ঢাকা, রবিবার ২৪, নভেম্বর ২০২৪ ৪:২৭:৩৩ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
সাময়িক বন্ধের পর খুললো যমুনা ফিউচার পার্ক ডেঙ্গুতে আরও ১০ জনের প্রাণ গেল ডেঙ্গুতে এ বছরেই ৫১ শিশুর প্রাণহানি মাকে হত্যা করে থানায় হাজির ছেলে আমদানির সাড়ে তিনগুণ দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে আলু ঢাকায় আয়ারল্যান্ড নারী ক্রিকেট দল সাতক্ষীরায় সাফজয়ী তিন নারী ফুটবলারের গণসংবর্ধনা

অনন্য সংজ্ঞায় একাত্তরের জননী রমা চৌধুরী

সালেহীন বাবু | উইমেননিউজ২৪.কম

আপডেট: ০২:২৮ এএম, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ শনিবার

‘মুক্তিযুদ্ধ আমার কাঁধে ঝোলা দিয়েছে। আমার খালি পা, দুঃসহ একাকীত্ব মুক্তিযুদ্ধেরই অবদান। আমার ভিতর অনেক জ্বালা, অনেক দুঃখ। আমি মুখে বলতে না পারি, কালি দিয়ে লিখে যাব। আমি নিজেই একাত্তরের জননী।’ কথাগুলো রমা চৌধুরীর।
 
 
আর শোনা যাবেনা তার এই আওয়াজ। আপোষহীন ,অসাধারণ, একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ,বীরাঙ্গনা মা রমা চৌধুরী আর নেই। সবাইকে কাঁদিয়ে আজ সোমবার ভোর সাড়ে ৪টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের আইসিউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
 
 
বেশ কিছুদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা রমা চৌধুরীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। রোববার সন্ধ্যার পর তার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হয়। রাতে রমা চৌধুরীকে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হলে তার শুভানুধ্যায়ী মহলে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। ভোরে তিনি মারা যান।
 

সোমবার সকাল ১০টার পর রমা চৌধুরীর মরদেহ নগরীর সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়। অপরাহ্নে মরদেহ গ্রামের বাড়ি বোয়ালখালীর পোপাদিয়ায় নেয়া হবে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান হবে। তার মৃত্যুতে নগরীতে সকল মহলে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
 
 
রমা চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে। শিক্ষা জীবন শুরু করেন নিজ বিভাগেই। তারপর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর করেছেন ১৯৬১ সালে। রমা চৌধুরী ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কর্মজীবন শুরু করেন। পরে দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন।

 
১৯৭১ সাল। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। রমা চৌধুরী তখন পোপাদিয়ায়। পৈত্রিক ভিটায়। সাথে তিন পুত্র সন্তান ও বৃদ্ধা মা। স্বামী তখন ভারতে।
 

১৯৭১ এর ১৩ মে। এই দিনটা রমা চৌধুরীর জীবনে কালো এক অধ্যায়ের জন্ম দেয়। এই দিন ভোরে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা হামলা করে তার বাড়িতে। অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায় রমা চৌধুরীর উপর। তিন শিশুপুত্র তখন ঘরে । নির্যাতনের এক পর্যায়ে তিনি জীবন বাঁচাতে ঝাঁপ দেন পুকুরের জলে। প্রাণে বেঁচে যান। সেদিনই গানপাউডার ছিটিয়ে রমা চৌধুরীর বাড়িটি পুঁড়িয়ে দেয় রাজাকার ও পাকিস্তানিরা। তারপর থেকে শুরু হয় দুঃসহ যন্ত্রণার জীবন।
 
 
রমা চৌধুরীর লেখা একাত্তরের জননী গ্রন্থে সেইসব দুঃসহ দিনের কথা এভাবেই ফুটে উঠেছে, আমাদেরকে দেখতে বা সহানুভূতি জানাতে যারাই আসছেন তাদের কাছে আমার নির্যাতিত হবার ঘটনাটা ফলাও করে প্রচার করছে অশ্রাব্য ভাষায়। আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে খোন্দকারের বাড়ি। সে বাড়ির দুতিনজন শিক্ষিত ছেলে আমাদের তখনকার অবস্থা সম্পর্কে জানতে এলে আমার আপন মেজকাকা এমন সব বিশ্রী কথা বলেন যে তারা কানে আঙ্গুল দিতে বাধ্য হয়। আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছিনা, দোকানে গিয়ে কিছু খাবারও সংগ্রহ করতে পারলাম না মা ও ছেলেদের মুখে দেবার।
 

তারপরের আট মাস কাটে জঙ্গলে লুকিয়ে। রাতের বেলা পুঁড়া ভিটেতে খড়-পলিথিন বিছিয়ে ঘুমিয়ে থাকি। বর্ষা কিংবা শীত, কোন ঋতুতেই নিজেদের রক্ষা করার সম্বলটুকুও তখন অবশিষ্ট নেই।
 
 
অনাহার-অর্ধাহারে জননীর সন্তানেরা নানান অসুখে ভুগতে থাকে। ১৫ ডিসেম্বর রাত। বিজয়ের পূর্ব দিন। শ্বাসকষ্ট শুরু হয় ছেলে সাগরের। ডাক্তার-ঔষুধ-পথ্য কিছুই নেই। চারদিন এভাবে থেকে ২০ ডিসেম্বর মারা যায় সাগর। শোকে তিনি তখন অর্ধ পাগলিনী। ১৯৭২ এর ১৫ ফেব্রুয়ারীতে আরেক ছেলে টগরও একই অসুখে ভোগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তিনি তখন পাগলপ্রায় হয়ে উঠেন পুত্রদের শোকে। এই সন্তানদের জন্যই তিনি আত্মহনন থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। সন্তানদের মৃত্যুর পর প্রথম সংসার ভেঙে গেলে দ্বিতীয় সংসার করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন। তৃতীয় ছেলে টুনু ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। হিন্দুধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শবদেহ পোড়ানোতে বিশ্বাস করেন না রমা চৌধুরী। তাই মৃত্যুর পর তার তিন সন্তান ও মাকে কবরস্থ করা হয়। এরপর আর জুতা পায়ে দেননি।  
 
 
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, আমার তিন ছেলে মাটির নিচে। তাদের শরীরের উপর দিয়ে জুতা পায়ে আমি হাঁটি কী করে? আমার সন্তানদের কষ্ট হবে না?
 

পুত্রদের হারিয়ে তিনি একটানা চার বছর পায়ে জুতা পরেন নি।  দীর্ঘ চার বছর এভাবে হাঁটার পর প্রতিবেশীদের অনুরোধে জুতা পায়ে তুলেন।তাও শারীরিক অসুস্থতায়। কিছুদিন জুতা পায়ে রাখলেও গত ষোল বছর ধরে তিনি খালি পায়েই হেঁটে চলেন সবখানে।
 
 
স্বাধীনতার পরে ২০ বছর তিনি লেখ্যবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। প্রথমে তিনি একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানীর বদলে পত্রিকার ৫০টি কপি পেতেন। সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তার জীবন-জীবিকা। প্রখর রোদ কিংবা বৃষ্টি- বাদল। বৈরি আবাহাওয়া। কোন কিছুই থামাতে পারতোনা তাকে। চট্টগ্রামের অলি-গলিতে জননী রমা জননী কাঁধে বইয়ের ঝোলা নিয়ে খালি পায়ে হেঁটে বই বিক্রি করতেন । 
 
২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বাসায় পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত রমা চৌধুরী নিজের লেখা বই ফেরি করে বিক্রি করতেন। এ পর্যন্ত ১৮টি বই প্রকাশ করেছেন রমা চৌধুরী।
 
 
ব্যক্তিত্ববোধের অনন্য এক উদাহরণ রমা চৌধুরী। তিনি একজন বিস্ময়কর নারীও। কয়েকবছর আগে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন রমা চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণেই। দুজন ভাগ করে নেন নিজেদের কষ্টকে। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে সহযোগিতার কথা বলা হলে তিনি বিনয়ের সাথে তা গ্রহণ না করার কথা জানান। মূলত তিনি দুঃখের উপাখ্যান শোনাতেই দেখা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যার সাথে।
 
 
আজ রমা চৌধুরী নেই। তার আদর্শ আছে। তার শিক্ষা আছে। যে শিক্ষায় জীবনের আত্মসম্মানবোধ নিয়ে বেঁচে থাকার প্রেরণা জাগায়। জীবনের সংগ্রামে নতুন করে বাঁচার সাহস জোগায়।
 
 
যতদিন থাকবে বাংলাদেশ, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বীরাঙ্গনা জননী রমা চৌধুরী বেঁচে থাকবেন আমাদের আদর্শ আর প্রেরণার ভাষা হিসেবে। বিনম্র শ্রদ্ধা তোমায় হে জননী।