোলিং মহাযুদ্ধ’ শিরোনামের অধ্যায়ে একজন রূপসী সম্পর্ক বলা হয়েছে, লিং রাজ্যের সুন্দরীর এক পা এগুনোর মূল্য একশোটি ঘোড়ার সমান। এক পা পিছানোর মূল্য একশোটি ভেড়ার সমান। শীতকালে তিনি সূর্যের চেয়ে গরম, গ্রীষ্মকালে তিনি চাঁদের চেয়ে শীতল। তার শরীর ফুলের চেয়েও অধিক সুগন্ধীময়।
চীনদেশে ‘রাজা গেসারের জীবনী’ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদ। এ কারণে এ মহাকাব্যের পরিমার্জন, অনুবাদ ও প্রকাশনার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে চীন সরকার।
২০০২ সালে বিপুল আয়োজনে চীনে ‘রাজা গেসারের জীবনী’ রচনার হাজার বছর পালন করা হয়। বর্তমানে চীনের দশটির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন পণ্ডিত এ মহাকাব্য নিয়ে গবেষণা করছেন।
‘রাজা গেসারের জীবনী’র কাহিনী বেশ সমৃদ্ধ, ঘটনাবহুল ও ঐতিহাসিক। এ মহাকাব্যে বলা হয়েছে, অনেক দিন আগে তিব্বতী অঞ্চল প্রাকৃতিক দুর্যোগ-কবলিত ও দুষ্কৃতকারীদের জুলুম-হামলায় জর্জরিত ছিল। দৈত্য-দানবের দাপটে স্থানীয় অধিবাসীদের দু:খবেদনার অন্ত ছিল না। করুণাময় বুদ্ধিসত্য-অবলোকিতেশ্বর এ করুণ অবস্থা থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য বুদ্ধদেব অমিতাভকে অনুরোধ করেন। অসুরদের দমন করার জন্য তিনি যেন দেবতার ছেলেকে মর্ত্যে পাঠান।
দেবতার ছেলে থুইপাগেওয়া তিব্বতী জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে কালো চুলওয়ালা তিব্বতীদের রাজার অবতার নিলেন। তার নাম ‘গেসার’। এ মহাকাব্যে মহাবীর গেসার হলেন নৃ-দেব। তিনি সত, বৃদ্ধিমান এবং অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী। দৈত্য-দানব দমন এবং জনসাধারণের কল্যাণে তিনি যথার্থভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। গেসার মর্ত্যলোকে জন্ম গ্রহণের পর পরই স্থানীয় অধিবাসীদের রক্ষা করতে কাজ শুরু করেন। একে একে দুষ্কৃতকারীদের নির্মূল করেন। তিনি বার বার নানা চক্রান্তের শিকার হন। কিন্তু নিজের শক্তিবল এবং দেবতার সহায়তায় বিপদ থেকে মুক্তি পান তিনি। সর্ব শক্তি দিয়ে পৈশাচিক দানবদের নিশ্চিহ্ন করেন গেসার।
এ মহাকাব্যে বলা হয়, গেসারের বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হলে তিনি ও তার মা হোয়াংহো নদীর তীরে চলে যান। বারো বছর বয়সে গেসার উপজাতীয় ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এরপর তিনি দৈবশক্তি ব্যবহার করে অসুরদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালান। মর্ত্যলোকের সমস্ত দানবকে পরাস্ত করে চমত্কার সব কীর্তি প্রদর্শন করার পর তিনি মা এবং রানীকে নিয়ে স্বর্গে ফিরে যান।
মহাকাব্যটির কাহিনী এখানেই শেষ। পরিমার্জিত ‘রাজা গেসারের জীবনী’ ১২০ অধ্যায়ে বিভক্ত। এর শব্দ প্রায় দু কোটি। পঙক্তি দশ লাখের বেশি। বিশ্বের দীর্ঘতম মহাকাব্য হিসেবে এর শব্দ বিশ্বের বিখ্যাত পাঁচটি মহাকাব্য চেয়ে অনেক বেশি। অর্থাত্ প্রাচীন ব্যাবিলনের প্রাচীন মহাকাব্য’ ‘গিলগামেশ’, গ্রীকের মহাকাব্য ‘ইলিওড’ ও ‘অডিসি’ এবং ভারতের মহাকাব্য ‘রামায়ন’ ও ‘মহাভারত’ এর মোট শব্দের চেয়ে ‘রাজা গেসারের জীবনী’র শব্দ সংখ্যা অনেক বেশি।