সিরাজ ও আলেয়ার ছেলের কি হয়েছিলো
অনলাইন ডেস্ক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৯:৩০ পিএম, ১ জুলাই ২০১৯ সোমবার
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা বা মির্জা মুহাম্মাদ সিরাজ-উদ-দৌলা ( জন্ম: ১৭৩২ - মৃত্যু: ১৭৫৭) বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব। পলাশীর যুদ্ধে তার পরাজয় ও মৃত্যুর পরই ভারতবর্ষে ১৯০ বছরের ইংরেজ-শাসনের সূচনা হয়।
সিরাজউদ্দৌলা তার নানা নবাব আলীবর্দী খান-এর কাছ থেকে ২২ বছর বয়সে ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাবের ক্ষমতা অর্জন করেন। তার সেনাপতি মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ১৭৫৭ সালে ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হন। রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনভার গ্রহণ করে।
কখনও কি ভেবেছেন, এই নবাব সিরাজের বংশের কেউ জীবিত ছিলো কি না? তার বংশের ধারা কি সেখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো?
ইতিহাসের গৎবাধা পাঠে বিরক্ত যারা একটু ভিন্নতার ছোঁয়া চান, যারা মূল ইতিহাসের বাইরের ছোট্ট প্রশাখার সমান তাৎপর্যবাহী ফলটির স্বাদ পেতে চান, এই লেখা তাদের জন্যে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বংশধর তথা তার নিজ ঔরসজাত পুত্রের অজানা কাহিনী জেনে নিই চলুন।
নবাব সিরাজের বিশ্বস্ত সেনাপতিদের মধ্যে ছিলেন মীরমদন , মোহনলাল, খাজা হাদি প্রমুখ। পলাশীর যুদ্ধের আগে সিরাজ-উদ-দৌলা যখন মীর জাফরকে বক্সী পদে ফিরিয়ে আনেন, তখন এই তিনজন সেনাপতি প্রবল আপত্তি করেন। কিন্তু সিরাজ তাদের কথায় গুরুত্ব দেননি। বিশ্বাসঘাতকতার ফলশ্রুতিতে নবাব পরাজিত ও বন্দী হন। সেনাপতি মোহনলাল আহতাবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন (যদিও অনেকের ধারণ তিনি নিহত হয়েছিলেন, তবে তার জীবিত থাকার পক্ষেই প্রমাণ বেশি)।
মোহনলাল আঠারো শতকের গোড়ায় কাশ্মীর থেকে এসেছিলেন বাংলায়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সর্বপ্রকার ছুতমার্গ ও সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামির ঊর্ধে ছিলেন। নবাবের একান্ত অনুগত হিসেবে তিনি পলাশীর যুদ্ধে লড়াই করেন। কিন্তু এই মানুষটিকে নিয়ে ইতিহাসে তেমন আলোচনাই নেই।
মোহনলালের বোনের নাম ছিল মাধবী। তাকে হীরা বলেও ডাকা হতো। মোহনলালের সঙ্গে সিরাজের সখ্যের জের ধরে হীরার সাথেও নবাব সিরাজ অন্তরঙ্গ হয়ে পড়েন। তাদের অন্তরঙ্গতার ফলে হীরার গর্ভে সিরাজের এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। বৃদ্ধ আলিবর্দী খান তখনও এই সংবাদ পাননি। এই কথা জানলে তিনি ভয়ানক ক্রুদ্ধ হবেন ভেবে সিরাজ যথেষ্ট গোপনীয়তা অবলম্বন করে হীরা ও তার পুত্রকে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু শেষমেষ মাতামহের ভয়ে সিরাজ এক অস্বাভাবিক কান্ড করে বসেন। তিনি শিশুপুত্রকে একটি ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে বেঁধে দেন , তারপরে ঘোড়াকে তীরবিদ্ধ করে ছুটিয়ে দেন। ভাবলেন কেউ যদি ঘোড়া আটকায় , তো সে-ই না হয় এই সন্তানের দায়িত্ব নেবে। অর্থাৎ দায়িত্ব নেবার ভয়ে সিরাজ পুরোপুরি ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেন নিজ শিশু সন্তানকে।
এই সংবাদ পেয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হীরা ছুটে গিয়ে মোহনলালকে সব বলেন। মোহনলাল সাথে সাথে ঘোড়ায় চেপে দ্রুত ছুটে গিয়ে ছুটন্ত ঘোড়া থামিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করেন। এই ঘটনায় মোহনলাল এতো ক্ষিপ্ত হন যে তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। মোহনলালের সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরে আলিবর্দী খান কারণ অনুসন্ধান করে সমস্ত ঘটনা জেনে যান। মোহনলাল চলে গেলে সিরাজের ভয়ানক ক্ষতি হবে ভেবে দূরদর্শী আলিবর্দী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তাই ইমামের সাথে আলোচনা করে মীমাংসার একটি সূত্র বের করেন। হীরা ইসলাম গ্রহণ করলেই সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। হীরা ইসলাম গ্রহণ করলেন। তার নতুন নাম হলো আলেয়া। তারপরে ইসলামিক রীতি অনুযায়ী সিরাজের সাথে আলিয়ার বিবাহ সম্পন্ন হয়। আলিবর্দীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিরাজের পুত্রের দায়িত্ব মোহনলালকেই গ্রহণ করতে হয়।
খুশবাগে নবাবের পরিবারের সমাধিক্ষেত্রে আলেয়ার সমাধি দেখেই বোঝা যায় যে , তিনি নবাবের প্রাসাদে সম্মানিত অবস্থানে ছিলেন।
“মুর্শিদাবাদ কাহিনী” গ্রন্থের লেখক নিখিলনাথ রায়ের মতে সিরাজের কতজন স্ত্রী ছিল তা স্থির করা যায় না। তবে তিন-চারজনের উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে যে আলেয়া অন্যতম একজন, তা বিভিন্ন সূত্রমতে স্বীকৃত।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাবের বিপর্যয়ের পরপরই মোহনলাল বুঝতে পারেন যে, সিরাজের পুত্রের জীবনও বিপন্ন হবার মুখে। তাই যুদ্ধপরবর্তী বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে সবার অলক্ষ্যে তিনি ছয় বছরের সিরাজপুত্রকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে যান। তার সঙ্গে বাসুদেব ও হরনন্দ নামে দু’জন বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছিলেন। তারা পদ্মা নদী পার হয়ে ময়মনসিংহের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত বোকাইনগর দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। রেনেল কর্তৃক অঙ্কিত বাংলাদেশের প্রাচীন মানচিত্রে ময়মনসিংহ জেলায় বোকাইনগর গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
ক্লাইভ ও মীর জাফর চারদিকে গুপ্তচর পাঠিয়ে তাদের ধরার চেষ্টা করছে , এই খবর পেয়ে মোহনলাল বোকাইনগর দুর্গ নিরাপদ মনে করেননি। তার বিশ্বস্ত সঙ্গী বাসুদেবের কাকা বিনোদ রায় আমহাটি গ্রামে বাস করতেন। মোহনলাল সিরাজপুত্রকে কিছুদিন সেই বাড়িতে রাখেন। এরপর তিনি এই পুত্রকে দত্তক নেওয়ার জন্যে ময়মনসিংহের জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর সাথে কথা বলেন এবং জমিদার সম্মতিও দান করেন।
নিরাপত্তাজনিত কারণে মোহনলালের এক জায়গায় থাকা সম্ভব হয়নি। তিনি ও তার দুই সঙ্গী সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে রংপুর যান। কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে তারা পুনরায় ময়মনসিংহ ফিরে এসে জমিদারের সাথে দেখা করতে গিয়ে শোনেন জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী মারা গেছেন। তারা প্রয়াত জমিদারের ছেলে কৃষ্ণকিশোরের সঙ্গে দত্তকের বিষয়ে আলোচনা করেন, এ ব্যাপারে তার পিতার সম্মতির কথাও জানান।
কৃষ্ণকিশোরের ছোটভাই কৃষ্ণগোপাল দু’বার বিয়ে করলেও তার কোনো সন্তান ছিলো না। তারা দুই ভাইই জানতেন না যে তারা সিরাজপুত্রকে দত্তক নিচ্ছেন। তাদের বলা হয়েছিল যে তারা বাসুদেবের কাকা আমহাটির বিনোদ রায়ের দ্বিতীয় পুত্রকে দত্তক নিচ্ছেন। যথারীতি অনুষ্ঠান করে সিরাজের পুত্রকে দত্তক নেয়া হয় এবং তার নাম রাখা হয় যুগলকিশোর রায় চৌধুরী। এইভাবে নবাব সিরাজের পুত্র হিন্দু পরিচয়ে বড় হয়ে ওঠেন।
তথ্যসূত্র : সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে–অমলেন্দু দে