ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২১, নভেম্বর ২০২৪ ২১:৫৪:০৪ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
ঠাকুরগাঁওয়ের তিন নারী ফুটবলারকে সংবর্ধনা ডেঙ্গুতে একদিনে নয়জনের প্রাণহানী সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়া, স্বাগত ও ধন্যবাদ জানালেন ড. ইউনূস রাজধানীতে আজও অটোরিকশা চালকদের সড়ক অবরোধ আজ ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় পঞ্চগড়ে তাপমাত্রা নামল ১৪ ডিগ্রিতে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সুযোগ কাজে লাগাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সরকার

উই’র নারী উদ্যােক্তাদের সাফল্য ও সংগ্রামের কথামালা

নিজস্ব প্রতিবেদক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:২৮ পিএম, ৮ নভেম্বর ২০২২ মঙ্গলবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্ট উই’র জয়ী অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন রাজশাহীর পবার মাহবুবা আক্তার জাহান বাঁধন। অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তির অনুভূতি বলতে গিয়ে তিনি  জানান, ব্যবসায় ধোঁকা খেয়ে আমি হতাশায় ডুবে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। উই’র মাধ্যমে আবার আমি ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পেয়েছি। নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছি। ‘আমি নারী আমি পারি’ এই অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তির মাধ্যমে এটাই প্রমাণ হলো।

মাহবুবা আক্তার জাহান বাঁধনের জীবনে হঠাৎ করেই অন্ধকার নেমে এসেছিল। ব্যাংকার বাবা  মারা যাওয়ায় মাত্র ১৪ বছর বয়সে মা তাকে বিয়ে দিয়ে শ^শুরবাড়িতে পাঠান। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। পাঁচ বছর পর তিনি আবার লেখাপড়া শুরু করেন। ২০১৬ সালে নিজে কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নেন। শাশুড়ির দেওয়া এক লাখ টাকা দিয়ে শেয়ারে ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু পার্টনার তাকে ঠকিয়ে নিঃস্ব করে দিয়ে যায়। শ্বশুরবাড়ির লোকদের অনেক গাল-মন্দ শুনতে হয় তাকে। অপমানে ২০১৯ সালে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন তিনি। ২০২০ সালের মার্চ মাসে ফেসবুকে উই’র গ্রুপ দেখেন।

ব্যবসায় লোকসান করেও পরবর্তীতে কিভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন এ প্রসঙ্গে  মাহবুবা আক্তার জাহান বাঁধন বলেন,  ‘ফেসবুকে উই’র গ্রুপে ৩ হাজার ৭০০ সদস্য দেখে ভাবলাম, এখানে ধোঁকা খাবো না। উই’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্যবসা শেখার দিক নির্দেশনা পাই। এবার আর পার্টনারে নয়, বাবার বাড়ি-শ্বশুরবাড়ির আম বাগানের আম, খেজুরের গুড়  ফেসবুকের মাধ্যমে উই’তে প্রচার শুরু করি। পাশাপাশি বাঁধন ফুড নামে একটি পেজ খুলি। প্রচুর সাড়া পাই। আম, খেজুরের গুড় মৌসুমী ব্যবসা। এরপর ভাবি, কি করা যায়!’

তিনি আরো বলেন, ‘এই ভাবনা থেকেই ঝালমুড়ির মশলা উই’তে প্রচার করি। সব ধরনের মশলা যাতায় পিষে ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেলে জ্বাল দিয়ে ঝালমুড়ির মশলা তৈরি করি। এটা প্যাকেট করে বিক্রি করি। সংসদ ভবনের পরিচালক মাহবুবা ম্যাডাম, স্বাস্থ্য  সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব  সৈয়দ মজিবুল হক স্যার আমার গ্রাহক। ৬৪ জেলার নারী উদ্যোক্তাদের কাছে এখন আমি বাঁধন আপু নামেই পরিচিত।’

আরেক নারী উদ্যোক্তা বিপাশা দাশ হাতের তৈরি মেটাল, কুন্দন, কাঠের হ্যান্ডপেইন্টের গহনা তৈরি করেন। ২০১৯ সালে তিনি উই’র সঙ্গে যুক্ত হন। তখন এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৩ হাজার। শিক্ষার্থী অবস্থায় এক বন্ধুর কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার করে উপকরণ কিনে সুতার গহনা তৈরি করে বিক্রি করেন। বাবা-মা-ভাইবোনদের কোনো সহযোগিতা পাননি তিনি।

বিপাশা দাশের মতে, আমাদের পরিবারের মেয়েদের নবম শ্রেনিতে উঠলেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। আমি লেখাপড়ার শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতাম। আমার জেঠীমা চিনু দাশ আমাকে চট্টগ্রাম শহরে তার কাছে নিয়ে আসেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, লেখাপড়া শিখে সাবলম্বী হবে। উই’র মাধ্যমে এ পর্যন্ত ২ লাখ টাকার পুঁজি দিয়ে ৬ লাখ টাকার গহনা বিক্রি করেছি। মাসে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার গহনা বিক্রি করতে পারি। এবার আইসিটি মন্ত্রণালয়  থেকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছি। ব্যবসায় এখন জামদানি শাড়ি যুক্ত করেছি।

উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্ট উই’র ৪ লাখ নারী উদ্যোক্তার একজন সৈয়দা ওয়াকিমুন্নেছা ওমেনা। কুমিল্লার মেয়ে ওয়াকিমুন্নেছা ১৮০ টাকা দিয়ে ৩গজ কাপড় কিনে কামিজ তৈরি করে নিজের হাতে সুচি কাজ করে ৭০০ টাকায় বিক্রি করেন। এরপর ২০১৫ সাল থেকে নিজের নকশায় সুচিকাজ, ভেজিটেবল ডাই’এ দেশীয় পণ্য তৈরি করে ডি.এস.ক্রিয়েশন  নামে ফেসবুক বিজনেস পেজ খুলে তা প্রদর্শন করতেন। ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্টে উই’র প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশার মাধ্যমে ২০১৭ সালে এর সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। 

সৈয়দা ওয়াকিমুন্নেছা ওমেনা  বলেন, ‘এখন আমার পুঁজি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। আইসিটি থেকে ৫০ হাজার টাকা অনুদানও পেয়েছি ব্যবসা এগিয়ে নেওয়ার জন্য। সংসার, স্বামী, সন্তান সব সামলিয়ে ব্যবসাও করছি। যা আয় হয় তা থেকে শতকরা ১০ ভাগ সংসারে খরচ করি।’

চট্রগামের মেয়ে নাসিমা আকতারের বৃদ্ধা মাকে নিয়েই সংসার। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার চাকরির সুবাদে ঢাকার বাড্ডায় বসবাস করছিলেন। ২০১৪ সাল থেকে নিজে কিছু একটা করবেন মনে মনে ভাবছিলেন। 

এদিকে ২০২০ সালে প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ হতেই ডিসেম্বরে তিনি উই’র সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ঘানিতে ভাঙ্গা সরিষার তেল দিয়েই ফেসবুকে ব্যবসা শুরু করেন।

নাসিমা আকতার  জানান, মাত্র ১০ হাজার টাকা দিয়ে কিশোরগঞ্জের নান্দাইল থেকে ঘানি ভাঙ্গা  সরিষার তেল এনে ব্যবসা শুরু করি। এরপর সুন্দরবনের চাক ভাঙ্গা মধু, দুধের সরের ঘি, নিজের হাতে তৈরি সব ধরনের গুঁড়া মশলা, সব ধরনের শুঁটকি। প্রান্তিক এলাকা থেকে অর্গানিক পণ্য এনে বাজারজাত করা প্রথমে সহজ ছিল না। সারা বাংলাদেশ ঘুরে এসব অর্গানিক পণ্য সংগ্রহ করেছি। প্রসেসিং করে তা অনলাইনে বাজারজাত করেছি। এখন ব্যবসার পুঁজি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। দ্বিতীয় মেয়াদের তালিকায় ব্যবসার উন্নয়নের জন্য আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছি। এই অর্থ দিয়ে ব্যবসায় নতুন পণ্য যুক্ত করব। পাশাপাশি ওয়েবসাইট পেজ নতুনভাবে সাজাব।

উইমেন এন্টারপ্রেনারস ফাইন্যান্স ইনিশিয়েটিভ (উই-ফাই) এভাবেই নারী এসএমই উদ্যোক্তাদের বাজার তৈরির কাজ করছে। উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্ট উই’র প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা এ প্রসঙ্গে কে বলেন, নারীরা ব্যবসা করতে গিয়ে যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হন ২০১৭ সালে ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে তা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি। কারণ আমার মনে হয়েছে, ব্যবসা করতে আগ্রহী আমার মতো অনেক নারীর এমন সমস্যায় রয়েছেন। একটা প্ল্যাটফর্ম থাকলে আমরা নারীরা ই-কমার্সের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারি। আমরা ফ্রি ভেন্যুতে উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্ট উই’র সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি করি।ৎ

তিনি আরো বলেন, ‘২০১৯ সাল থেকে উই’র নারী উদ্যোক্তারা দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করি। কোভিড ১৯ এর সময়ে অনেকের স্বামীর চাকরি চলে যায়। গৃহিণীরা যে যা তৈরি করতে পারেন তা দিয়েই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এই নতুন নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঈদ আসতে আসতেই ৩০০ নারী উদ্যোক্তা লাখপতি উপাধি পেয়েছেন। যারা লাখপতি তারা  ডাটাবেসে যুক্ত হয়েছেন। ৫০ লাখের উপরে যাদের পুঁজি তারা অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছেন। এখন উই’র ১৩ লাখ নারী সদস্য। প্রতি ২৮ দিনে ভিজিট করেন ১ কোটি ২৯ লাখ ভিজিটর। এর ফলে কেউ ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত তার পণ্য বিক্রি করতে পারেন। এটা নারী ব্যবসায়ীদের জন্য একটি ইতিবাচক দিক।’

মেনকা রানী দেবনাথ তার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প বলতে গিয়ে বলেন, ‘কোনো পুঁজি ছাড়া নারিকেলের নাড়– দিয়ে উই’র মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করি। দুধের সন্দেশ, তিলের নাড়–, দুধ বা দুধ ছাড়া দু’রকমের নারিকেলের গুড়ের নাড়–, সুজির নাড়–, তিল সুন্দরী এসব খাবার তৈরি করি।  দেশী গরুর দুধ ব্যবহার করি। একজন সহযোগী হিসেবে নিয়েছি। কাজের চাপ অনুযায়ী তাকে পারিশ্রমিক দিই। গত পূজায় ২০ হাজার টাকার একটা অর্ডার পেয়েছিলাম।’

ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের সহায়তায় উই উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়। 

আইসিটি বিভাগের  জ্যেষ্ঠ সচিব এন এম জিয়াউল আলম পিএএ নারী উদ্যোক্তাদের প্রসঙ্গে বলেন, ‘নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসার মাধ্যমে ই-কর্মাস প্রসারিত হচ্ছে। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে আইসিটি বিভাগ নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।’
ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ.এন.এম শিবলী  নোমান খান বলেন, ‘ লিঙ্গ, সামাজিক পুঁজি, উদ্যোগ, সরকারি এজেন্সি এবং মার্কেটিং ও ব্যবস্থাপনা ; আমরা এই পাঁচটা জিনিসের উপর ভিত্তি করে আমাদের গবেষণা  ফ্রেমওয়ার্কটি সাজিয়েছি। নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যগুলো কিভাবে  দেশের চাহিদা মিটিয়ে  বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হতে পারে এই গবেষণায় তা উঠে এসেছে।’